জিয়া গোকলপ : কামাল আতাতুর্কের অগ্রসেনা
মৃত্যুর পাঁচ দশক পরও জিয়া গোকলপ (Ziya Gokalp) তুরস্কের আধুনিক চিন্তানায়কদের মধ্যে খুবই প্রভাবশালী রয়ে গেছেন। ১৮৭৬ সালে জন্মগ্রহণ করে তিনি ইস্তাম্বুলের বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন এবং পরবর্তীকালে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়েরই সমাজতত্বের অধ্যাপক হন। ১৯১১ সাল থেকে ১৯২৪ সালে মৃত্যু পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত তিনি তার সমস্ত রচনা লিখেন। বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে জিয়া গোকলপই ছিলেন আধুনিক তুর্কী জাতীয়তাবাদের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ছাড়া কামাল আতাতুর্কের আমূল সংস্কার বাস্তবায়ন সম্ভব হতো না।
ঊনিশ শতক পর্যন্ত তুর্কীরা নিজেদেরকে প্রথমতঃ মুসলমান মনে করতো। তাদের আনুগত্য ছিল ইসলামের প্রতি, উসমানিয়া রাজ্যের প্রতি নয়। এমনকি উসমানিয়া শব্দটার অর্থ জাতীয় নয় বরং বংশানুক্রমিক বোঝায়। অতীতের ইসলামী সাম্রাজ্য উমাইয়া, আব্বাসীয়, সেলজুক এবং অন্যান্য বড় সাম্রাজ্যের মত এটাও বংশীয় সাম্রাজ্য। জাতীয় এবং দেশ প্রেমিক হিসেবে উসমানীয় জাতি এবং একটি উসমানীয় স্বদেশের ধারণা ঊনিশ শতকে ইউরোপীয় প্রভাব থেকে আসে। তা হচ্ছে সংক্ষেপে সে যে ভাষায় কথা বলে, যে অঞ্চলে বাস করে যে জাতি থেকে তার জন্ম তা ব্যক্তিগত আবেগ অথবা সামাজিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হতে পারে তবে রাজণৈতিক সম্পর্ক নয়। সুতরাং ইসলামের সঙ্গে পূর্ণ সংহতির ফলে তুর্কী জাতীয়তা বিলীন হয়ে গেছে। ইসলামের ভিতরে পৃথক বংশোদ্ভূত এবং সংস্কৃতির অধিকারী হিসেবে আরব এবং পারসীদের মত তাদের কোন পৃথক সত্তা ছিলনা। আরব এবং পারসীদের মত তুর্কীরা জাতীয় স্বাতন্ত্রের সামান্য পরিচয়ও প্রকাশ করেনি।
প্রাক ইসলামী তুর্কীরা অসভ্য ছিল না বরং তাদের নিজস্ব রাষ্ট্র, ধর্ম এবং সাহিত্য ছিল। তবুও খণ্ডিত বিখণ্ডিত না হওয়ার জন্যে ইসলাম সবকিছুই ভুলিয়ে দিয়েছে এবং মুছে ফেলেছে। অমুসলিম আরবদের পৌত্তলিক বীর, ইরানের বিলুপ্ত প্রায় সম্রাটের পারসী ঐতিহ্য অথবা মিশরে ফেরাউনের ভগ্ন কিন্তু বিরাট স্মৃতিস্তম্ভের ঐতিহ্য তুর্কীদের নেই। কিছু লোক কবিতা এবং বংশানুক্রমিক পৌরনিক উপাখ্যান ছাড়া তুকীদের প্রাক ইসলামী সকল ঐতিহ্য ভুলিয়ে দিয়েছে। এমন কি তুর্ক নামটাও যা এক অর্থে ইসলামিক।… এমনকি সহস্র বছরের তুর্কী ভাষঅও ইসলামে জন্মগ্রহণ করেছে এই কারণে আজ তুর্কীদের বংশোদ্ভুত তুরস্কের অমুসলমান নাগরিকদের জন্যে তুর্কী শব্দ কখনো প্রযুক্ত হয় না। উসমানীয়দের কোন গোত্রীয় অহমিকা বা বিশেষত্ব, খাটি তুর্কী বংশোদ্ভূতের ওপর জোরাজুরি নেই। ইসলাম আলবেনিয়া, গ্রীক, শ্লাভ এবং কুর্দ ও আরবদের সত্যিকার শক্তি ও সামাজিক মর্যাদা দিয়েছে”।[The emergence of modern turkey, Bernard lewis, Oxford University press, 1961.]
এই সৌভাগ্যজনক ঐতিহাকি অগ্রগতি তুর্কীদেরকে বিশ্বের মধ্যে সবচাইতে আগ্রহী মুসলমান এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী ইসলামের মর্যাাদা রক্ষকে পরিণত করেছে। জাতীয়তাবাদীরা তা সহ্য করতে পারেনি। Halide edib adivar-এর ভাষায় “জিয়া গোকলপ এমন এক নতুন তুর্কী জাতি গঠন করতে চেয়েছিলেন যা উসমানীয় তুর্কী এবং পৌত্তলিক পূর্বপুরুষ তুরানীদের পার্থক্য দূর করবে। তিনি বিশ্বাস করতেন আরবদের প্রতিষ্ঠিত ইসলাম আমাদের উদ্দেশ্যের সঙ্গে কখনও খাপ খাবে না। বংশীয় সূত্র থেকে তিনি খুব সতর্কতার সঙ্গে প্রাক ইসলামী তুর্কী ইতিহাস থেকে সাংস্কৃতিক ও রাজণৈতিক সংগঠনের তথ্য সংগ্রহ করেন। তিনি চেয়েছিলেন আমাদের জাতীয় ভাবধারার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ধর্মের সংস্কার করতে”।
জিয়া গোকলপ পশ্চিমী জাতীয়তাবাদের জন্যে মুসলিম বিশ্বের প্রথম সুবিন্যস্ত প্রচেষ্টার দাবী করতে পারেন- “এখন তুর্কীদের কাজ হচ্ছে জনগণের মধ্যে প্রাক ইসলামী যুগের যে তুর্কী ঐতিহ্য রয়েছে তা উন্মুক্ত করা এবং সামগ্রিকভাবে পশ্চিমা সভ্যতা গ্রহণ করা। ইউরোপীয়দের সঙ্গে সামিরক, বৈজ্ঞানিক ও শিল্পে সমতা অর্জনের জন্যে আমাদের একমাত্র পথ হচ্ছে পশ্চিমী সর্ভতাকে পুরোপুরি গ্রহণ করা”।
জিয়া গোকলপ উম্মা বা ইসলামের সার্বজনীন ভ্রাতৃত্বের ধারণাকে অস্বীকার করেছেন কারণ তা পশ্চিমী জাতীয়তাবাদের বিরোধী।
প্রাক- ইসলামী তুর্কীদের সবচাইতে বেশী দেশপ্রেম ছিল। অতীতের মত ভবিষ্যতেও তুর্কীদের নৈতিকতার ভিত্তি হওয়া উচিৎ দেশপ্রেম, কারণ জাতি এবং আত্মাই শেষ পর্যন্ত স্বকীয় সত্তার বিকাশস্থল। ধর্ম এবং পরিবারের প্রতি আনুগত্যের চাইতে জাতির প্রতি আনুগত্য আগে প্রয়োজন। জাতি এবং স্বদেশকে তুর্কীদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। আমরা প্রকৃত সভ্যতা- একটি তুর্কী সভ্যতার সৃষ্টি করব যা নতুন জীবনের সঞ্চার করবে। তুর্কীরা আর্যদের চাইতে ফর্সা এবং সুন্দর, মঙ্গোলীয়দের সাথেও তাদের সম্পর্কের কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। তুর্কী গোত্র অন্যান্য গোত্রের মত সুরাসার বা লাম্পট্য থেকে সৃষ্টি হয়নি। সমরক্ষেত্রে ঐতিহ্য নিয়ে তুর্কীরক্ত সতেজ ও পূর্ণ যৌবন নিয়ে সচল রয়েছে। তুর্কী বুদ্ধি লয়প্রাপ্ত হয়নি। তার আবেগ দুর্বল হয়নি। তুর্কি সংকল্পে ভবিষ্যৎ বিজয়ের প্রতিশ্রুতি রয়েছে”।
(IBID পৃঃ ৩০২, ২৭১ এবং ৬০)। পশ্চিমী সভ্যতাকে সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করার জন্যে জিয়া গোকলপ যুক্তি দিয়েছেন- পশ্চিমী সভ্যতা প্রাচীন ভূমধ্যসাগরীয় সভ্যতার পরবর্তী রূপ। তুর্কীরা ছিল ভূমধ্যসাগরীয় সভ্যতার প্রতিষ্ঠাতা। ইতিহাসে প্রাচীন যুগের আগে তুরানী যুগ ছিল। সেই দিক থেকে পশ্চিম এশিয়ার আদি বাসিন্দারা আমাদের পূর্ব পুরুষ। এইভাবে আমরা পশ্চিমী সভ্যতার অংগ এবং এতে আমাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ রয়েছে। (IBID পৃঃ ২৬৬-৭)।
ইতিহাসের এই বিকৃতির ফলে জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকরা কামাল আতাতুর্কের শাসনকালে দাবী করলেন যে, অতীতের সকল মহান ব্যক্তি তুর্কী ছিলেন অথবা তুর্কীরা তাদের সভ্য করেছে। ফিনিশিয়রা ছিল সেমিটিক, স্কেথিয়ানরা ছিল পারসীদের জাতিভুক্ত। অপরদিকে সুমারিয়ানরা কোন গোত্র পার্থক্য মানতো না। জিয়া গোকলপ মিশরীয়দের কথা উল্লেখ করতেও ভুলে গেছেন। তিনি কি তাদেরকেও তুর্কী মনে করতেন?
জিয়অ গোকলপ দাবী করেছেন যে, রোমান সাম্রাজ্য ধ্বংস করে তুর্কীরা ইউরোপের ইতিহাসে বিপ্লব সৃষ্টি করেছে। সকল বিপ্লবী তুর্কী জাতীয়তাবাদীর মত তিনিও আধুনিক তুর্কীদের হুন বলে আখ্যায়িত করেছেন। ফলে বহু তুর্কী অভিভাবক তাদের সন্তানদের নাম রেখেছেন “Attila’। ধ্বংসাত্মক তৎপরতা সত্ত্বেও রোমের পতনে হুনদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য ছিল না। হুন এবং আধুনিক তুকীদের সম্বন্ধ অস্পষ্ট। অন্ততঃ আমি যদি তুর্কী হতেম তাহলে তাদের বংশধর বলার মধ্যে কোন গৌরব বোধ করতাম না।
জিয়া গোকলপ একটি স্বাধীন সভ্যতার অধিকারী হিসেবে ইসলামকে স্বীকার করে নেননি। যখন একটি জাতি বিবর্তনের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছায় তখন তার সভ্যতারও পরিবর্তন প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তুর্কীরা যখন মধ্য এশিয়ার যাযাবর উপজাতি ছিল তখন তারা দূর প্রাচ্যের সভ্যতার অধিকারী ছিল। যখন তারা সুলতানাতের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা অতিক্রম করেছে তখন বাইজেনটাইন সভ্যতায় প্রবেশ করে এবং ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র ব্যবস্থায় প্রবেশের মুখে তারা পশ্চিমা সভ্যতা গ্রহণে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ (IBID ২০৭-১)।
পশ্চিমা সভ্যতা চালূর ব্যাপারে জিয়া গোকলপ তার সমসাময়িকদের মত ভাল মন্দ পাথ্যক্য করেননি। বরং সব ব্যাপারে অনুকরণের ওপর জোর দিয়েছেন- তানজিমাত [তানজিমাত আন্দোলন’ উনিশ শতকের প্রথমাধ্যে তুরস্কে পশ্চিমীকরণের প্রাথমিক প্রচেষ্টা।] এর নেতাদের সব চাইতে বড় ভুল হচ্ছে তারা পূর্ব পশ্চিমের মিশ্রণে মানসিক জগাখিচুড়ী সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন। তারা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন যে, সম্পূর্ণ বিপরীত নীতির দু’টি সভ্যতার আপোষ সম্ভব নয়। দু’ধরনের রাজনৈতিক সংগঠন, দু’ধরনের বিচার ব্যবস্থা, দু’ধরনের স্কুল, দু’ধরনের কর ব্যবস্থা, দু’টি বাজেট, দু’ধরনের আইন সবই এই ভুলের ফলশ্রুতি। পূর্ব পশ্চিমের আপোষের যে কোন প্রচেষ্টা মধ্য যুগকে আধুনিক যুগে টেনে আনা এবং জিইয়ে রাখার প্রচেষ্টার নামান্তর।
আধুনিক সমর পদ্ধতির সঙ্গে জেনিসারির (Janissary) আপোষ যেমন সম্ভব নয়; আধুনিক ঔষধের সঙ্গে প্রাচীন প্রক্রিয়ার ঔষধকে সারিভুক্ত করা যেমন নিরর্থক, একইভাবে প্রাচীন আইন ও নতুন আইন এবং চিরাচরিত ঐতিহ্য ও মূল্যবোধকে পাশাপাশি ধরে রাখার প্রচেষ্টাও অবান্তর। প্রত্যেক সভ্যতার নিজস্ব যুক্তি, রুচিরোধ এবং বৈষয়িক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। এই কারণে বিভিন্ন সভ্যতা অবাধে মিশে যেতে পারে না। আবার একই কারণে যখন কোন সমাজ বিশেষ সভ্যতাকে পুর্ণাঙ্গভাবে গ্রহণ করে না সে সমাজ তার অংশ গ্রহণেও ব্যর্থ হয। এমনকি যদি কিছু অংশ নিয়েও থাকে তবে তা হজম করতে ব্যর্থ হয়। আমাদের তানজিমাত সংস্কারকরা এদিকটা বুঝতে ব্যর্থ হয়ে সব সময় প্রত্যেক ব্যাপারে অর্ধ পদক্ষেপ নিয়েছেন। জাতীয় উৎপাদন প্রক্রিয়া আধুনিকীকরণের আগে তারা ভোগ, পরিধান, খাওয়া, নির্মাণ এবং আসবাবের পরিবর্তন করতে চেয়েছেন।
অপরদিকে, এমনকি ইউরোপীয় মনে একটি শিল্পোন্নতির কেন্দ্রও তৈরী হয়নি কারণ তানজিমাতের নীতি নির্ধারকরা অবস্থা পর্যালোচনা না করে এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও পরিকল্পনা না নিয়েই সংস্কারের উদ্যেগ নিয়েছেন। (IBID পৃঃ ২৭০-৭৭)। জিয়া গোকলপ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রথম প্রবক্তাদের অন্যতম। পরে মোস্তফা কামাল তা বাস্তবায়ন করেন- আইনে তুর্কীবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য হচ্ছে তুরস্কে আধুনিক আইন চালূ করা। আধুনিক জাতিসমূহের পর্যায়ে পৌঁছার জন্যে আমাদের মৌলিক শর্ত হচ্ছে ধর্মতত্ত্ব ও যাজক সম্বন্ধীয় সকল শাখা থেকে আইন কাঠামো মুছে ফেলা।
এই দু’টি চরিত্র বহির্ভূত মধ্যযুগীয় রাষ্ট্রকে আধুনিক রাষ্ট্র বলা হয়। প্রথমতঃ আধুনিক রাষ্ট্রে আইন প্রণয়ন এবং শাসনের ক্ষমতা জনগণের হাতে থাকে। কোন কার্যালয়, কোন ঐতিহ্য এবং কোন দাবী এই অধিকার খর্ব করতে পারে না। দ্বিতীয়তঃ আধুনিক জাতির সকল সদস্য ধর্ম পরিচয় নির্বিশেষে সকল ক্ষেত্রে সমান বিবেচিত হয়। সংক্ষেপে আমাদের আইনের স্বাধীনতা, সাম্য এবং ন্যায় বিচারের বিরোধী সকল ধারা ধর্মতত্ত্ব ও যাজক বিধানের সকল ধারা নির্মূল করতে হবে। তুর্কীবাদ একটি ধর্ম নিরপেক্ষ আন্দোলন এবং কেবলমাত্র ধর্ম নিরপেক্ষ প্রকৃতির যে কোন আন্দোলনের সঙ্গে আপোষ করতে পারে। (IBID পৃঃ ৩০৪-৫)
ইসলাম ও পশ্চিমীবাদের মধ্যে কোন বিরোধ নেই একথা প্রমাণ করতে গিয়ে তিনি বলেছেন- কেবলমাত্র সভ্যতার দ্বারা ইউরোপ মুসলিম দেশসমূহকে পরাস্ত করতে এবং বিশ্বের প্রভু হতে পেরেছে। তবে কেন এই সফলতার সাক্ষ্যবহ সভ্যতাকে আমরা গ্রহণ করতে পারব না? আমাদের ঈমান কি সকল প্রকারের বিজ্ঞান ও শিক্ষাকে গ্রহণের দায়িত্ব বর্তায় না? আমাদের মহানবী বলেছেন- “জ্ঞান অর্জনের জন্যে প্রয়োজনে চীনেও যাও” এবং “জ্ঞান ঈমানদারদের হারানো সম্পদ যেখানেই সে পাবে তা গ্রহণ করা উচিৎ”। জাপানকে ইউরোপীয় শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয় কিন্তু সত্যিকার অর্থে ইউরোপীয় সভ্যতা গ্রহণ না করায় তাদেরকে এশীয় জাতি ধরা হয়।
জাতীয়তাবাদ প্রচার করেই জিয়া গোকলপ সন্তুষ্ট হননি তিনি ইসলামেরও পরিবর্তন চেয়েছেন। কোন জাতীয়তাবাদী তার মত জাতীয়তায় এত উন্মত্ত ছিলেন না। তিনি সকল আরবী ফারসী উদ্ভূত শব্দকে তুর্কীকরণের ওপর জোর দেন। এই পরিশুদ্ধির ফলে এক শতকে আগের লিখিত ও পঠিত তুর্কী ভাষা তুর্কীদের কাছে অপরিচিত হয়ে পড়ে। পরবর্তী পর্যায়ে মূল্যবান তুর্কী পাণ্ডুলিপির সকল লাইব্রেরী ইস্তাম্বুল এবং অন্যন্য তুর্কী শহরের যাদুঘরে পঁচতে থাকে। কারণ জাতির বয়োবৃদ্ধরা পর্যন্ত এসব পড়তে বা বুঝতে পারে না। এইভাবে ভাষা সংস্কার চিরস্থায়ীভাবে ইসলামী ঐতিহ্যের ধারক প্রাচীন তুর্কীর সঙ্গে আধুনিক তুরস্কের সম্পর্ক ছিন্ন করে দেয়। জিয়া গোকলপ এবং তার অনুসারীরা চেয়েছিলেন- প্রার্থনার ভাষা তুর্কী হতে হবে। যাতে প্রার্থনাকারী তাদের ধর্মের মর্মার্থ বুঝতে পারে, কোরআন তুর্কী ভাষায় পড়তে হবে যাতে ছোট বড় প্রতিটি মানুষ খোদার আদেশ বুঝতে পারে- এমন দেশই হবে তুর্কীদের প্রকৃত স্বদেশ।
জিয়া গোকলপ নিজেকে বড় কবি কল্পনা করতেন। তার ‘ধর্ম ও বিজ্ঞান’ কবিতার একটি অংশের ভাবার্থ নিম্নে দেয়া হলো। এতে তিনি আদর্শ নারীত্বের পরিচয় দিয়েছেন এইভাবে- নারী সে আমার মা ভগিনি বা কন্যা হোক, তার মধ্যে আমার জীবনের গভীর আবেগ নিহিত। চন্দ্র, সূর্য বা তারকার প্রতি আমার ভালবাসা সেও নারীর কারণে। নারীই আমাদের জীবনের ছন্দময় সত্তাকে বুঝতে সাহায্য করে। কিভাবে খোদার পবিত্র আইন এই সুন্দর জীবকে ঘৃণ্য বিবেচনা করতে পারে? নিশ্চয়ই বিজ্ঞরা কোরআনের ব্যাখ্যায় ভুল করেছেন। জাতি এবং রাষ্ট্রের ভিত হচ্ছে পরিবার, যতদিন নারীর প্রকৃত মর্যাদা দেয়অ না হবে ততদিন জাতীয় জীবন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। পরিবারের লালন পালনে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অতএব তিনটি বিষয়ে সাম্য প্রয়োজন- তালাক, পৃথক হওয়া এবং উত্তরাধিকারে। যতদিন উত্তরাধিকার এবং বিবাহের ব্যাপারে নারীকে পুরুষের অর্ধেক বিবেচনা করা হবে ততদিন পরিবার বা দেশ উন্নতি করতে পারবে না। অন্যান্য অধিকারের জন্য আমরা জাতীয় বিচারালয় প্রতিষ্ঠা করেছি। কিন্তু পরিবারকে আমরা কাজী এবং ধর্মতাত্মিকদের হাতে ছেড়ে দিয়েছি। আমি জানিনা কেন আমরা নারীকে অসহায়ত্বের দিকে ঠেলে দিয়েছি। সে কি জাতির জন্যে কাজ করে না? অথবা সে কি তার সূঁচকে তীক্ষ্ম বেয়নেটে রূপান্তরিত করে বিপ্লবের মাধ্যমে আমাদের কাছ থেকে অধিকার ছিনিয়ে নেবে? (IBID পৃঃ ১৬১)
ডঃ মোহাম্মদ ইকবাল তার ‘ইসলামী চিন্তার পুনর্গঠন’ গ্রন্হে লিখেছেন- জিয়া গোকলপের ইজতিহাদ প্রায়ই আপত্তিকর। (পৃঃ ১৬০) তুর্কী কবির দাবীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমি খুবই আশঙ্কিত যে তিনি ইসলামের পারিবারিক আইন সম্পর্কে খুব বেশী কিছু জানতেন না। (পৃঃ ১৬৯)
জিয়া গোকলপের স্বাদ ছিল ইসলামকে আধুনিক বৈজ্ঞানিক ধর্মে সংস্কার করা। ধর্মের আধুনিকীকরণ ও বিজ্ঞানিকরণ দ্বারা তিনি মসজিদকে খৃষ্টীয় গীর্জার মত বানাতে চেয়েছিলেন। তার মৃত্যুর বার বছর পর ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকালটি অফ ডিভাইনটি বা ঐশ্বরিক অনুষদ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে সুপারিশ পাঠানোর জন্যে একটি কমিটি নিয়োগ করলে তার স্বপ্ন বাস্তবে রূপায়িত হয়। ১৯২৮ সালের জুনে প্রকাশিত কমিটির রিপোর্ট অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে প্রার্থনাকে ‘সুন্দর’ ‘উৎসাহব্যঞ্জক’ এবং ‘আধ্যাত্মিক’ করার জন্যে মসজিদে বসার আসন, ক্লোকরুম চালু, জুতা নিয়ে নামাজ আদায়, প্রার্থনার ভাষা হিসেবে তুর্কী ভাষা চালু, আরবী বিলোপ, প্রার্থনায় সেজদার নিয়ম বাতিল, প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত বাদ্যযন্ত্রী এবং বাদ্য যন্ত্র রাখার সুপারিশ করা হয়। পশ্চিমী আধুনিক যন্ত্র সঙ্গীত মসজিদে চালুর জন্যে বিষয়টি খুবই জরুরী।[The Emergence of Modern Turkey. Bernerd Lewis p-408.]
তুর্কী মুসলমানরা দুনিয়ার অন্যান্য মুসলমানের মত ধর্মনিষ্ঠ হওয়ায় জিয়া গোকলপের হাতে ইসলামের এই অঙ্গহানি মেনে নিতে অস্বীকার করেন। দারুন ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে অতঃপর এই প্রকল্প প্রত্যাহৃত হয়।