আধুনিকতার গলদ

আধুনিকতার গলদ

মুসলমান জনসমাজে আধুনিকতাবাদী বলতে এমন লোককে বোঝায়, সে হযরত মোহাম্মদ (সা) থেকে আগত এবং সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত ইসলামের প্রতি বিরাগভাজন এবং ইসলাম ও পশ্চিমা সভ্যতার কোন দ্বন্দ্ব নেই বলে প্রমাণে সচেষ্ট হন। নামে মুসলমান হলেও আধুনিকতাবাদী ইউরোপীয় ধ্যান ধারণার আলোকে ইসলামকে বিচার করেন। ইউরোপীয় ধ্যান-ধারণা জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে তার মনের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে থাকে। ইসলামের যা কিছুই ইউরোপীয় আদশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন তাই বাতিল করার পক্ষে তিনি ওকালীত করেন।

“আমরা জানি আন্তর্জাতিক জগৎ, বিশেষ করে পশ্চিমা খৃষ্টীয় জগত আমাদের দেশে কি ঘটতে যাচ্ছে তা দেখার জন্য উৎকষ্টা নিয়ে প্রতীক্ষা করছে। আমরা এখন রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করেছি। তাদের বিরাট ভয়; বেঈমানদের বিরুদ্ধে জেহাদ পুনঃপ্রচলন ও ইসলামী ভ্রাতৃত্বের সম্ভাবনাসহ ইসলামী দেশসমূহে আল্লাহতন্ত্র চালূ হবে। যদি আমরা একদিকে পশ্চিমাদেরকে আশ্বাস দেই যে আমরা তাদের বিপদের কারণ হবো না অপর দিকে আমরা দেশে কি করব সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট বক্তব্য রাখতে হবে। [Philososphy and Ideology, Hazi Agus Salim, Former Foreign Minister of Indonesia, The light organ of the Ahmedia movement, Lahore, September 8, 1967.] আমাদেরকে বিশ্বের অন্যান্য দেশের পাশাপাশি অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির জন্যে দেশে পশ্চিমা সভ্যতাকে প্রচলন করতে হবে।

শেখ মোহাম্মদ আবদুহুর শিষ্য এবং কায়রোর আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের রেকটর (১৯২৭-২৯/১৯৩৫-৪৫) মোস্তফা আল-মারাগী কতিপয় আমেরিকান মুসলমানদের জন্যে দেয়া এক বার্তায় আধুনিকতাবাদীদের আদশ্য মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন,

“এইসব লোক ইসলাম সম্পর্কে পুঁথিগত বিদ্যা অর্জন করেছেন। আমি আশা করি তারা কখনো ইসলামী দেশ সফর করবেন না এবং আমরা যে কার্পণ্য, অজ্ঞতা, একগুয়ে এবং অনগ্রসরতা প্রদর্শন করি তা দেখতে পাবেন না”। [Quoted from “The Re-Evaluation of Islam in Turkey” Fareed S. Jafri, The pakistan times, Lahore, 1967.]

কানাডীয় একজন মুসলমান একই পুস্তকের সমালোচনা করতে গিয়ে আমার কাছে যে চিঠি লিখেছেন তাতেও একই মনোভাব প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি লিখেছেন, “আল্লাহ আমাকে একজন ককেশীয়, একজন কানাডীয়, বিশ শতকের একজন মানুষ হিসাবে তৈরী করেছেন এবং তিনি আমাকে মুসলমানও করেছেন। যদি আমি কালো, অপরিচ্ছন্ন, অশিক্ষিত বেদুঈন হতাম, যারা তাদের পূর্ব পুরুষের ন্যায় বসবাস করে তাহলে মরে যেতাম। যদি ইসলাম পরিপূর্ণভাবে অমুসলিম দেশে টিকে থাকার অযোগ্য হতো, যদি একজন মুসলমান পশ্চিমা হতে না পারতো, আধুনিক অথবা পশ্চিমা আধুনিকতা গ্রহণ করতে না পারতো খৃষ্টীয় পরিবেশে উন্নতি করতে না পারতো তাহলে এই ধর্ম মরুভূমির বাসিন্দাদের জন্যেই উপযুক্ত হতো- যেখান থেকে তার আবির্ভাব ঘটেছে”।

আধুনিকতাবাদীরা শুধু জোরের সঙ্গে নিজেদের মুসলমানিত্ব প্রচার করেই ক্ষ্যান্ত হয় না উপরন্তু নিজেদেরকেই সর্বোত্তম এবং সত্যিকার মুসলমান বলে দাবী করে। তাদের বিরোধিতাকারীদের প্রতিক্রিয়াশীল একগুয়ে অথবা অসংস্কৃত বলে আখ্যায়িত করে। তাদের মধ্যকার আদর্শবাদী এবং উচ্চমনারা বিভ্রান্তি প্রচার করে বেড়ান যে, ধর্মনিরপেক্ষতা ও আধুনিকতার আলোকে ইসলামের ব্যাখ্যা করে কেবলমাত্র তারাই একে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেন। জীবন সম্পর্কে দুটি বিরোধী দর্শনের দুঃখজনক সংঘর্ষের সমাধান করতে গিয়ে তারা অসামঞ্জস্যকে সামঞ্জস্যপূর্ণ ধরে আত্মপ্রবঞ্চনায় অস্বাভাবিক মাত্রায় মেতে উঠেন। পাঠকদের আধুনিকতাবাদীদের সম্পর্কে কিছু ধারণা দেয়ার জন্য ইসলামের ইতিহাসের বহুল অপব্যাখ্যার কিছু নজির তুলে ধরা হলো।

১। আধুনিকতাবাদীদের মতে আমাদের মহানবী ও খেলাফতের সময় ইসলাম ছিল খুবই উদার, প্রগতিশীল এবং যুক্তিনির্ভর ধর্ম। কিন্তু আমাদের ইমাম, কাজী, ঐতিহ্যবাদী ও ধর্মতত্ববিদদের হাতে ইসলাম সেকেল অযৌক্তিক, সংকীর্ণ, অচল ও প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে পড়েছে, যা আমাদের বর্তমান দুর্বলতা এবং অবমাননার জন্যে দায়ী। এই দৃষ্টিকোণ থেকে আধুনিকতাবাদীরা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, মুসলিম বিশ্বের সকল অনিষ্টের মূলে রয়েছে উলেমা এবং ধর্মীয় পন্ডিতেরা। তাদের একজন লিখেছেন, “সৌদী আরব থেকে মৌরিতানিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া থেকে পাকিস্তান পর্যন্ত প্রতিটি মুসলিম দেশের জনগণ আজ শুধু মাত্র বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছে। মোল্লারা এই অবনতির জন্যে পশ্চিমা প্রভাবকে দায়ী করবেন। তারা ভুলে যান যে, যে সব যায়গায় এখনও পশ্চিমা প্রভাব পড়েনি সেখানেও ইসলামের করুণ অবস্থা দৃষ্টি গোচর হয়। তারা কি এই সত্য অস্বীকার করতে পারবেন যে, পশ্চিমা প্রভাব যেখানে যায়নি সেগুলোই হচ্ছে সব চাইতে খারাপ এবং পশ্চাৎপদ এলাকা।

অপরদিকে সেখানে শতাব্দী ধরে মোল্লারা ধর্মীয় কর্তৃত্বের অপব্যবহার করে আসছে। এটা তাদের জন্যেই হয়েছে যারা সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে ইসলামকে অবাধে মিশে যেতে না দিয়ে নিশ্চল করে রেখেছে। মুসলিম বিশ্বের সকল দুযোর্গ থেকে মুক্তির জন্যে আমাদেরকে যুক্তি মানেন না এমন লোকদের দেয়া কোরআনিক ব্যাখ্যা ভুলে যেতে হবে। যখন আমরা নিজেরা কোরআন বুঝতে চেষ্টা করব, তখন আমরা ইসলামকে রক্ষা করতে পারব, আমাদের নারীদেরকে ১৪শ’ বছরের অবমাননা থেকে রক্ষঅ করতে পারব এবং আমরা তাদেরকে স্বাধীনতা ও সাম্যের রাজপথে দাঁড় করাতে পারব। প্রেমের দ্বারা ধর্মের অনুশীলন চলবে, জোর করে নয়। জীবন একঘেয়েমী মুক্ত হবে, প্রার্থনার সঙ্গে খেলাধূলাও চলবে এবং আমরা স্বচ্ছ হীরার ন্যায় ইসলামের মর্মাথ উপলব্ধি করব। [The need for Re-Evalution of Islam in pakistan, Fareed S. Jafri. Pakistan times, Lahore, August 11, 1967.]

অপর কথায় আমাদের প্রিয় নবীর জীবদ্দশা থেকে এখন পর্যন্ত মুসলমানরা ইসলামের সম্পুর্ণ ভুল ব্যাখ্যঅ করছেন। কেবলমাত্র তখনকার পশ্চিমা সভ্যতায় প্রভাবিক আধুনিকরা সত্যিকার অর্থে ইসলামের সঠিক জ্ঞান লাভ করেছেন। বোখারী, মুসলিম, আবু হানিফা, শাফেয়ী, মালিক, আহামদ ইবনে হাম্বল, আল-গাজ্জালী এবং ইমাম ইবনে তাইমিয়ার মত যুক্তিহীন পন্ডিতেরা সবাই ভুল করেছেন এবং যতদিন মুসলমানেরা এদেরকে শ্রদ্ধা করার পরিবর্তে মেস্তফা কামাল আতাতুর্কের মত লোককে শ্রদ্ধা করতে না শিকে ততদিন আমাদের মুক্তি নেই।

২। আধুনিক জীবনের সঙ্গে সংঘাতময় ইসলামের এমন সব চিরন্তন নীতি ও আইন কানুন পৃথক করে নিতে হবে। এগুলো নবীর যুগের প্রাথমিক অবস্থার জন্যে ছিলো যা আমাদের মত অগ্রসর সমাজের জন্যে অবান্তর এবং অযোগ্য, সুতরাং এগুলো বাদ দিতে হবে। এমন কি নামাজ, রমজানের মাসে রোজা, যাকাত এবং হজ্বের মত প্রশ্নাতীত অপরিহার্য এবাদও এমন শিথিল ও নমনীয়ভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে যাতে এগুলো পালনের বাধ্যবাধকতা না থাকে।

৩। মধ্যযুগের ইউরোপের সাংস্কৃতিক জীবনে মুসলমানদের এতই উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে যে তাদের ছাড়া আজকের আধুনিক সভ্যতার বিকাশ সম্ভব হতো না। অপর কথায় ইসলাম ছিল পশ্চিমা সভ্যতার জনক। পশ্চিমা সভ্যতা তারই নীতি ও মূল্যবোধের আরও উন্নত সংস্করণ। যদিও মুসলমান নামধারী নয় পম্চিমা সভ্যতার অনুসারীরা মুসলমানদের চাইতেও সত্যিকার ইসলামী প্রেরণায় উজ্জীবিত। এই কারণে মুসলমানেরা আধুনিক সংস্কৃতি গ্রহণ করে প্রকৃত উত্তরাধিকার ফিরে পেতে পারে।

আমাদের মহানবী এবং তার সাহাবীদের উদারতা প্রগতিশীল মনোভাবের উচ্ছাসিত প্রশংসা করে এরা এমন ভাব দেখায় যে, তারা ইসলামের কোন একক দিক নয় বরং তাদের কাংখিত উপায়ে পূর্ণাঙ্গ ইসলামই তারা পেতে চায়। সীমাহীন খোদা ভীতির মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিতকারী আমাদের ইমামদের সম্পর্কে তাদের আত্মপ্রাসাদপুর্ণ অনুমান আমাদের লোভের কারণ। তারা ইসলামেরে যে ব্যাখ্যঅ করেছেন নাস্তিক ও বস্তুবাদী লোকদের ব্যাখ্যাকে তার চাইতে উন্নত জ্ঞান করে আধুনিকতাবাদীরা ইসলাম ভক্তির কি হাস্যকর পরাকাষ্ঠই না দেখান।

ইসলামের চিরন্তন পবিত্র নীতির প্রতি তাদের কপট ভক্তি শ্রদ্ধা অবিশ্বাস ও সরাসরি অস্বীকারকে গোপন করারই হীন প্রচেষ্টা মাত্র। সুযোগ পেলে তারা কোন কিছুই বাদ দিতেন না। আধুনিকতাবাদীদের মতানুযায়ী স্বতন্ত্র ও স্বাধীন জীবন বিধান হিসেবে ইসলামের যদি স্বাভাবিক অস্তিত্ব না থাকে এবং জোর করে ভিন্ন মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান ছাড়া যদি নিজস্ব কোন গুণাগুণ না থাকে তাহলে ইসলামী ঐতিহ্য সংরক্ষণ বা আদো মুসলমান থাকার কোন প্রয়োজন আছে কি?

InfotakeBD

View posts by InfotakeBD
InfotakeBD is a information sharing blog, We share information for you. Please visit us and if you want to contribute for this blog please email us infotakebd@gmail.com. Thank you
Scroll to top
error: Content is protected !!