আধুনিক দর্শন-এর বৈশিষ্ট্য ও পরিণতি
আধুনিকতা, ধর্ম এবং তার সকল আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে একটা প্রচণ্ড বিদ্রোহ। ইউরোপীয় রেনেসাঁ বিশেষ করে মেকিয়াভেলির নীতিজ্ঞানশূণ্য রাজনৈতিক দর্শনে এই বিদ্রোহের বীজ অঙ্কুরিত হয়। ১৮ শতকের আলোকপ্রাপ্ত ফরাসী দার্শনিকের হাতে এর পূর্ণ বিকাশ ঘটে এবং ১৯ শতকের ইউরোপ ডারউইন, মার্কস এবং ফ্রয়েডের হাতে তা সর্বোচ্চ সীমা প্রাপ্ত হয়। পশ্চিম ইউরোপের জন্মস্থান থেকে এই দুষ্ট ক্ষত বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে হামলা চালিয়ে দেশীয় সংস্কৃতি ধ্বংস করেছে। বস্তুতঃ এটা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, আধুনিকতা সর্বব্যপী এবং সার্বজনীন বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে। যারাই এতে বিশ্বাস স্থাপন করেছে তাদেরকে আলোকপ্রাপ্ত এবং প্রগ্রতিশীল বলে অভিনন্দিত করা হয়েছে অপর দিকে যারা অনীহা দেখিয়েছে তাদেরকে অনগ্রসর, মধ্যযুগীয় এবং প্রতিক্রিয়াশীল হিসেবে কোণঠাসা করা হয়েছে। এই কারণেই এশিয়া ও আফ্রিকার নেতারা স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পর আধুনিকতার প্রতি এতই অন্ধ বিশ্বাস স্থাপন করেছে যে প্রকারান্তরে তারা তাদের উপনিবেশিক শাসকদেরও হার মানিয়েছে।
আধুনিকতা কম্যুনিজম, সমাজতন্ত্র, পুঁজিবাদ, প্রয়োগবাদ, প্রত্যক্ষবাদ, ফ্যাসিবাদ, নাৎসীবাদ, ইহুদীবাদ, কামালবাদ এবং আরব জাতীয়তাবাদের ছদ্মাবরণে আবির্ভূত হয়েছে। অবশ্য এইসব আধুনিক মতাদর্শের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব এবং ঘৃণা সত্ত্বেও নিবিষ্ট পর্যবেক্ষণে দেখা যাবে তারা একই গাছের বিভিন্ন শাখা মাত্র।
আধুনিকতার মূল বক্তব্য পরকালকে অস্বীকার করা। পরকালকে অস্বীকার করার ফলে অনিবার্যভাবে এই সিদ্ধান্তে আসে যে, দৈহিক আরাম আয়েশ, বস্তুগত সমৃদ্ধি, পার্থিব সাফল্য এবং ব্যক্তিগত সুখই জীবনের লাভজনক লক্ষ্য। মানুষের কাজের জন্যে আল্লাহর কাছে জবাবদিহীর কথা অস্বীকার এবং ন্যায়ই শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হবে এই বিশ্বাস ধ্বংস করে নৈতিকতার ওপর মরণাঘাত হেনেছে।
সকল আধুনিক মতাদর্শের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে মানব পূজা। কোন কোন সময় বিজ্ঞানের ছদ্মাবরণে মানব পূজা চলে। আধুনিকতাবাদীরা জানেন বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের অগ্রগতি পর্যায়ক্রমে তাদেরকে ঐশ্বরিক শক্তির অধিকারী করবে। মানব পূজার আরেকটি ধরন হচ্ছে জাতীয়তাবাদ। জাতয়িতাবাদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বিদেশী ও সংখ্যালঘুদের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করে নিজের বিশেষ দলের পূজা। নাৎসী জার্মানীতে ইহুদী হত্যা, ইসরাঈলে আরব হত্যা, ভারতে মুসলমান হত্যা এবং অতি সম্প্রতি সাইপ্রাসে তুর্কী হত্যার ঘটনায় এর প্রমাণ মিলে। জাতীয়তাবাদ সর্ব শক্তির অধিকারী ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের প্রতি চূড়ান্ত আনুগত্য দাবী করে। রাজনৈতিক নেতারা দেবতায় পরিণত হয়। তাদের ছবি এবং মূর্তি সর্বত্র জনসমক্ষে রাখা হয়। নাৎসী সৈন্যরা বক্ষে তাদের ছবি এবং মূর্তি সর্বত্র জনসমক্ষে রাখা হয়। নাৎসী সৈন্যরা বক্ষে হিটলারের ছবি রাখতো এবং যদি তারা আহত অথবা হাসপাতালে মারা যেতো তাদেরকে এ ছবি চুম্বন এবং চোখের ওপর রাখতে দেখা যেতো।
রাশিয়ায় প্রায় সাড়ে চার দশক ধরে একটি কাঁচের পাত্রে লেনিনের মরদেহ বিশেষভাবে সংরক্ষণ করা হয়। মস্কোর রেডস্কোয়ারস্থ তার সমাধি জাতীয় মাজার, শীতকালে এক নজর দেখার জন্যে মানুষ সেখানে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকে। লেনিনের সমাধি পরিদর্শনকারীরা সেখানে গীর্জার মত পরিবেশ দেখতে পান। ষ্টালিনের মৃত্যুর পর তার মরদেহও একই কায়দায় কাঁচের পাত্রে যত্ন সহকারে সংরক্ষণ করা হয়েছে। ক্রুশ্চেভ তাকে অসঈকার কার পর একই সঙ্গে সকল গুরুত্বপূর্ণ জায়গা থেকে তার ছবি ও মূর্তি অপসারণ করা হয়েছে। চীনের কম্যুনিষ্ট শাসনের অধিনেও মাও সেতুংকে ঈশ্বরের মত পূজা করা হচ্ছে এবং ভবিষ্যৎ বংশধরদেরকে তার লিখা বইকে ধর্মীয় গ্রন্হের মর্যাদা দিতে শেখানো হচ্ছে।
রেলের কামরা, সরকারী বাস, রেস্তোঁরা, রাস্তার মোড়, রাস্তার পার্শ্বের পায়ে চলার পথ, বিমান বন্দরে যাত্রীদের বসার স্থান অথবা আকাশে উড্ডয়নরত বিমান যাই-ই হোক না কেন সব জায়গায় রেডগার্ডরা রয়েছে এবং মাও-এর বাণী নিয়ে গান, আবৃত্তি ও নাচানাচি করছে। চীনের বাণিজ্যিক বিমান পরিবহনে চকলেট, চা এবং সিগারেট দেয়ার পর পরই যুবতী বিমানবালারা সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে লাল বই বের করে মাও-এর বাছাইকৃত অংশগুলো পড়তে থাকে। যাত্রীরা শুনতে আগ্রহ প্রকাশ করুক আর নাই-ই করুক এরপর তারা কোরাস গাইতে থাকে। এই ‘পবিত্র অনুষ্ঠান শেষ হলে বিমান বালারা নেচে নেচে গান শুরু করে। বিমান বন্দরে অবতরণ পর্যন্ত এ নাচ গান চলতে থাকে। সমগ্র চীনের ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এই অনুষ্ঠান চলে। [সাংস্কৃতিক বিল্পব।“ Chinas new Generation Taking over” Qudratullah Shahab, The Pakistan Times, Lahore, October-1, 1967.]
কোন ব্যতিক্রম ছাড়া সকল আধুনিক মতাদর্শ অতীন্দ্রিয় মূল্যবোধকে অস্বীকার করে। অপর কথায় সত্য নির্ণয়ের কোন চূড়ান্ত মাপকাঠি নেই। বরং সততা, নৈতিক মূল্যবোধ আপেক্ষিক বিষয়। সময় স্থান ও অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের যথার্থতা সীমিত। ‘ওহি’ ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থাকে আধুনিকতাবাদীরা গতিহীন এবং অসার বলে অভিহিত করেছেন। পরিবর্তনই একটা গুণ এবং যত তাড়াতাড়ি পরিবর্তন হয় ততই ভাল। আধুনিকতাবাদের চূড়ান্ত গুণ হচ্ছে ‘আধুনিক’ মহিলাদের পোশাকের ক্ষেত্রে সর্বশেষ ফেশান, সর্বাধুনিক মডেলের গাড়ী এবং নাচের সর্বাধুনিক মুদ্রাকে সবকিছুর উর্ধে স্থান দেয়া হয়।
আধুনিক মতাদর্শের অপর প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে পারিবারিক বন্ধন ও জীবনকে যতদূর সম্ভব শিথিল করা। কার্ল মার্কস নিজেও তার কমিউনিষ্ট ঘোষণা পত্রে (১৮৪৮) পারিবারিক জীবন পুরোপুরি শেষ করে দেয়ার ওকালতি করেছেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও কম্যুনিষ্ট চীন এই লক্ষ্য সাফল্য জনকভাবে অর্জন করেছে। অকম্যুনিষ্ট দেশে সুক্ষ্মভাবে এই প্রচেষ্টা চলছে, তবে কার্যকর হচ্ছে না। পরিবারের বিরুদ্ধে প্রধান হাতিয়ার ১। শিল্পায়ন ২। শহর কেন্দ্রিক জীবন ৩। নারী মুক্তি।
বস্তুতঃ তিনটি ব্যাপার একই সঙ্গে চলতে থাকে। আধুনিক শিল্পায়ন ব্যবস্থা উচ্চ বেতন ও অন্যান্য সুবিধার প্রলোভন দেখিয়ে বিরাট সংখ্যক সুস্থ সবল লোককে পরিবার ও গ্রামের সুসংহক সমাজ বন্ধন থেকে টেনে বিরাট শহরের অজ্ঞাত পরিবেশে নিক্ষেপ করে। এই ভাবে কোন কোন ক্ষেত্রে পরিবার ভেঙ্গে যায় এবং পৃথক হয়ে যায়। শিল্পোন্নয়নের ফলে পরিবার আত্মনির্ভর অর্থনৈতিক ইউনিট থাকতে পারে না। এর ফলে পিতা তার জীবনের অধিকাংশ সময় বাড়ী এবং স্ত্রী থেকে দূরে থাকেন। ফলে স্ত্রীও সংসারের প্রতি বিরাগভাজন হয়ে অন্যদিকে আসক্ত হয়ে পড়েন। যদিও শিশুসদন, কিন্ডার গার্টেন এবং স্কুলগুঅের সংখ্যা ক্রমাগত বর্ধিত হারে ছেলের অভিভাবকত্ব গ্রহণ করে তবুও বিরাট সংখ্যক শিশু নিজের খেয়ালখুশিতে অযত্নে রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ায়। এই পরিস্থিতিতে যুব অপরাধ মহামারী আকারে দেখা দেয়া অসঙ্গত নয়।
“আমাদের যুগের যুবক যুবতীরা দুর্দশার সঙ্কেত দিচ্ছে। তারা চায় আমরা তাদের সংকট অনুধাবন করি। যুব সংকটের প্রধান গতিগুলো নিম্নরূপ: ১। অভূতপূর্ব অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে সমাজবিরোধী আচরণ প্রবণতা ২। যৌন আচরনেল বিশৃংখলা এবং বিকৃতি ৩। সবকিছুতে উত্তপ্তভাব এবং সর্বত্র এর সংক্রমন ও নতুন যে কোন কিছুর প্রতি অদম্য আগ্রহ ৪। পরিবারের প্রতি অতিরিক্ত ঝোঁক, সঙ্গীদের সাহচর্যের ঝোঁক, দুঃসাহস হারানো এবং সৃষ্টিশীল ক্ষমতা হ্রাস ৫। বর্জনের আগ্রহ, আশা ও বিশ্বাস হারানো, মোহমুক্তি এবং আদর্শের গিতশীলতা নষ্টজনিত হতাশা ৬। পরিবার ও সমাজের লক্ষ্যের সঙ্গে নিজের লক্ষ্যের সমন্বয় সাধনে ব্যর্থতা, পশ্চাৎগামিতা, অপ্রতিভ অবস্থা, নিজের পরিচয় খণ্ডিতকরণ এবং সবশেষে সামাজিক সম্মিলনে নিদারুণ বিশৃংখলা ও অরক্ষিত যুব মানসের আবেগময় পতন মানসিক অসুস্থতা। [Adolscent struggle as protest, nathan W ackerman, The voice of America forum lectures: The family series No. 6. Washingtion Dc. 1971.]
এতে কোন সন্দেহ নেই যে, নারী মুক্তি সকলের জন্যে শক্তিশালী এবং অপরিহার্য হাতিয়ার প্রমাণিত হয়েছে। যতদূর সম্ভব গৃহকর্তী এবং মাতৃত্বকে আকর্ষণহীন, অসন্তুষ্ট ও অহেতুক প্রমাণিত করে মহিলাদেরকে বাড়ী থেকে বাহিরে আসতে প্রলুব্ধ করা হয়েছে। গণসংযোগ মাধ্যমগুলোতে চিরাচরিত নারীর ভূমিকা ছোট করে দেখানো এবং পুরুষের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ মহিলাদের কাজকে আকর্ষণীয় প্রমাণিত করে এই কাজ করা হয়েছে। যে স্ত্রী তার স্বামীর কাছ থেকে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেচে সে পরিবার প্রধান হিসেবে স্বামীর কর্তৃত্ব নষ্ট করেছে। একইভাবে যে পরিবারে মা কর্তৃত্ব করে সে পরিবারের সন্তান পিতার ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলে।
ক্রমবর্ধমান অবৈধ যৌন স্বাধীনতাই সব চাইতে ক্ষতি সাধন করেছে। নারীর দেহকে বাণিজ্যিক রূপ দেয়ার কোন প্রচেষ্টাই বাকী রাখা হয়নি। অবিবাহিত মহিলাদের গর্ভধারণের সংখ্যা বৃদ্ধি, অবৈধ সন্তান, গর্ভপাত, তালাক, যৌন অপরাধ এবং যৌন ব্যাধি থেকেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়। আধুনিকতায় আচ্ছন্ন দেশগুলোতে বহুবিবাহ ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ এবং এজন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। অপরদিকে যৌন সম্পর্কের জন্য কোন আইনগত শাস্তির বিধান নেই বরং এটাকে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে বিবেচনা করা হয়।
আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় পারিবারিক জীবনের প্রতি শ্রদ্ধার অভাব থেকে বয়স্কদের জন্যে আশ্রয়হীনতার পথ প্রশস্ত হয়। জাতীয়তাবাদে আচ্ছন্ন দেশগুলোতে বিশেষ যুব উৎসব, খেলাধুলা, সামরিক কুচকাওয়াজ এবং রাজনৈতিক বিক্ষোভকে যুবক যুবতীদের গৌরবের বিষয় মনে করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিম ইউরোপে সুন্দরী প্রতিযোগিতা ও গণসংযোগ মাধ্যমগুলোতে যৌন আকর্ষন বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব আরোপ করে যৌবনের পূজা করা হয়। কম্যুনিষ্ট অথবা অকম্যুনিষ্ট যে দেশই হোক আধুনিকতায় আচ্ছন্ন হলে সেখানে বৃদ্ধদের সামাজিক মর্যাদা খুবই নীচ। বয়স্কদের প্রাচীন ও যুগের অনুপযোগী ভাবার শিক্ষা দিয়ে বিভিন্ন বয়সের লোকদের দ্বন্দ্ব প্রকটিত করা হয়।
আধুনিক যুবকেরা বয়স্কদের প্রতি দায়িত্ব থকে অব্যাহতিকে নিজেদেরসুখ স্বাচ্ছন্দের জন্যে অপরিহার্য মনে করে। যারা অভিভাবকদের যত্ন করে তারা এটা অসহ্য বোঝা মনে করে। পর্যায়ক্রমে নার্সিং হোম অথবা হাসপাতালে রুগ্ন এবং অক্ষম বৃদ্ধদের জীবনকে অপ্রয়োজনীয় এবং সামাজিক দায় বলে মনে করা হয়। বরস্ক লোকেরা নিজেদের বয়সের জন্যে লজ্জা অনুভব করা এবং যতদূর সম্ভব যৌবনকে ধরে রাখার চেষ্টা করা বিস্ময়কর কিছু নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মহিলারা চুলে কলপ দেয়া, প্রসাধন এবং দেহের স্থুলত্ব কমাবার জন্যে কল্পনাতীত অঙ্কের অর্থ ব্যয় করেন। পঞ্চাশ বছরের মহিলা বিশ বছরের যুবতীর দৈহিক গঠন না থাকায় নিজেকে অপরাধী মনে করে।
আজকের যুবকেরা জীবনের ভাল জিনিস থেকে বঞ্চিত হওয়ার ভয় করে। তারা বার্ধক্য এবং মৃত্যুর ভয়ে আতংকগ্রস্ত। তারা যৌবনের হালকা চাকচিক্যকে ধরে রাখতে চায়। তারা নিজেদেরকে বাহ্যিক দিক থেকে যুবক এবং আকর্ষনীয় রাখার জন্যে স্বর্গমর্ত ঘুরে মরে। তারা কাপড়, খাওয়া এবং প্রসাধনীতে মাতোয়ারা থাকে। তারা এই মশগুলভাবকে হাস্যাস্পদ পর্যায়ে নিয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় মহিলারা সাজগোছ, চুলে কলপ, পরচুলা পরা এবং মুখকে নতুনরূপ দেয়ার জন্যে ঘন্টার পর ঘন্টা ব্যয় করেন। যৌবনকে ধরে রাখার প্রচেষ্টা এমন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে যে মা মেয়ের সম্পর্কের ক্ষেত্রে মেয়েরা চীৎকার করে বলে ‘আমি আমার মাকে মায়ের মত দেখতে চাই, বোনের মত নয়’। অপরিপক্কতার গুণ শুধুমাত্র কৈশোর পর্যায়ে নয় বরং মধ্যবয়স পর্যন্ত প্রসারিত করে। আত্মকেন্দ্রিক এই প্রতিযোগিতা মানুষকে তার পরিবার, পরিবেশ এবং আত্মীয়স্বজন থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে এমন এক পরিবেশের সৃষ্টি করে যাতে পৃথিবীটা এক জঙ্গলে পরিণত হয় এবং প্রত্যেকটা মানুষ তার নিজের জন্যই সৃষ্ট হয়েছে এই ধারণা জোরদার হয়। এই সুবিধাবাদী মনোভাব মানুষকে নিঃসঙ্গ, যান্ত্রিক এবং মানসিক গুণবর্জিত করে তোলে। ব্যবসায়িক দুনিয়ার মত পরিবারিক জীবনও লাভ লোকসানের মাপকাটিতে বিচার করা হয়। অর্থ এবং প্রতিপত্তিকেই প্রভু বানানো হয়। মানুষকে বস্তু হিসেবে ব্যবহার করা হয়। মানবিক সম্পর্ক মানবেতর পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে। অপর পর্যায়ে প্রকৃত জিনিসের স্থলে বাহ্যিক আবরণকে মূল্য দেয়া হয়। তুমি কে সেটা নয় বরং তোমার চেহারা কেমন সেটাই বিচার করা হয়। মানুষের সম্পর্ক পোষাক এবং প্রসাধনের দ্বারাই নির্ণিত হয়। ক্ষমতা এবং প্রভুত্বের লক্ষ্য অস্বাভাবিক গুরুত্ব লাভ করে, পারিবারিক স্নেহ-প্রীতি, একতা, আনুগত্য, অংশীদারিত্ব, সহযোগিতা তার পদতলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। [Adolescen struggle as protest, Nathan, W. Ackerman op cit. pp 8-9.]
আধুনিকতার সবচেয়ে বড় গলদ হচ্ছে মানব জীবনের ব্যাপক ধারণা লাভে ব্যর্থতা। উদাহরণ হিসেবে নেয়া যায় ফ্রয়েডের মতে মানুষের স্বাস্থ্য এবং সুখ অবাধ যৌনজীবনের ওপর নির্ভরশীল, অপরদিকে মার্ক্সের মতে অর্থনীতিই মানুষের অস্তিত্বের কেন্দ্রবিন্দু। সকল আধুনিকতাবাদীই চরম একমুখী মনোভাবের অধিকারী ছিলেন। মানব জীবনের একটি দিক যৌন অথবা আর্থিক যাই-ই হোক না কেন তাকে সমগ্র মানব সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন জ্ঞান করে ভেদ বুদ্ধিহীনভাবে অহেতুক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অপর কথায় বলা যায় জীবনের একটিমাত্র অংশকে সমগ্র জীবন মনে করে ভুল করা হয়েছে।
পশ্চিমী সভ্যতার এই দুর্ভাগ্য আকস্মিক বা মানুষের দুর্বলতার কারণে নয়। মানুষ মহৎ নীতি নিয়ে বাস করতে ব্যর্থ হয়েছে। মহৎ নীতিগুলো নিজেরাই অসম্পুর্ণ। পশ্চিমা সভ্যতা, মতবাদ এবং বাস্তবতা দু’দিকে থেকে অনিষ্টকর। পশ্চিমা সভ্যতার এই দুর্ভাগ্য আকস্মিক বা মানুষের দুর্বলতার কারনে নয়। মানুষ মহৎ নীতি নিয়ে বাস করতে ব্যর্থ হয়েছে। মহৎ নীতিগুলো নিজেরাই অসম্পূর্ণ। পশ্চিমা সভ্যতা, মতবাদ এবং বাস্তবতা দু’দিক থেকে অনিষ্টকর। পশ্চিমা সভ্যতার পথ নির্দেশক দর্শনসমূহও এই দোষে দুষ্ট। ফলে সমগ্র ব্যবস্থাও এর প্রভাবমুক্ত নয়। কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন যে, পশ্চিমা সভ্যতা অনেক ক্ষেত্রেই মহত্ব অর্জন করেছে। অবশ্য এটা স্মরণ রাখতে হবে যে, সত্যের আবরণেই মিথ্যা সব সময় অগ্রসর হয়। এখনো তার প্রকৃতরূপ ধরা পড়লে তা সম্পূর্ণই অন্ধকার মনে হবে।