পশ্চিমা বস্তুবাদের দার্শনিক সূত্র
প্রাচীন গ্রীস সমাজই ইতিহাসের গোড়ার দিকে তার নিয়ম-প্রণালী, প্রথা, শিল্পকলা ও বিজ্ঞান থেকে ধর্মকে বিতাড়িত করেছে। অপর কথায় প্রাচীন গ্রীসই ছিল প্রথম সত্যিকার, ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ। তার দর্শনের ভিত্তি ছিল সৌন্দর্য ও ন্যায় বিচারে পরিপূর্ণ অখণ্ড সমাজ বুদ্ধি ও মানব মনীষার প্রয়োগ করে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। এতে অতি প্রাকৃতিক কোন সাহায্যের প্রয়োজন নেই। আজ পর্যন্ত এই ধর্মনিরপেক্ষ ধারণাই পশ্চিমা সভ্যতার মূল চাবিকাঠি হয়ে আছে।
প্রাচীন গ্রীকদের মতে মানুষের নগ্ন শরীরে সৌন্দর্য চরম উৎকর্ষতা লাভ করেছে। নর-নারীর নগ্ন দেহই গ্রীক শিল্পকলার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। ভাস্কর্যশিল্প এবং চিত্রকররা বিরামহীনভাবে এ চিত্র অঙ্কন করে চলেছে। শরীরের সার্বিক উন্নয়নের জন্যে খেলাধূলাকে খুবই উৎসাহ দেয়া হয়। ছোট খাট বা কোন অখ্যাত শহর নেই যেখানে খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষণের জন্যে সরকারী ব্যায়ামাগার নেই। ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করার অভিপ্রায়ে উন্মুক্ত ষ্টেডিয়ামে নিয়মিত ক্রীড়া প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা হয়। হাজার হাজার লোক এসব খেলা উপভোগ করে। অংশগ্রহণকারী খেলোয়াড়দেরকে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র করা একটা প্রথায় পরিণত হয়েছে। অলিম্পিক খেলা এসব প্রতিযেগিতার মধ্যে খুবই প্রসিদ্ধ। এই প্রতিযোগিতা এখনও চলছে।
প্লেটোর (৪২৭-৩৪৭ খৃঃ পূঃ) রিপাবলিকের একটি উদ্ধৃতি। তিনি তার গুরু সক্রেটিসের (৪৬৯-৩৯৯ খৃঃ পূঃ) মুখ দিয়ে কল্পিত সুখ রাজ্য তথা একটি আদর্শ রাষ্ট্রের পরিচয় দিয়েছেন এই ভাবে- Glaucon সক্রেটিসকে প্রশ্ন করলঃ তুমি কি মনে কর, প্রহরারত কুকুরদের মধ্যে পুরুষ কুকুর যে কাজ করে মাদি কুকুরদেরও তা করা উচিত। অথবা পুরুষ কুকুরদের সঙ্গে কি মাদি কুকুরদেরও শিকার করা উচিত, অথবা বাচ্চা জন্ম এবং লালনের জন্যে তাদের কুকুরশালায় রাখা উচিত এবং পুরুষ কুকুরদের কি শক্ত কাজের সঙ্গে দলের রক্ষণাবেক্ষণও করা উচিত।
সক্রেটিস বললেনঃ তাদেরকে সবকিছু এক সঙ্গে করতে হবে। পুরুষ শক্তিশালী এবং মাদি দুর্বল কেবলমাত্র এই ধারণা ছাড়া।
কিন্তু একই প্রশিক্ষণ ও জ্ঞান না দিয়ে তুমি কি পশুদেরকে একই কাজে ব্যবহার করতে পারবে?
অসম্ভব?
‘এখন পুরুষদেরকে গান এবং শরীরচর্চা শিখানো হয়। সুতরাং মহিলাদেরকে এ দুটি শিল্প শিখাতে হবে এবং একইভাবে তাদের কাজে লাগাতে হবে। কুস্তির স্কুলে আমরা পুরুষদের সঙ্গে মহিলাদেরকেও নগ্ন অবস্থায় ব্যায়াম করতে দেখতে চাই। শুধু যুবতী নয়-বৃদ্ধাদেরকেও। ব্যায়ামাগারে বৃদ্ধদের সঙ্গে বৃদ্ধাদেরকেও আমরা এবড়ো থেবড়ো অবস্থায় দেখতে চাই। যারা খেলায় এখনো সুন্দর তাদের দেখতে ভাল লাগে না’।
“কিনউত আমরা অভিজ্ঞতা থেকে দেখতে পেরেছি, এ সব জিনিস লুকিয়ে রাখার চাইতে বিবস্ত্র করা ভাল। চোখের ভালোর চাইতে যুক্তিতে যা ভাল তাই শ্রেষ্ঠ। এই সব মহিলাদেরকে পুরুষদের সাধারণ সম্পত্তি হতে হবে; কোন ব্যক্তিরই নিজস্ব ব্যক্তিগত স্ত্রী থাকা উচিত নয়, সন্তানরাও হবে সাধারণ সম্পত্তি। পিতামাতা তার সন্তান চিনবে না এবং সন্তানরাও পিতামাতা চিনবে না”।
“আমি তোমার বাড়ীতে শিকারী কুকুর এবং খেলার পাখী দেখছি। তুমি কি কোনদিন তাদের মিলন অথবা প্রজননের দিকে নজর দিয়েছো?”
“এর পর আমাদের সিদ্ধান্তঃ শ্রেষ্ঠ পুরুষদের শ্রেষ্ঠ মহিলাদের সঙ্গে মেশা উচিৎ এবং কেবলমাত্র শ্রেষ্ঠ লোকদের লালন করার উচিত। যদি দলকে ছিম-ছাম থাকতে হয় তাহলে অন্যদের লালন করার অনুচিত। শাসকরা ছাড়া এই শিশু হত্যার কথা অন্যদের জানতে দেয়া উচিত নয়। শাসকদেরকে শাসিতের কল্যাণের জন্যে মিথ্যা এবং প্রতারণার আশ্রয় নিতে হবে। আমরা আগেই বলেছি চিকিৎসা হিসেবে এসবই প্রয়োজন। ক্রটিপূর্ণ সন্তান জন্মালে তার জন্যে খাদ্য এবং লালন পালন ব্যবস্থা নেই- এই যুক্তিতে তাকে সরিয়ে দিতে হবে”।
রোমের ইহুদী ও খৃষ্টানরা গ্রীসের এই ধর্মনিরপেক্ষ উত্তরাধিকারকে গ্রহণ, লালন এবং বিলুপ্তি থেকে রক্ষা করেছে। অবশ্য সবকিছুর উর্ধ্বে রোমানরা ছিল সামরিকমনা। ফলে সৌন্দর্য পূজার পরিবর্তে শীগগীরই শক্তি পূজা শুরু হয়েছে। গ্রীকদের আদর্শবাদ ক্রমবর্ধমান বৈরাগ্যবাদ, পলায়নবাদের রূপ নিয়েছে। এই কারণে রোমান দার্শনিক Tyre- এর maximus নাস্তিক্যবাদের পক্ষে নিম্নোক্ত যুক্তি দিয়েছেন।
“অবিনশ্বরের সকল কিছুর অবিনশ্বর থাকার ইচ্ছা রয়েছে। তার অপরিবর্তিত ইচ্ছায় যদি প্রার্থনা করা হয়, তিনি কি করতে বলেছেন তা তাঁকে জিজ্হেস করা অর্থহীন। যদি কেউ তার নির্ধারিত কাজের বিপরীত করার জন্যে তার কাছে প্রার্থনা করে, প্রার্থনাকারী চায় সে দুর্বল, নগণ্য, অসঙ্গত হোক। তিনি দুর্বল, নগণ্য এবং অসঙ্গত বিশ্বাস করার অর্থ তাকে নিয়ে তামাসা করা। তোমার কোন ভাল কাজের ইচ্ছা জাগলে তোমার প্রার্থনা ছাড়াই তিনি তা করবেন। তার কাছে অনুনয় করার অর্থ তাকে অবিশ্বাস করা
, অথবা বিষয়টি এমন অন্যায় যার দ্বারা তুমি তাকে অপমান করো। তুমি উপযুক্ত হও অথবা অনুপযুক্ত হও- করুণা তুমি পাবে, যদি তুমি উপযুক্ত হও- সে তোমার চাইতে ভাল জানে, যদি অনুপযুক্ত হও, যা পাওয়ার যোগ্য নও তা চেয়ে তুমি আরেকটি পাপ করো। এক কথায় আমরা স্রষ্টার কাছে এজন্য প্রার্থনা করি যে তাকে আমরা নিজেদের সীমাবদ্ধতায় চিন্তা করি”। (The portable Voltaire Viking press New York, 1949)
রোম সাম্রাজ্যের পতন এবং রেনেসাঁর উদ্ভব পর্যন্ত হাজার বছরে রোমান ক্যাথলিক গীর্জাই প্রাধান্য পেয়েছে। মধ্যযুগ নামে পরিচিত এই সময়ে প্রাচীন গ্রীস ও রোমের সঙ্গে ইউরোপের ঐতিহাসিক পারস্পর্য বিচ্ছিন্ন হয়েছে। বস্তুতঃ মধ্যযুগ তার নিজস্ব সুস্পষ্ট ও একক সভ্যতার জন্ম দিয়েছে। প্রাচীন গ্রীস, রোমান সমাজ বা আজকের ইউরোপের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কোন বৈশিষ্টই তার নেই। বস্তুতঃ মধ্যযুগের সভ্যতাকে কেবলমাত্র ভৌগলিক অবস্থানের কারণে পশ্চিমা বলা যেতে পারে।
মধ্যযুগীয় সভ্যতা সকল দিক থেকে আধুনিক সভ্যতার বিরোধী এবং বিপরীতধর্ম ছিল। এ কারণে ইউরোপের ইতিহাসের কোন অধ্যায় সম্পর্কে অপবাদ দেয়া হয়নি। একই কারণে ইংরেজী ভাষায় ‘মধ্যযুগীয়’ শব্দের চাইতে খারাপ ভাষা ব্যবহৃত হয়নি। যখনি কোন আমেরিকান বা ইউরোপীয় এই বিশেষণের সম্মুখীন হয়েছেন তার মনে বর্বর, সামন্ত অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের ‘কালোযুগ’ ভেসে উঠেছে। কোন পশ্চিমা লোক বিশ্বের কোন এলাকা বিশেষ করে অনগ্রসর এলাকার বর্ণনা দিতে ইচ্ছুক হলে তাকে ‘মধ্যযুগীয়’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
ইউরোপের নেতৃস্থানীয় বুদ্ধিজীবীরা প্রাচীন গ্রীস ও রোমের সমালোচনা মুক্ত ভক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে খৃষ্টান ধর্ম পরিহারকে রেনেসাঁসের সঙ্গে সংযৃক্ত করেছেন। রেনেসাঁ সত্যিকারভাবে বুঝিয়েছে খৃষ্টান ধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও নবায়ন। এই ভাবে পশ্চিমা সভ্যতা তার আদি বক্তব্যে ফিরে গেছে। এখন পর্যন্তও সেভাবেই চলছে।
রেনেসাঁর মূল প্রেরণার সংক্ষিপ্তসার যারা দিয়েছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন Ivicolo Machiavelli (১৪৬৯-১৫৩২)। ইতালীর ফ্লোরেন্সের অধিবাসী মেকিয়াভেলি তার সরকারের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ আসন লাভ করেন। তার তের বছরের কর্মজীবনে পার্শ্ববর্তী স্পেন এবং ফ্রান্সের রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তির তুলনায় ইতালীর অসহায়ত্ব তাকে হীনমন্য করে রেখেছিল। ফ্রান্সের সঙ্গে যুদ্ধের পর মেকিয়াভেলি পদচ্যুত এবং দেশান্তরিত হন। প্রবাসী জীবনে তিনি রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন, সংহতকরণ ও সম্প্রসারণের ব্যাপারে সব চাইতে প্রভাবশালী বক্তব্য সম্বলিত The prince পুস্তক রচনা করেন। সব কিছুর উর্ধে মেকিয়াভেলী ছিলেন জাতীয়তাবাদী ও দেশপ্রেমিক। তার স্বপ্ন ছিল আধিপত্যশালী বিশ্বশক্তি হিসেবে অখণ্ড ইতালীর আত্মপ্রকাশ। মেকিয়াভেলী ছিলেন আধুনিক একদলীয় শাসনের জনক। তিনি ক্ষমতাকে তার চূড়ান্ত শক্তি হিসেবে বিবেচনা করেছেন।
“আমি জানি কোন প্রিন্সের মধ্যে সকল সদগুণ সকলের প্রসংসার্হ”। তবে সেগুলো কারো পক্ষে অজৃন, ধারণ বা পালন সম্ভব নয়, একজন মানুষের পক্ষে তা সম্ভবও নয়। সে যদি মনে করে থাকে তাকে সকল অন্যায় পরিহার করার মত বুদ্ধিমত্তার অধিকারী হতে হবে, দেখা যাবে গুণ বলে বিবেচিত এমন কিছু জিনিসও কারো ধ্বংসের কারণ হতে পারে এবং এমন কিছু জিনিস-যা দোষ বলে মনে হয়- তা কারো বৃহত্তর নিরাপত্তা এবং কল্যাণে আসতে পারে।
প্রত্যেকেই জানেন ধূর্ততা ছাড়া কোন প্রিন্স যদি সকলের বিশ্বাস নিয়ে নির্বিঘ্ন জীবন যাপন করে তা কতই প্রশংসনীয়। তবুও আমাদের যুগের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে, যে সব প্রিন্স মহৎ কাজ করেছেন সৎ বিশ্বাসের প্রতি তাদের সামান্য শ্রদ্ধাই আছে, তারা ধূর্ততর সঙ্গে মানুষের মস্তিস্ক বিগড়িয়ে শেষ পর্যন্ত সৎ লোকদের ওপর জয়ী হছেছেন।
এই ধরনের একজন প্রিন্সকে পশুরু মত কাজ করার জন্যে শৃগাল এবং সিংহের অনুকরণ করতে হবে। কারণ সিংহ নিজেকে ফাঁদ থেকে রক্ষা করতে পারে না এবং শৃগাল নিজেকে নেকড়ের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে না। অতএব একজন প্রিন্সকে ফাঁদ চেনার জন্যে শৃগাল এবং নেকড়েদের ভীত করার জন্যে সিংহ হতে হবে। যারা কেবল সিংহত হতে চান তারা এটা বোঝেন না। সুতরাং বুদ্ধিমান শাসককে কখনো শাসিতকে বিশ্বাস করা উচিত নয়, এটা তার স্বার্থের বিরুদ্ধে যাবে। যখন তিনি যুক্তি দিয়ে তা বুঝবেন তখন ক্ষমতা তার নাগালের বাইরে চলে যাবে। যখন তিনি যুক্তি দিয়ে তা বুঝবেন তখন ক্ষমতা তার নাগালের বাইরে চলে যাবে। যদি সকল মানুষ ভাল হতো তাহলে এই উপদেশ সঠিক হতো না। কিন্তু যেহেতু তারা খারাপ এবং তোমার সঙ্গে বিশ্বাস রক্ষায় বাধ্য নয়, সুতরাং তুমিও তাদের সঙ্গে বিশ্বাস রক্ষায় বাধ্য নও। অনেকে প্রিন্সের বিশ্বাস ভঙ্গের ফলে কত প্রতিশ্রুতি মূল্যহীন হয়েছে এবং কত অশান্তি সৃষ্টি হয়েছে তার ভুরি ভুরি আধুনিক নজির তুলে ধরবেন এবং যারা শৃগালকে অনুকরণ করেছে তারাই শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছে বলে প্রমাণ দেবেন। তবে এই চরিত্র গোপন রাখা প্রয়োজন এবং ভান করা, কপটতা দেখানো খুবই ভাল। মানুষ এতই সরল এবং বর্তমান প্রয়োজনকে মেনে নিতে এতই প্রস্তুত যে যিনি প্রতারণা করেন তিনি দেখবেন যে, প্রতারিতরাই প্রতারণার সুযোগ দিয়েছে।
একজন প্রিন্সকে খুবই সতর্ক থাকতে হবে যে, তার মুখ থেকে যেন ক্ষমা, বিশ্বাস, মানবতা, আন্তরিকতা এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের বিরোধী কোন কথা না বেরোয়। এই গুণ ছাড়া আর বিশেষ কিছুর প্রয়োজন নেই কারণ মানুষ সাধারণতঃ হাতের চাইতে চোখ দিয়েই বিচার করে। কেননা প্রত্যেকেই দেখতে পায় কিন্তু অল্প লোকই অনুধাবন করতে পারে। প্রত্যেকেই দেখে তুমি দেখতে কেমন, খুব অল্প লোকই অনুধাবন করে তুমি কি এবং এই স্বল্পসংখ্যকরা বহু লোকের যুক্তির কাছে নিজেদের বক্তব্য প্রকাশে সাহসী হবে না। মানুষের কাজ বিশেষ করে প্রিন্সের কাজের বিরুদ্ধে তাদের কোন অভিযোগ থাকে না। “উদ্দেশ্যই উপায়ের যথার্থ নির্ধারণ করে”।
প্রটেষ্টান্টদের সংস্কার আন্দোলন খৃস্টান ধর্মের ওপর এমন আঘাত হেনেছে যে, পরবর্তীকালে কখনো খৃষ্টানধর্ম ও তা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। গীর্জার ক্ষমতা, দুনীতি ও অপকর্মের সংশোধনের কোন পথ না পেয়ে মার্টির লুথার তার বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলেন এবং নিজে একটি ধর্মমত প্রচারের সিদ্ধান্ত নেন। পোপের কর্তৃত্ব ও ল্যাটিন ভাষা প্রটেষ্টান্টদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় ধর্ম নিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদ খুবই শক্তিশালী হয়েছে। শক্তিশালী খৃষ্টান সাম্রাজ্যের স্থলে বহু ক্ষুদ্র, দুর্বল গোত্রের সৃষ্টি হয়েছে। প্রত্যেকেই সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অপরের বিরোধীতা করেছে। প্রটেষ্টেন্ট দেশসমূহে সরকারী নিয়ন্ত্রণে জাতীয় গীর্জা স্থাপন করা হয়েছে। ইউরোপের অন্যান্য জায়গার মত ধর্মের আধ্যাত্মিক শক্তি ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক শাসকদের সহায়ক শক্তিতে পরিণত হয়েছে।
সংক্ষেপে প্রটেষ্টান্ট সংস্কার আন্দোলনের পর রেনেসাঁর পন্ডিতরা গীর্জার বিরুদ্ধে বিজ্ঞানকেই সব চাইতে শক্তিশালী হাতিয়ার বানিয়েছে। ফ্রান্সিস বেকন (১৫৬১-১৬১৫) The new atlantis গ্রন্হে বৈজ্ঞানিক প্রেরণার সার সংক্ষিপ্ত করেছেন। প্রশান্ত মহাসাগরের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কাল্পনিক দ্বীপে একটি ইংলিশ জাহাজ অবতরণ করবে তার প্রধান গর্বের কাজ হবে বিজ্ঞান গবেষণার জন্যে নিবেদিত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। শাসক যাত্রীদেরকে এই বলে পরিচালিক করেছেন “জ্ঞানানুসন্ধান ও জিনিসের গুপ্তরহস্য উদ্ধার করে সম্ভব সকল জিনিসের পরিচয় উদঘাটনের মাধ্যমে মানব সাম্রাজ্যের সীমা বাড়ানোর পর আমাদের ভিত্তি স্থাপন সমাপ্ত হবে”।
Descartes পরীক্ষামূলক পদ্ধতির উন্নয়নের ওপর গবেষণা চালান অপরদিকে জ্ঞাত জিনিসের প্রমাণের পরিবর্তে নতুন সত্য আবিষ্কারের জন্যে Francis bacon, এরিষ্টটল ও মধ্যযুগীয় পন্ডিত দার্শনিকদের কর্তৃত্ব সম্পূর্ণ অস্বীকার করে গবেষণা শুরু করেন। Descartes এর মত পশ্চিমা দার্শনিকদের কাছে প্রকৃতি আধ্যাত্মিক বৈশিষ্ট্যবিহীন যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়। মানুষসহ সকল জীবন্ত প্রাণী স্বয়ংক্রিয় রাসায়নিক প্রতিক্রিয়ার ফলশ্রুতি। Descartes দম্ভপূর্ণ উক্তি করে বলেছেন “আমাকে উপাদান দাও আমি বিশ্ব সৃষ্টি করব”।
অপরিবর্তণীয় গাণিতিক আইনে সমগ্র সৌরজগত পরিচালিত হয়, নিউটনের (১৬৪৫-১৭২৭) এই মতবাদে আত্মহারা হয়ে তথাকথিত আলোকপ্রাপ্ত যুগের প্রবক্তারা প্রচার করেছেন, মানুষের অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের বিপরীত সকল বিশ্বাস পরিহার করতে হবে। ভাগ্য, ভবিষ্যৎ বাণী ওহিসহ সকল ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানকে কুসংস্কার বলে ঠাট্টা বিদ্রূপ করা হয়েছে। Valtaire (১৬৯৪-১৭৭৮) বলেছেনঃ পৃথিবীর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোন চিন্তা না করেই ঘড়ি সংযোজন করারীর মত ঈশ্বর পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। Hume (1711-1776) সকল ধর্মীয় বিশ্বাস এই বলে বাতিল করেছেন যে, এগুলো বিজ্ঞান বা মানবীয় প্রজ্ঞার দ্বারা প্রমাণ করা যায় না। তিনি ভলতেয়ারের প্রত্যাদেশ (ওহি) ক্ষমতাহীন ঈশ্বরকে আক্রমণ করে বলেছেনঃ আমরা ঘড়ি বানাতে দেখেছি কিন্তু পৃথিবী বানাতে দেখিনি!
যদি পৃথিবীল কোন মালিক থাকেন, তিনি অনুপযুক্ত কর্মী অথবা কাজ সমাপ্ত করে অনেক আগে মারা গেছেন বা তিনি পুরুষ অথবা মহিলা ঈম্বর বা অনেক সংখ্যক ঈশ্বর আছ। তিনি সম্পূর্ণই ভাল, সম্পূর্ণই খারাপ অথবা দুই বা কোনটাই নন। সম্ভবতঃ তিনি খারাপ। পরকালের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে হিউমের যুক্তি হচ্ছেঃ কোন জীবন সম্পর্কে আমাদের এই সিদ্ধান্ত নেয়ার কোন যুক্তি নেই যে, যেখানে মানুষের ফেলে যাওয়া জীবনের জন্যে পুরস্কার কিংবা শাস্তি দেয়া হবে। গণিত যেমন ধর্মতত্ব ও মানব জ্ঞানের অন্যান্য শাখা থেকে স্বাধীন ঠিক তেমনি নৈতিকতাও একটি বিজ্ঞান। Dideroit এবং রুশোর মত দার্শনিকেরা সম্মত হয়েছেন যে, ব্যবহার এবং সুখই নৈতিকতার একমাত্র মান নির্ণায়ক। সঙ্গীদের ন্যায্য অংশীদারিত্ব থেকে বঞ্চিত না করে মানুষের উচিত যতবেশী সম্ভব আনন্দ ও সুখ প্রত্যাশা করা। কোন সম্পর্কই সকলকে আনন্দ দিতে পারে না, তবে উপকার করতে পারে। পরবর্তী পর্যায়ে তারা লক্ষ্য করেন যে, পুরুষ নারীর চিরাচরিত সততার দাবীর মধ্যে কোন কল্যাণ নেই।
অতীতের সকল বিশ্বাসকে ভ্রান্ত জ্ঞান ও ধ্বংস করে ‘আলোকপ্রাপ্ত’রা বিশ্বাস করলেন যে, সার্বজনীনগণশিক্ষা যে বুদ্ধি বৃত্তি ও বিজ্ঞান প্রচার করেছে তাতে বিশ্বে একটি সত্যিকার স্বর্গ প্রতিষ্ঠিত হবে। নিজের ভাগ্য রূপ দেয়ার বৈজ্ঞানিক যাদু এখন মানুষের করায়ত্বে রয়েছে। সমগ্র বিশ্বে স্বাধীনতা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাম্য এবং সার্বজনীন শান্তি বিরাজ করবে। ক্রমবর্ধমান জ্ঞান মানব জীবনকে দীর্ঘায়িত করবে এবং সকল রোগ ও কষ্ট নিঃশেষ করে দেবে। পরবর্তী শতকের প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক বিপ্লব এই নতুন বিশ্বাসকে বদ্ধমূল করেছে যে, কোন অলৌকিক সাহায্য ছাড়াই বিশ্বের মানব জীবন পরিপূর্ণতা অর্জন করে।
নিম্নস্তরের প্রাণী থেকে বিবর্তনবাদের মাধ্যমৈ মানুষের উৎপত্তি সম্পর্কিত ডারইউনের (১৮০৯-১৮৮২) মতবাদ নৈতিক মূল্যবোধকে নূতন খাতে প্রবাহিত করেছে। দার্শনিকরা এখন চিন্তা শুরু করলেন যে, অবিরাম পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে মানবসমাজ অনিবার্যভাবে আরো উচ্চ এবং জটিল অবস্থায় গিয়ে পৌঁছবে। মানব সমাজে জৈবিক বিবর্তনবাদ প্রয়োগ হওয়ার ফলে এই সমাজ ‘আধুনিক’ ‘অত্যাধুনিক’ অগ্রসরমান এবং প্রগ্রতিশীল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ঐতিহাসিকরা মানুষকে প্রকৃতির সন্তান এবং অংশ হিসেবে দেখতে থাকলো। খুবই নিম্ন পর্যায়ে থেকে বিরুদ্ধ পরিবেশের সঙ্গে মর্মন্তুদ সংগ্রাম করে মানুষ বর্তমান অবস্থায় পৌঁছেছে বলে ধরে নিলাম। ডারউইন পশ্চিমা দার্শনিকদের বুঝালেন যে, মানুষ অন্যান্য পশুর মতই একটি সাধারণ স্তন্যপায়ী প্রজাতি। William James (1843-1910) বিবেক অথবা মনের অস্পষ্ট ধারণার মূল্য সম্পর্কেও প্রশ্ন তুললেন। তার মতে এটি রাসায়নিক প্রতিক্রিয়ার ফল এবং স্নায়ূর ওপর বাইরের চাপের ফলে সব কিছুর সৃষ্টি। মনস্তাত্ববিদ Pavlov (১৮৪৯-১৯৩৬) কুকুর, বানর ও গেরিলার ওপর গবেষণা চালিয়ে মানুষের ব্যবহারের কার্যকারণ নির্ণয়ের চেষ্টা করেছেন।
FREUD (১৮৫৯-১৯৩৯) মানুষের অসংগত ব্যবহারের মূলে আবিষ্কার করলেন শৈশব অবস্থায় অপরিণত মস্তিষ্কের ওপর চাপ। আধুনিক দার্শনিকেরা ধর্মের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্যে আরেকটি হাতিয়ার পেলেন। ফ্রয়েড বললেন ছোট শিশু তার মা বাবার অনুসরণ করল। কারণ তাঁরা তার জীবন দিয়েছেন, কষ্ট থেকে রক্ষা করেছেন, সুশৃংখল থাকতে বাধ্য করেছেন এবং প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর ধর্মীয় আচার আচরণের জন্যে পুরষ্কার ও শাস্তির ভয় দেখালেন। ধর্ম মানুষের তৈরী এবং নৈতিকতা অবিসংবাদিত নয়, বরং আপেক্ষিক এই ধারণা ইতিহাস, সমাজবিদ্যা ও নৃতত্বের ছাত্রদের কাছে খুবই ভাল লাগল।
এই ভাবে বিশিষ্ট মার্কিন নৃতত্ববিদ তার The tree lf culture (১৯৫৩) নামক পুস্তকে বললেনঃ ইহুদীধর্ম ও ইসলামের আপোষহীন একত্ববাদ আরবের যাযাবর উপজাতির পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের ধারণা থেকে উদ্ভুত। তিনি লিখলেনঃ “সর্বশক্তিমান দেবতার ধারণা প্রাচীন আরব জাতির পারিবারিক জীবন থেকে সরাসরি এসেছে। এই দেবতা ন্যায়-অন্যায় করুক পূর্ণ আত্মসমর্পণ ও নিষ্ঠার মাধ্যমে তাকে সন্তুষ্ট করা যায়। প্রতিটি কাজের ব্যাপারে ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞার বেড়াজাল সৃষ্টিকারী অতি স্বাতন্ত্র্যবাদও মুসার (আ) আইন কানুনের সারসংক্ষেপ। ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞার এই বেড়াজালে বিশ্বাসী লোকেরা এমন শিশুর মত হয়েছে যে, শিশু তার বাবার আদেশ নিষেধই মনে রাখতে সক্ষম। ঈশ্বর আরবীয় পরিবারের পিতার প্রতিমূর্তি- যার পিতৃতান্ত্রিক একনায়কত্বের গুণের অতিশয়োক্তি রয়েছে।
ফ্রয়েড ধর্মের ঐশ্বরিক উৎপত্তির কথা অস্বীকার করেই সন্তুষ্ট হননি। বরং ধর্মীয় বিশ্বাস যে কোন দিক থেকে ন্যায়সঙ্গত হতে পারে এই ধারণাও বাতিল করেছেন।
“এটা সত্য নয় যে, বিশ্বের এমন একটি শক্তি আছে যে, প্রত্যেকের ব্যক্তিগত কল্যাণ দেখাশুনা করে এবং তাদেরকে আবার নিজের কাছে ফিরিয়ে নেয়। আদতে মানুষের ভাগ্য সার্বজনীন ন্যায় বিচারের নীতির সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। ভূকম্পন, বন্যা এবং আগুন সৎ ও নিষ্ঠাবান মানুষ এবং পাপী ও অবিশ্বাসীদের মধ্যে পার্থক্য করে না। এমনকি সমস্ত খারাপ লোক ও ভাল লোকগুলোকে পৃথক থাকলেও আমরা কোন অবস্থায় দুষ্ঠদের শাস্তি পেতে এবং গুণীদেরক পুরস্কৃত হতে দেখি না। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় খারাপ ও অসৎ লোকেরা যা চায় তাই পায়। কিন্তু ধার্মিকেরা শূণ্য হাতে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়। মায়ামমতাহীন দাম্ভিক শক্তিই মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করে। ধর্ম যে ঐশ্বরিক ন্যায় বিচারের শাসনের কথা বলে তার কোন অস্তিত্ব আছে বলে মনে হয় না। বিজ্ঞানের প্রাধান্য যতই অস্বীকার করা হোক তাতে প্রকৃতি ও বহিঃর্বিশ্বের উপর আমাদের নির্ভরশীলতা পরিবর্তিত হবে না। অপরদিকে ধর্ম একটি বালকসুলভ মায়া বিভ্রম। আমাদের সহজাত আকাঙ্খাতেই তার শক্তি নিহিত”। (Freud: Great Thinkers of the western World, Encyclopedia Britanica)
কার্ল মার্কসের হাতে বস্তুবাদী দর্শন চূড়ান্ত রূপ পেলো। কার্ল মার্কসের মতে মানব ইতিহাসে সমাজ এবং সংস্কৃতির সবদিকই অর্থনৈতিক কার্যকরণেল ফলশ্রুতি। ব্যক্তি বিশেষ তার চারিদিকের ঘটনাবলীর সৃষ্টি ছাড়া আর কিছুই নয়। বস্তুগত পরিবেশের গতিশীল উন্নয়নের মাধ্যমে একটি পরিপুর্ণ সমাজব্যবস্থা সৃষ্টি হওয়অ অনিবার্য। আজকের পশ্চিমা সভ্যতার পিছনে মার্কসের মতবাদের বিরাট অবদান রয়েছে। মার্কসীয় মতবাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত সেভিয়েত ইউনিয়নেও আগ্রহের সঙ্গে গৃহীত হয়। তবে সোভিয়েত ইউনিয়ন লক্ষ্য সম্পর্কে সৎ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফন্দিবাজ এবং কপটাচারী।
বার্টাণ্ড রাসেল বস্তুবাদী দর্শণ তুঙ্গে পৌঁছিয়ে দেন। তিনি লিখেনঃ “মানুষ কার্যকারণের সৃষ্টি, তার প্রাপ্তির শেষ নেই, তার জন্ম, বৃদ্ধি, আশা, ভয়, ভালবাসা, বিশ্বাস অণুর বিন্যাসের ফলশ্রুতি। কোন প্রকার বীরত্ব চিন্তার গভীরতা এবং আবেগ ব্যক্তি বিশেষকে কবর থেকে দূরে রাখতে পারে না। অর্থাৎ যুগের সকর পরিশ্রম, সকল নিষ্ঠা মানব মনীষার সকল প্রেরণা সৌর জগতের বিশালকায় মৃত্যুর মধ্যে বিলীন হয়ে যেতে বাধ্য। মানুষের সাফল্যের সমগ্র মন্দির বিশ্বের ধ্বংসাবশেষের নীচে অবশ্যই সমাধিস্ত হবে। এসব জিনিস এতই নিশ্চিত যে, তাদেরকে অস্বীকারকারীর কোন দর্শনই টিকে থাকতে পারে না। এ সত্যের মঞ্চে কেবলমাত্র অনমনীয় হতাশার দৃঢ় ভিত্তির দ্বারাই নিরাপদ মানব বসতি গড়ে তোলঅ সম্ভব”। (Makers of Modern Mind, Randall, Columbia University Press, New York 1930)
Schopen Hauer বস্তুবাদী দর্শনের যৌক্তিক সমাধান টানলেন। তার কাছে জীবনের অস্তিত্ব লক্ষ্যহীন, চঞ্চল তৎপরতা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক শক্তি। “সকল আকাঙ্খার মূলে রয়েছে প্রয়োজন, ঘাটতি এবং তা-ই কষ্টকর। মানুষের প্রকৃতি মূলতঃ নিষ্ঠুর এবং তার অস্তিত্ব তাই কষ্টকর হতে বাধ্য। অপরদিকে যে যদি সহজ সন্তুষ্টির সঙ্গে সকল কাঙ্খিত জিনিস লঅভ করে এ ধরনের অসার ক্লান্তিতে তার হৃদয় ভরে গেলে সে হৃদয় তার জন্যে অসহনীয় বোঝা হয়ে পড়ে। এই ভাবে জীবন গোলকের মত কষ্ট থেকে ক্লান্তিতে এবং ক্লান্তি থেকে কষ্টে দোল খেতে থাকে। জীবন শিলা ও আবর্তে পরিপূর্ণ সমুদ্রের মত, মানুষ যা সতর্কতার সঙ্গে পরিহার করে যদিও সে জানে যে সকল প্রচেষ্টা এবং দক্ষতার সঙ্গে প্রবেশ করতে পারলেও সে জাহাজডুবি তথা মৃত্যুর কাছাকাছি পৌঁছায়। প্রতিটি মানুষ এবং তার জীবনে গতি-প্রকৃতির সীমাহীন প্রেরণায় আরেকটি ক্ষনিকের স্বপ্ন মাত্র। বেঁচে থাকার অবিরাম প্রচেষ্টায় মানুষ প্রকৃতির সীমাহীন প্রান্তরে এসে ঠাঁই নেয়। প্রকৃতিও ক্ষণিকৈর জন্য আশ্রয় দিয়ে আবার সীমাহীন অতলান্তে বিলীন করে দেয়”। (Makers of the Modern Mind)
ধর্ম বিশ্বাসের বাস্তব মূল্য অস্বীকার করে ফ্রয়েডকে স্বীকার করতে হয়েছে যে, বিজ্ঞান বিকল্প নয়। “বাস্তব জগতের ওপর গুরুত্ব ছাড়া বিজ্ঞান অবশ্যই নেতিবাচক বক্তব্য দেয়। তার সীমা স্পর্শনীয় বস্তুগত সত্য এবং মায়াকে সে অস্বীকার করে। আমাদের অনুসারীদের যারা এ ধরনের কার্যাবলীতে অসন্তুষ্ট এবং ক্ষণেক শান্তির জন্য আরো অধিক আকাঙ্খা করেন তারা যেখানে তা পাবেন সেখানে খোঁজ করতে পারেন। কিন্তু আমরা তাদের সাহায্য করতে পারি না”। (Encyclopedia Britanica)
“বর্তমান জীবনের কষ্ট, ক্ষুধা, যন্ত্রণা, বার্ধক্য, মৃত্যু এবং ক্ষত স্পষ্ট হয়েছে অথবা সম্ভবতঃ আগের চাইতে একটু বেশী করে অনুভূত হয়েছে দু’টি বিশ্বযুদ্ধের দ্বারা। কবি ও উপন্যাসিকসহ বস্তুবাদী চিন্তাবিদদের খোদার বিরুদ্ধে বাদানুবাদের মূল বিষয়ও এটি। তারা তার করুণাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন এবং ধর্মতত্ত্ববিদদের পরামর্শ দিয়েছেন প্রতি ফোটা অশ্রুর জন্যে পুরষ্কারের অঙ্গীকার করে মানব মনীষার সঙ্গে তামাসা না করতে। কারণ কাগজের নোটের নগদ বিনিময় মূল্যের নিশ্চয়তা না থাকলে তা স্রেফ ধোকা।
এই উচ্ছ বাচ্যের মূল হচ্ছে জীবনের অমরত্বে অবিশ্বাস। আমরা যদি এখন ব্যর্থ হই, আমরা চিরদিন ব্যর্থ হবো কারণ কোন অতীতই ফিরে আসে না। যদি আমরা এ জীবন হারাই আমরা সব কিছুই হারালাম কারণ এটাই প্রথম এবং শেষ সুযোগ। মৃত্যু আসার সঙ্গে সঙ্গেই আশা-আকাঙ্খা, বিপদ, ভয়, পরিকল্পনা ও প্রচেষ্টা হঠাৎ থেমে যায়। জীবনের এই সীমিত ধারণা নিয়ে এটাই স্বাভাবিক যে, আমাদের দুঃখ কষ্টের হিসাব করব এবং অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার কামনা করব এবং ভাববো আমরা যে সব অন্যায় আচরণের শিকার সবই আমাদের নিজেদের তৈরী”।
অন্যায় আচারণ সম্ভবতঃ কোনদিন সম্পূর্ণ শেষ হবে না। এসব থাকতে এসছে। খোদা সবাইকে মোহাম্মদ আলীর (মুষ্ঠিযোদ্ধা) মত স্বাস্থ্য, রকে ফেলারের মত ধন এবং বার্টাণ্ড রাসেলের মত বুদ্ধিমত্তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেননি। তিনি অভবা, দারিদ্র রোগ এবং বার্ধক্যের জন্যে সার্বজনীন বীমা পরিকল্পনার কথাও ঘোষণা করেননি। বিজ্ঞানীরা আমাদের ওয়াদা দিতে পারেন যে, এই শতক শেষ হওয়ার আগে প্রত্যেক ব্যক্তির শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাড়ী এবং গাড়ী থাকবে। তপ্ত সূর্যের নীচে কিভাবে ঘামাতে হয় অথবা শীতের রাতে কি ভাবে কাঁপতে হয় আমরা জানবো না। আমাদের ক্ষুদ্রতম ব্যক্তিও আরামদায়ক কাজ পাবে, মনোমুগ্ধকর ও প্রচুর বেতন পাবে এবং একই সঙ্গে যুগের শিল্পকলা ও সংস্কৃতি উপভোদ করার মত অখণ্ড অবসর পাবে। এধরনের স্বপ্ন যদি সত্যি হয় তাহলে মানবতার জন্যে সেটি দুর্ভার্গের দিন হবে।
আমরা পৃথিবীকে এসেছি কাজ করতে, সংগ্রাম করতে, আমাদের দুঃখ ও উৎকষ্ঠার শরীক হতে এবং পৃথিবীর কল্যাণে অবদান রাখতে, আধ্যাত্মিক শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে, অত্যাচার এবং অবিচার, হিংসা, ঘৃণা লাঘব বা নিমূর্ল করতে। এটি একটি বিরাট কাজ সম্ভবতঃ আমরা তা শেষ করতে পারবো না। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। আমাদের চেষ্টার দ্বারা আমরা ব্যক্তিগতভাবে আল্লাহর দৃষ্টিতে কতটা লাভবান হলাম সেটাই আমাদের দেখার বিষয়। বাকীটুকু দেখা আল্লাহর নিজের দায়িত্ব। কেবলমাত্র এই ধরনের আশা ও প্রচেষ্টার দ্বারা পৃথীবীদে আমাদের জীবন, কাজ এবং মৃত্যু কামনা করা উচিত। [S. Ahmad, Back to God v. Yaqeen Intermational, Karachi April 22, 1967.]