মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক : জীবন ও কাজের মূল্যায়ন

মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক : জীবন ও কাজের মূল্যায়ন

মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক ১৮৮১ সালে সালোনিকার এক জীর্ণ কুটিরে জন্মগ্রহণ করেন। সরকারী অফিসের ছাপোষা কেরানীর পদে ইস্তফা দেয়ার পর তার বাবা আলী রেজা ব্যবসায়ে দু’বার ব্যর্থ হন। পরে দুঃখকষ্ট ভুলে থাকার জন্যে মাদকদ্রব্যে ডুবে থাকেন এবং আতাতুর্কের ৭ বছর বয়সের সময় যক্ষারোগে মারা যান। তার মা জুবাইদা খুবই পর্দানশীল এবং অশিক্ষিত ছিলেন। পরিবারের কর্তৃত্ব তার হাতেই ছিল। তার স্বামীর বৈপরিত্যে তিনি ছিলেন খুবই ধর্মনিষ্ঠ মুসলমান। সে যুগের অন্যান্য তুর্কী মহিলার মত তার সমগ্র জীবন বড় ছেলেকে ঘিরেই কেন্দ্রীভূত ছিল। গভীর ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে জুবাইদা চেয়েছিলেন তার সন্তান ধার্মিক পণ্ডিত হবে।

কিন্তু সন্তানের ভিন্ন ধ্যান ছিল, তিনি সকল প্রকার কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন এবং প্রকাশ্যে তার শিক্ষকদের অপমান এবং গালাগালি করতেন। তার সহপাঠিদের প্রতিও তার ব্যবহার ছিল অমার্জিত এবং তাদের খেলা ধুলায় অংশগ্রহণ না করে সকলের অপ্রিয় হয়ে উঠেন। তার কাজে হস্তক্ষেপ করলে তিনি বিরক্ত হয়ে একলা খেলাধুলা করতেন। এ ধরনের উদ্ধত আচরণে একদা এক শিক্ষক ক্রোধান্ধ হয়ে তাকে বেদম প্রহার করেন। মোস্তফা স্কুল থেকে পালিয়ে যান এবং পুনরায় স্কুলে যেতে অস্বীকার করেন। তার ধর্মনিষ্ঠা মা বুঝাতে চেষ্টা করলে তিনি তাঁকে উল্টো আঘাত করেন। জুবাইদা হতাশ হয়ে কি করবেন ভেবে উঠতে পারলেন না, পরে তার এক চাচা তাকে সালোনিকার সামরিক স্কুলে পাঠিয়ে সৈনিক করার পরামর্শ দেন।

সরকারের অনুদানে পরিচালিত হওয়ায় স্কুলে তার কোন খরচ পড়বে না, যোগ্যতার পরিচয় দিলে সে অফিসার হবে যদি তা না হয় অন্ততঃ সাধারণ সৈনিক হবে। যে কোনভাবে তার ভবিষ্যৎ জীবন যাত্রার নিশ্চয়তা আছে। যদিও জুবাইদা রাজী হননি কিন্তু তার বাধ সাধার আগেই মোস্তফার বাবার জনৈক বন্ধু তাকে কর্তৃপক্ষের কাছে নিয়ে যেতে সম্মত হন। সে পরীক্ষা দেয় এবং ক্যাডেটে উত্তীর্ণ হয়। এখানেই সে নিজের জীবন শুরু করল। শিক্ষাগত দিক থেকে সে এতই সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে যে, তার একজন শিক্ষক তাকে মোস্তফা নাম দেন। এই আরবী শব্দের অর্থ পরিপূর্ণ। অঙ্ক এবং সামরিক বিষয়ে মেধার কারণে তাকে শিক্ষকতায় নিযুক্ত করা হয়।

শেষ পরীক্ষায় সর্বোচ্চ পদমর্যাদাসহ ১৯০৫ সালের জানুয়ারীতে তিনি ক্যাপ্টেন পদমর্যাদায় স্নাতক সম্মান পাশ করেন। এই সময় তিনি VATNM স্বদেশ নামে পরিচিত জাতীয়তাবাদী ছাত্র সমিতিতে যোগ দেন। VATAN এর সদস্যরা বিপ্লবী হওয়ার জন্যে গর্বিত ছিলেন। তারা সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদের শাসনের প্রতি বিরুপ ছিলেন এবং ইসলামের কর্তৃত্ব অবমাননাকারী তথাকথিত উদার নীতির প্রতি কঠোরতার জন্যে তার নিন্দে করেন।

তারা তুরস্কের অনগ্রসরতার জন্যে ইসলামকে দায়ী করতে কুণ্ঠিত ছিলেন না এবং শরিয়তকে সেকেলে বলে আখ্যায়িত করেন। ‘ভাতানে’র সদস্যরা সুলতানকে অপসারনের শপথ নেন এবং তার পরিবর্তে পশ্চিমী চালের সরকার, সংবিধান, পার্লামেন্ট প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন, তারা উলেমা বা ধর্মীয় পণ্ডিতদর কর্তৃত্ব অস্বীকার, পর্দা বিলোপ এবং নারী পুরুষের নিরঙ্কুশ সাম্যের প্রচেষ্টা শুরু করেন। শগগীরই মোস্তফা কামাল এর প্রধান হয়ে যান।

১৯০৮ সালে সুলতান আবদুল হামিদকে অপসারণের আগে তরুন তুর্কীদের ক্ষমতাসীন সংগঠন The committee of union and progress মোস্তফা কামালকে দলে যোগদানের আহ্বান জানালে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ এসে যায়। অবশ্য দলের নতুন সদস্য হিসেবে তাকে আদেশ মানতে হত, এ সময় তার প্রকৃতি ছিল হয় তাকে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে হবে নতুবা কোন অংশ্রহণ করতে হবে না, তিনি ক্রমেই চরম এবং অসহিষ্ণু হয়ে পড়েন। দলের অন্যান্য সদস্যকে তিনি কোন গুরুত্বই দিতেন না। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী যুবরাজ সৈয়দ হালিম পাশা এবং সমরমন্ত্রী আনোয়ার পাশাকে ঘৃণা করতেন। তিনি তাদের সঙ্গে প্রায়ই ঝগড়া করতেন।

পরবর্তী দশ বছর সামরিক পেশায় নিজেকে জন্মগতভাবে সৈনিক এবং নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠায় চেষ্টিত হন। ক্রমান্বয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ও বুদ্ধিমত্তার দ্বারা তিনি আরও রাজনৈতিক প্রভাবের অধিকারী হন। সন্ধায় তালাবদ্ধ ঘরে তিনি অভ্যুত্থানের পরিকল্পনায় গোপনে বৈঠক করতেন। প্রথম বিশ্বযুদ্দে তুরস্কের আঞ্চলিক অখণ্ডত্ব রক্ষায় নেতৃত্ব দেয়ায় তার সুযোগ সৃষ্টি হয়। দেশ রক্ষার জন্যে উৎসর্গকৃতপ্রাণ সৈনিকদের প্রিয় নেতা মোস্তফা কামাল পাশা জাতীয় বীরে পরিণত হন। গ্রীকের পরাজয় এবং তুরস্কের বিজয় সুনিশ্চিত হওয়ায় তুর্কী জনগণ আনন্দে উন্মত্ত হয়ে যান। তারা তাকে রক্ষক হিসেবে অভিনন্দিত করেন এবং গাজী উপাধিতে ভূষিত করেন।

কূটনীতিক আবেগের আতিশয্যে প্রাচ্যের দেশগুলো তাকে পাশ্চাতের বিরুদ্ধে প্রাচ্যের নেতা হওয়ার আহ্বান জানান। রাষ্ট্রীয় পরিষদে আরব রাষ্ট্রনায়কদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেনঃ আমি সকল ইসলামী রাষ্ট্রের ফেডারেশন বা সোভিয়েতের অধীনে সকল তুর্কী জনগণের লীগ কোনটাতেই বিশ্বাসী নই, আমার একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে তুরস্কের প্রাকৃতিক সীমান্তে তার স্বাধীনতা রক্ষা করা, উসমানীয় বা অন্য কোন সাম্রাজ্যের পুনরুজ্জীবনের জন্যে নয়, স্বপ্নের মোহ দিয়ে অতীতে তারা আমাদের অনেক ক্ষতি করেছে।

তার সমর্থন আদায়ের জন্যে আগত কম্যুনিষ্ট প্রতিনিধিদের উদ্দেশ্যে আরও দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেনঃ এখানে কোন শোষক বা শোষিত নেই। এখানে কেবল তারা আছে যারা নিজেদের শোষণ করার অনুমতি দেয়। তুর্কীরা এদের মধ্যে নেই, তারা কেবল নিজেদের ব্যাপারে সচেতন। অন্যরাও তাই করুক, আমাদের একটা মাত্র নীতি- তুর্কীর চোখে সকল সমস্যাকে দেখা এবং তুর্কীর জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করা।

স্বাভাবিক সীমান্তের মধ্যে ক্ষুদ্র এবং সংহত জাতি, সবকিছুর উর্ধ্বে একটি সমৃদ্ধশালী আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে তুরস্ককে গড়ে তোলার ব্যাপারে মোস্তফা কামাল পাশার ঘোষিত নীতি বিশ্বের সকল জাতি কর্তৃক সম্মানিত হয়েছে। তিনি এতই দৃঢ় আস্থাবান ছিলেন যে, এই কাজ সমাধার জন্যে তিনি যোগ্যতম ব্যক্তি। তিনি দাবী করেন আমি তুরস্ক, আমাকে ধ্বংস করার মানে তুরস্ককে ধ্বংস করা।

ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই তিনি ঘোষণা করেন যে তিনি তুর্কী জাতির জীবন থেকে ইসলামের সকল চিহ্ন মুছে ফেলবেন। কেবলমাত্র ইসলামের কর্তৃত্ব নির্মূল করার পরই তুর্কীরা অগ্রগতি করতে পারে এবং আধুনিক ও সম্মানিত জাতিতে পরিণত হতে পারে। তিনি ইসলাম এবং ইসলামের সকল দিকের বিরুদ্ধে জনসমক্ষে একের পর এক বক্তৃতা দিতে থাকেন।

প্রায় পাঁচশ বছর ধরে একজন আরব শেখের মতবাদ ও আইন এবং অলস ও অকর্মন্য মোল্লাদের ব্যাখ্যা তুরস্কের দেওয়ানী ও ফৌজদারী আইনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত করে আসছে। তারা সংবিধানের ধরন, প্রতিটি তুর্কীর জীবনযাত্রা, তার খাদ্য, তার নিদ্রা এবং শয্যা ত্যাগের সময়, তার কাপড়ের আকৃতি, তার সন্তান ধারক ধাত্রীর রুটিন, তার স্কুলের পঠিতব্য বিষয়, তার আচার প্রথা, চিন্তা এমনকি তার ঘনিষ্ঠ অভ্যঅস নির্ধারণ করে আসছে। ইসলাম একজন ধর্মতাত্মিক নীতিহীন আরবের প্রচলিত একটি মৃত বস্তু। সম্ভবতঃ এটি মরুর উপজাতিদের জন্য উপযুক্ত ছিল। বর্তমান আধুনিক ও প্রগতিশীল রাষ্ট্রের জন্যে এর কোন মূল্য নেই। খোদার ওহি? কোন খোদাই নেই! এগুলো হচ্ছে শৃংখল, যার দ্বারা মোল্লা এবং খারাপ শাসকরা জনগণতে নত থাকতে বাধ্য করে, যে শাসক ধর্ম চায় সে দুর্বল প্রাণী, কোন দুর্বল প্রাণীর শাসন করা উচিত নয়। (IBID পৃঃ ১৯৯-২০০)

আবদুল মজিদ খলিফা নির্বাচিত হলে মোস্তফা কামাল পাশা চিরাচরিত ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার অনুমতি দেননি। বিষয়টি আলোচনার জন্যে পরিষদের বৈঠক বসার পর মোস্তফা কামাল বিতর্ক বন্ধ করে দিয়ে বলেনঃ নামমাত্র রাষ্ট্র প্রধান ছাড়া খলিফার কোন ক্ষমতা বা মর্যাদা নেই। আবুদল মজিদ তার ভাতা বৃদ্ধির দাবী জানিয়ে দরখাস্ত করলে মোস্তফা কামাল উত্তর দেন- আপনার খেলাফতের অফিস ঐতিহাসিক ধ্বংসাবশেষ ছাড়া আর কিছুই নয়। এর অস্তিত্বের কোন যৌক্তিকতা নেই। আামর কোন সচিবের কাছে লিখা আপনার ধৃষ্টতার সামিল।

১৯২৪ সালের ৩রা মার্চ খেলাফতকে চিরদিনের জন্যে সম্পূর্ণ বিতাড়িত এবং সম্পূর্ণ ধর্ম নিরপেক্ষ তুর্কী জাতি প্রতিষ্ঠার জন্যে পরিষদে বিল উত্তাপন করেন। বিল পেশ করার আগে এবং বিল সম্পর্কে কেউ কিছু জানার আগে দূরদর্শিতার সঙ্গে তার কোন কাজের বিরোধিতাকে মারাত্মক অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করেন-

“সবকিছুর বিনিময়ে প্রজাতন্ত্র বজায় রাখতে হবে। উসমানীয় সাম্রাজ্য ভেঙ্গে যাওয়ার পরও ধর্মীয় আইনের ওপর ভিত্তিকৃত নড়বড়ে কাঠামো ছিল। খলিফা এবং উসমানীয় পরিষদের অবশেষকে বিদায় করতে হবে। প্রাচীন ধর্মীয় আদালত এবং আইনের যায়গায় আধুনিক বৈজ্ঞানিক দেওয়ানী আইন চালূ করতে হবে। মোল্লাদের মক্তবে ধর্মনিরপেক্ষ সরকালের স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ধর্ম এবং রাষ্ট্রকে পৃথক করতে হবে। তুর্কী প্রজাতন্ত্রকে সত্যিকার ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে পরিণত করতে হবে”।

পরবর্তী পর্যায়ে কোন বিবর্ত ছাড়াই বিলটি গৃহীত হয় এবং সাবেক খলিফা ও তাঁর পরিবারকে সুইজারল্যাণ্ডে নির্বাসনে পাঠানো হয়। নতুন প্রশাসন তখন এই আইন জারী করেন। নতুন তুর্কী সংবিধানের মুখবন্ধ আতাতুর্কেল সংস্কারের প্রতি নিষ্ঠা প্রকাশ করছে এবং ১৫৩ অনুচ্ছেদে সংস্কার থেকে পশ্চাতে ফিরে যাওয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করছে। এই সংবিধানের কোন ধারাকে ভাষান্তর বা সংবিধান বিরোধী বলে ব্যাখ্যা করা যাবে না, কারণ নিম্ন বর্ণিত সংস্কার আইনগুলোর লক্ষ্য হচ্ছে তুর্কী সমাজকে সমসাময়িক সভ্যতার পর্যায়ে পৌঁছানো এবং প্রজাতন্ত্রের ধর্মনিরপেক্ষ বৈশিষ্ট্য রক্সা করা যা গণভোটে গৃহীত হওয়ার দিন থেকে কার্যকর হয়েছে-

১। ১৯২৪ সালের ৩রা মার্চের শিক্ষা ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে একত্রীকরণের আইন।

২। ১৯২৫ সালের পঁচিশে নভেম্বরে টুপি আইন।

৩। দরবেশ আশ্রম, সমাধি স্তম্ভসমূহ বন্ধ এবং সমাধি রক্ষকের কার্যালয় বিলুপ্তি এবং ১৯২৫ সালের ৩০শে নভেম্বরের কিতপয় খেতাব নিষিদ্ধকরণ সংক্রান্ত আইন।

৪। ১৯২৬ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারীর সাধারণ বিয়ের নিয়ম কানুন।

৫। ১৯২৮ সালের ২০শে মে’র আন্তর্জাতিক সংখ্যা প্রবর্তন সংক্রান্ত আইন।

৬। ১৯২৮ সালের ১লা নভেম্বরের তুর্কী হরফের যায়গায় ল্যাটিন হরফ চালু ও প্রয়োগ এবং আরবী পাণ্ডুলিপি নিষিদ্ধকরণ সংক্রান্ত আইন।

৭। ১৯৩৪ সালের ২৬শে নভেম্বরের পাশা, BEY ও EFFENDI ধরনের খেতাব ও পরিচিতি বাতিল সংক্রান্ত আইন।

আতাতুর্কবাদকে পুরোপুরি অস্বীকার করা অসম্ভব এবং অচিন্তনীয় হয়ে পড়লো। এটা অসম্ভব কারণ সংবিধান তা নিষিদ্ধ করেছে, অচিন্তনীয় কারণ বৃদ্ধ এবং যুবকরা সংস্কারের ফলাফল গ্রহণ করেছে এবং সমৃদ্ধ জীবনের জন্যে পশ্চিমীকরণ একটা জনপ্রিয় ম্যাজিক হয়ে উঠেছে। [Turkey to-day and to-morrow; An experiment in westernization, Nuri Eren Praeger, New York, 1963 p-100-102.]

যে সময় এসব সংস্কার কার্যকর করা হচ্ছিল মোস্তফা কামাল পাশা লতিফা নাম্নী ইউরোপীয় শিক্ষিতা একজন সুন্দরী মহিলাকে বিয়ে করেন। তুরস্কের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় মোস্তফা কামাল পাশা এই মহিলাকে পুরুষদের পোষাক পরিধান এবং মহিলাদের নিরস্কুশ সাম্যের দাবী করতে উৎসাহিত করেন। কিন্তু আত্মসম্মান বোধ সম্পন্না হয়ে যখন তিনি সম্মানিত স্ত্রীর মত ব্যবহারের দাবী করেন, রাগান্বিত হয়ে মোস্তফা তাকে তালাক দেন। লতিফাকে তালাক দেয়ার পর তাঁর লজ্জাহীনতার সীমা ছিল না। এত বেশী মদ পান শুরু করেন যে, িতন মদ্যপ বনে যান। সুন্দর যুবক ছেলেরাই তাঁর কামপ্রবৃত্তির লক্ষ্য হয়ে পড়ে এবং তাঁর রাজণৈতিক সমর্থকদের স্ত্রী কন্যাদের প্রতি তার ব্যবহার এতই উদ্ধত হয়ে পড়ে যে, তারা তাদের মহিলঅদেরকে তাঁর কাছ থেকে যতদূরে সম্ভব পাঠাতে শুরু করলেন। যৌনরোগে তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে।

তাঁর চরিত্র বর্ণনা করতে গিয়ে The grey wolf এর লেখক H.G. Armstrong- লিখেন- মোস্তফা কামাল পাশা সব সময় একা, নিঃসঙ্গ ও একক হাতে খেলছিলেন। তিনি কাউকে বিশ্বাস করেননি। কেউ তাঁর সঙ্গে মতদ্বৈততা দেখালে তিনি তাকে অপমান করতেন। তিনি সব কাজ আত্ম স্বার্থের মাপকাঠিতে বিবেচনা করতেন। তিনি বিবেচনাহীন প্রতিহিংসাপরায়ণ ছিলেন। একজন চাতুর বা সক্ষম মানুষ তার কাছ থেকে রক্ষা পাওয়া কঠিন ছিল। অন্য যে কোন লোকের পারদর্শিতা সম্পর্কে তিনি খুবই খুঁতখুঁতে ছিলেন। তিনি তাঁর সমর্থকদের চরিত্র হনন এবং তাদের প্রতি অবজ্ঞা দেখিয়ে পাশবিক আনন্দ পেতেন। অবজ্ঞা ছাড়া তিনি কখনো দয়া বা উদারতা দেখাননি। তিনি কারো ওপর আস্থা স্থাপন করেননি। তার কোন ঘনিষ্ঠ লোকও ছিল না। তার বন্ধুরা শয়তান গোছের, যারা তার সঙ্গে মদ্যপান করতো, তার ইন্দ্রিয় সুখে সহায়তা করতো। যুদ্ধের কালো দিনগুলোতে যেসব ভাল লোক তার পাশে ছিলেন পরবর্তী কালে সকলেই তার বিরুদ্ধে ছিলেন। (পৃ৬ ২১৩-১৪)

কোন স্বৈরাচারী প্রতিদ্বন্দ্বী বরদাশত করতে পারে না। কামাল পাশাও রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দীদের নিশ্চিহ্ন করতে কোন সুযোগই ছাড়েননি- গোপন পুলিশ তাদের কাজ করেছে। গ্রেফতারকৃত রাজনৈতিক নেতাদেরকে সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়ার জন্যে পুলিশ খেয়াল খুশী মত অত্যাাচর করেছে। তাদের বিচারের জন্যে একটি স্বেচ্ছাচারী ট্রাইবুনাল মনোনয়ন করা হয়েছে। কোন বিচার পদ্ধীত বা সাক্ষ্য ছাড়াই আদালত তাদের ফাঁসীর আদেশ দিয়েছেন।

মৃত্যু পরোয়ানায় মোস্তফা কামালের স্বাক্ষরের জন্যে তার খানকায়ার প্রাসাদে পাঠানো হয়। মৃত্যুদন্ড প্রাপ্তদের একজনের নাম ছিল আরিফ। মোস্তফা কামালের সঙ্গে ঝগড়া করে তিনি বিরোধী দলে যোগ দেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের বিভৎস দিনগুলোতে আরিফ তার পাশাপাশি ছিলেন। আরিফ তার এতই ঘনিষ্ঠ ছিলেন যে তার কাছে পাশা হৃদয়ের সমস্ত কথা খুলে বলতেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন এমন একজন বলেছেন মৃত্যু পরোয়ানা প্রাপ্তির পর গাজলি মুখে সামান্য পরিবর্তনও হয়নি, তিনি কোন মন্তব্য করেননি এবং স্বাক্ষরদানে কুণ্ঠা করেননি। তিনি ধুমপান করছিলেন। এ্যাশটেতে সিগারেটের অবশিষ্টাংশ রেখে তিনি নির্বিকার চিত্তে আরিফের মৃত্যু পরোয়ানার স্বাক্ষর করে পরবর্তী কাজে মনোনিবেশ করলেন।

তিনি সব কাজ যথাযথভাবে করেন। সে রাতেও তিনি ‘খানকায়ায়’ পার্টির আয়োজন করলেন। বিচারক, মন্ত্রী, রাষ্টৃদূত, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, সকল খ্যাতনামা ব্যক্তি এবং সকল সুন্দরী মহিলঅকে আসতে হবে। আঙ্কারায় উৎসব চলতেই হবে।

খুব শান্তভাবে নাচ শুরু হয়। লণ্ডন থেকে তেরী নিষ্কলঙ্ক পোষাক পরে গাজী এক কোণায় কূটনীতিকদের সঙ্গে আলাপ করছিলেন। অতিথিরা খুব সতকৃতার সঙ্গে তাঁকে লক্ষ্য করছিলেন। যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি খোশ মেজাজ দেখাবেন ততক্ষণ সবাইকে সতর্কতার সঙ্গে নীচ স্বরে কথাবার্তা বলতে হয়। তার ক্রোদের সময় কারও আনন্দ প্রকাশ খুবই বিজদজনক। কিন্তু গাজী খুবই খোশ মেজাজে ছিলেন। এটা কোন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান ছিল না। কেবলমাত্র স্ফূর্তি করে রাত কাটানোর অনুষ্ঠান। তিনি বললেন- “আমাদেরকে উৎফুল্ল হতে হবে। আমাদেরকে বাঁচতে হবে। সজাগ হোন”! একথা বলেই তিনি এক অপরিচিতা মহিলার হাত ধরে নাচ গান শুরু করলেন। অতিথিদের একে একে সবাই তার অনুসরণ করলেন। তারা নাচলেন। যদি না নেচে থাকেন গাজী তাদের নাচালেন। গাজী উত্তেজিত হয়ে তার সঙ্গীর পাশাপাশি ঘুরতে লাগলেন এবং সবাইকে নাচের ফাঁকে ফাঁকে পানীয় দিতে লাগলেন।

আঙ্কারা থেকে চার মাইল দূরে। ডজন খানেক বৈদ্যুতিক বাতিতে সমুজ্জল একটি বিরাট মোড়। এর চারিদিকে এবং রাস্তায় বিরাট জনতা সমবেত। বৈদ্যুতিক বাতির নীচে কারাগারের পাথরের দেয়াল ঘেঁষে বিরাটকায় ৮টি কাঠের ত্রিভুজ। প্রতিটির নীচে একজন মানুষ। তার হাত পেছনে টেনে বাঁধা এবং গলার ফাঁস জড়ানো। মোস্তফা কামাল পাশার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা মৃত্যুর মুখোমুখি।

বিরাট নীরবতার মধ্যে প্রত্যেকেই পর পর জনতার উদ্দেশ্যে কিছু বললেন। একজন একটি কবিতা আবৃত্তি করলেন, আরেকজন প্রার্থনা করলেন, তখনও একজন চীৎকার করে বললেন- তিনি তুরস্কের অনুগত সন্তান।

‘খানকায়া’র প্রায় সকল অতিথিই চলে গেছেন। কক্ষগুলো সিগারেটের গোড়া মদমিশ্রিত থুথু, মাদকীয় গন্ধে ভুর ভুর করছিলো। মেঝে, টেবিল সব জায়গায়ই তাস আর টাকা গড়াগড়ি দিচ্ছিল।

মোস্তফা কামাল কক্ষের ভেতর দিয়ে হেটে গিয়ে একটি জানালার পাশে দাঁড়ালেন। তার মুখমণ্ডল স্থির এবং ধূসর; ফ্যাকাশে দৃষ্টি অভিব্যক্তিহীন, তার দেহে ক্লান্তির কোন ছাপ নেই, তার বৈকালিক পোশাক আগের মতই নিষ্কলঙ্ক। পুলিশের কমিশনার জানালেন মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। সমস্ত লাশ ফেলে দেয়া হয়েছে। অতঃপর তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী, তার শক্ররা হয় নিশ্চিহ্ন, নতুবা মৃত অথবা ছিন্নবিচ্ছিন্ন। (পৃঃ ২২৯-২৩৬)

এদিকে তুর্কী জনগণের ধুমায়িত বিক্ষোভ দানা বেঁধে উঠতে লাগল। ১৯২৬ সালে পার্বত্যাঞ্চলের কুর্দী উপজাতিরা কামাল প্রশাসনের বিরুদ্দে প্রকাশ্য বিদ্রোহ করলে ধুমায়িত বিক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে। মোস্তফা কামাল ব্যবস্থা গ্রহণে কালবিলম্ব করেননি। তুর্কী কুর্দীস্থানে বর্বর অত্যাচার শুরু করলেন, গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দিলেন, পশু ও শষ্য ধ্বংস করলেন, মহিলা ও শিশুদের ধর্ষণ এবং হত্যা করলেন। ৪৬ জন কুর্দী নেতাকে জনসমক্ষে ফাঁসী দিলেন। সবশেষে মরলেন কুর্দী নেতা শেখ সাঈদ। তিনি হত্যাকারীর উদ্দেশ্যে বললেন- “তোমার প্রতি আমার কোন ঘৃণা নেই। তুমি এবং তেমার মনিব কামাল আল্লাহর নিকট ঘৃণিত। শেষ বিচারের দিনে আল্লাহর কাছে আমাদের ফয়সালা হবে”।

মোস্তফা কামাল এখন নিরঙ্কুশ একনায়ক। তুর্কী জনগণ টুপি এবং পাগড়ী নিষিদ্ধকরণ, পশ্চিমা পোষাক বাধ্যতামূলক পরিধান, ল্যাটিন হরফ, খ্রীষ্টীয় বর্ষপঞ্জিকা, রবিবার সরকারী ছুটির দিন প্রভৃতি ইসলাম বিরোধী সংস্কারকে অস্ত্রের মুখে মেনে নিলেন। হাজার হাজার উলামা এবং তাদের প্রতি সহানুভূতিশীলরা সত্যের জন্যে প্রাণ দিলেন, তুর্কী জনগণ এসব চেয়েছে এটা বলা সত্যের অপলাপ ছাড়া আর কিছু নয়। আরও বিলম্বের আগেই তুরস্কের বাইরের এবং ভেতরের মুসলমানদেরকে নিম্ন বর্ণিত পদক্ষেপগুলো অবিলম্বে বাস্তবায়ন করতে হবে-

১. তুর্কী মুজাদ্দিদ বদিউজ্জামান সৈয়দ নূরসীল আন্দোলনকে পুরো বস্তুগত ও নৈতিক সমর্থন দিতে হবে। যদিও এটি সরাসরি রাজনীতিতে অংশগ্রহণকে পরিহার করছে তবুও তুরস্কের বুকে এটাই একমাত্র সংগঠন যা নির্ভেজাল ইসলাম প্রচার করছে এবং পশ্চিমীবাদের অনিষ্টকে প্রতিরোধে সক্ষম।

২. যে সব শহর ও গ্রামের জনগণ এখনো ঈমানের প্রতি নিষ্ঠাবান এবং সংবিধান থেকে ইসলাম বিরোধী ধারা বাতিল করে শরিয়তের প্রাধান্যের জন্যে সরকারের কাছে দাবী জানাচ্ছেন সে সব এলাকায় এই আন্দোলনের সমর্থকদেরকে ইসলাম প্রচারে উৎসাহ দিতে হবে এবং সংঘবদ্ধ করতে হবে।

৩. তুরস্কে শিক্ষার সকল পর্যায়ে আরবী ভাষায় কোরআন ও হাদীস অধ্যয়ন বাধ্যতামূলক করতে হবে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের ছাত্রীদেরকে ফার্সী এবং উর্দু অধ্যয়নে উৎসাহিত করতে হবে এবং এ জন্যে উপযুক্ত পাঠ্যক্রম চালু করতে হবে। এই ব্যবস্থা তুরস্কের ভবিষ্যৎ বংশধরদেরকে তাদের অন্যান্য জায়গায় মুসলমান ভাইদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ করে তুলবে।

৪. উসমানীয় আমলের তুরস্কের আরবী পাণ্ডুলিপি শিক্ষার সকল স্তরে পড়াতে হবে। এতে তুরস্কের ইসলামী ঐতিহ্যের উজ্জ্বল নিদর্শন রয়েছে। এতে আমাদের ঐতিহ্যেরও পুনরুদ্ধার হবে যা শুধু তুর্কী নয় অন্য জায়গার মুসলমানদেরও কাজে আসবে।

৫. অসুন্দর অর্ধনগ্ন পোষাক পরিধান করে পশ্চিমা ফ্যাশনে এবং প্রথায় মহিলাদের জনসমক্ষে আসা আইন দ্বারা নিষিদ্ধ করে দিতে হবে। মহিলা বা পুরুষ সকলের জন্যে পশ্চিমা ফ্যাশনের অনুকরণকে নিরুৎসাহিত করতে হবে, ভবিষ্যৎ বংশধরদেরকে ইসলামী নম্রতা ও শিষ্ঠতা শেখাতে হবে এবং সে ধরনের পোষাক পরিধানে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

৬. তুর্কী জনগণকে বোঝাতে হবে যে, পশ্চিমাদের সঙ্গে গোত্রভুক্ত করা তাদের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্হী। তাদের জানা উচিৎ তুরস্ক ন্যাটোর সদস্য হওয়া সত্ত্বেও আমেরিকা এবং বৃটেন গ্রীকের আর্কবিশপ ম্যাকরিয়সকে সমর্থন করছে এবং তুর্কী সাইপ্রিয়টদের বাঁচাবার জন্যে কিছুই করছে না। এটাই হচ্ছে তুর্কীদের প্রতি পশ্চিমাদের প্রীতির নমুনা।

InfotakeBD

View posts by InfotakeBD
InfotakeBD is a information sharing blog, We share information for you. Please visit us and if you want to contribute for this blog please email us infotakebd@gmail.com. Thank you
Scroll to top
error: Content is protected !!