শেখ মোহাম্মদ আবদুহ
শেখ মোহাম্মদ আবদুহ উনিশ শতকের মিশরে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর প্রচেষ্টা তাঁর জীবদ্দশায় ব্যর্থ হলেও তাঁকে খাট করে দেখা যায় না। তাঁর মৃত্যুর পরবর্তী দশকেই তাঁর প্রভাব অনুভূত হয়। মিশরের অধিকাংশ বিচক্ষণ রাষ্ট্রনায়ক, শিক্ষক, সাহিত্যিক প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে তার শিষ্য এবং সহযোগী ছিলেন।
শেখ মোহাম্মদ আবদুহ ১৮৪৯ সালে এক ক্ষুদ্র গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর অভিভাবকরা অশিক্ষিত হলেও ধর্মনিষ্ঠ এবং চরিত্রবান ছিলেন। স্থানীয় মক্তবে তিনি তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। লিখতে এবং পড়তে শেকার পর তাঁর অভিভাবক তাঁকে কোরআন পড়ার জন্যে স্থানীয় একজন হাফেজের কাছে পাঠান। ১২ বছর বয়সে তিনি পরিপূর্ণ কোরআন শরীফ মুখস্ত করেন। পরবর্তী বছর তাঁর অভিভাবক তাঁকে তান্তার মক্তবে পাঠান কিন্তু তিনি সেখানকার শিক্ষা পদ্ধতিতে বিরক্ত হয়ে উঠেন। স্কুল থেকে উপকৃত হবে না এ কথা বুঝতে পেরে তিন নিজ গ্রামে ফিরে যান এবং আর কোন পুস্তক না খোলার অঙ্গীকার করেন। ১৬ বছর বয়সে তিনি বিয়ে করেন, এ সময় পিতার মত মাটি কাটা ছাড়া তাঁর আর কোন উচ্চাকাঙ্খা ছিল না।
অবশ্য ভাগ্যের বিধান ছিল অন্যরূপ। তাঁর এক চাচা তার প্রতি দৃষ্টি দেন এবং তাঁকে সুফীবাদের সঙ্গে পরিচিত করান। এ সময় সুফীবাদে তিনি এতই মগ্ন হয়ে যান যে, এটাই তাঁর জীবনের প্রধান দিক হয়ে পড়ে। নতুন আশায় উদ্বেলিত হয়ে তিনি তান্তায় ফিরে যান এবং লেখাপড়া শুরু করেন। তিনি এতই অসাধারণ প্রতিভাধর ছিলেন যে, খুব সংক্ষিপ্ত সময়ে আল-আজহারে পড়ার জন্যে একটি বৃত্তি লাভ করেন।
শেখ মোহাম্মদ আবদুহ তান্তার মত আল-আজহারের শিক্ষায় হতাশ হয়ে পড়েন। তিনি এর শিক্ষা পদ্ধতিকে বিরক্তিকর, প্রাণহীন এবং গোঁড়ামিপূর্ণ বলে আখ্যায়িত করেন। হতাশ হয়ে তিনি সুফীবাদ ও তপস্যায় আত্মনিয়োগ করেন। পার্থিব জীবনের প্রতি সম্পূর্ণ আকর্ষণহীন জীবনের এই অংশে তিনি জামাল উদ্দীন আফগানীর সাক্ষাৎ পান। তাঁর গতিশীল ব্যক্তিত্ব এবং উৎসাহ তাঁকে ইসলামের সাবেক ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে অনুপ্রাণিত করে। তবে জামাল উদ্দীন আফগানীর মত রাজনৈতিক বিপ্লবকে উদ্দেশ্যে পৌঁছার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ না করে তিনি মনে করেন শিক্ষার মাধ্যমেই তা সম্ভব।
১৮৭৭ সালে শেখ মোহাম্মদ আবদুহ আল-আজহার থেকে আলেম খেতাব নিয়ে স্নাতক পাশ করেন। কিন্তু পুনারায় শিক্ষক হিসেবে সেখানে প্রত্যাবর্তন করেন এবং মুসলিম শিক্ষা পুনরায় চালূকেই তাঁর প্রধান কর্তব্যে পরিণত করেন। পশ্চিমা শিক্ষা এবং বিজ্ঞানকে ইউরোপরে সম্পদ ও শক্তির মাপকাঠি মনে করে তিনি মিশর ও পার্শ্ববর্তী মুসলিশ দেশে তা সম্প্রসারণকে নিজের দায়িত্ব মনে করেন। আল-আজহার মুসলিম বিশ্বের বুদ্দি ও শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র হওয়ায় তিনি ভাবলেন আল-আজহারের সংস্কার করা হলে ইসলামের সংস্কার হয়ে যাবে। তিনি চিরাচরিত শিক্ষাকে আধুনিক যুগের উনুপযোগী আখ্যায়িত করেন এবং শেখ ও উলামারা আধুনিক যুগের সাথে খাপ খাওয়াতে না পারায় তাদের নিন্দা করেন।
শেখ মোহাম্মদ আবদুহ ইউরোপ এবং তার সভ্যতার উৎসাহী গুণগ্রাহী ছিলেন। ইংল্যাণ্ড এবং ফ্রান্স সফর করে তিনি এতই অভিভূত হয়ে যান যে, তিনি বারবার তাঁর আত্মার নবায়নের জন্যে সেখানে ফিরে যান। তিনি বলেন “আমার জনগণের পরিবর্তন সাধনের স্বপ্ন সফল না হওয়া পর্যন্ত আমি কখনো তা নবায়নের জন্যে ইউরোপ যাইনি”। যখনি তিনি মিশরে প্রতিবন্ধকতার কারণে হতাশ হয়েছিলেন তখনি তিনি ইউরোপ গেছেন এবং দুই-তিন মাসের মধ্যে তিনি দেখতে পেয়েছেন আগে যা তার কাছে কঠিন মনে হয়েছে এখন তা খুবই সহজ।
যদিও শেখ মোহাম্মদ আবদুহ ইবনে আরাবীর নেতৃত্বাধনি জাতীয়তাবাদীদের বিপ্লবী গোলযোগের বিরোধী ছিলেন, তিনি কখনো বৃটিশ সহযোগী KHEDIVE- এর বিরুদ্ধে তাদের পক্ষ নেননি। পরবর্তীকালে আরাবী বিদ্রোহীরা ধ্বংস হয়ে গেলে এবং বৃটেন মিশর দখল করার পর শেখ মোহাম্মদ আবদুহকে নির্বাসনে পাঠানো হয়। তক্ষুণি তিনি প্যারিস যান এবং জামাল উদ্দীন আফগানীকে AL URWAH AL WUTHQA লেখা ও প্রকাশে সাহায্য করেন।
অবশেষে ১৮৮৩ সালে খেদাইব তৌফিক পাশা তাঁকে ক্ষমা করে শুদু নির্বাসন শেষ করেননি উপরন্তু তাঁকে স্থানীয় আদালতের কাজী পদে নিয়োগ করেন। তিনি অবশ্য কখনো আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়কে আধুনিকীকরণের প্রদান দায়িত্বের কথা ভুলেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর নিযুক্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তাঁর সম্মান ও প্রভাব বাড়তেই থাকে। শিক্ষকদের সমর্থন লাভের জন্যে তিনি তাঁদের বেতন বাড়িয়ে দেন, আবাসিক সুবিধা বৃদ্ধি করেন। ছাত্রদের আবাসিক সুবিধাও উন্নত করা হয়, তাদের বিনা খরচায় চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন এবং পাঠাগারের সংস্কার সাধন করেন। বস্তুগত সংস্কার ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক আধুনিককীকরণের সূচনামাত্র। তিনি আল-আজহারের পাঠ্যক্রমে আধুনিক ও ধর্মনিরপেক্ষ বিষয় সংযোজন করেন তাকে ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মানে উন্নীত করতে মনোযোগী হন। তিনি এ ব্যপারে নিশ্চিন্ত হন যে, আল আজহারে ইসলাম সংস্কার করা হলে মুসলিম বিশ্বসহ সর্বত্র এর প্রভাব পড়বে। তিনি এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ ছিলেন যে, আল আজহার বর্তমান অবস্থায় চলতে পারে না। হয় এর সংস্কার করতে হবে নতুবা এটা ধ্বংস হয়ে যাবে। অবশ্য শেখ এবং উলামারা বিপরীত ধারণা পোষণ করায় বিরোধিতা অপ্রতিরোধ্য ছিল। এইভাবে তাঁর প্রচেষ্ঠা ব্যর্থতার পর্যবসিত হলেও তাঁর মৃত্যু পরবর্তী সংস্কারের জন্যে তা ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।
হতাশ হয়ে শেখ মোহাম্মদ আল আজহারের প্রশাসনিক কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন। তিনি সম্পূর্ণ পশ্চিমা ধারায় একটি নুতন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্যেই তাঁর স্বপ্নের সফলতা দেখতে পান। তাঁর মৃত্যুর তিন বছর পর ১৯০৮ সালে কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়। ১৮৯৯ সালে বৃটিশের সমর্থনে শেখ মোহাম্মদ আবদুহ মিশরের মুফতী নিযুক্ত হন। শরীয়তের সরকারী ব্যাখ্যাদাতা হিসেবে যে কোন বিষয়ে তাঁর ফতোয়াই চূড়ান্ত বলে গ্রহণ করা হতো। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি এই পদে বহাল ছিলেন।
তাঁর প্রধান লক্ষ্য ছিল ইসলামকে পশ্চিমী সভ্যতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রমাণ করা। তার দু’টি বিখ্যাত ফতোয়ায় মুসলমানদের জন্যে ছবি এবং মূত্যি আইনসিদ্ধ এবং সুদের ব্যবসায় নিয়োজিত ব্যাংকে মুসলমানদের টাকা জমা রাখার অনুমতি দেয়া হয়। তিনি মুসলমানদের জন্যে পশ্চিমা পোষাককেও গ্রহণযোগ্য বলে ফতোয়া দেন।
শেখ মোহাম্মদ আবদুহ মানব মনীষার প্রাধান্যে বিশ্বাসী ছিলেন। ধর্ম কেবলমাত্র মানব মনীষার সহায়তা করে। যুক্তিই ধর্মের যথার্থ বিচারক। সবকিছুর উপরে ইসলাম যুক্তিভিত্তিক ধর্ম, তার সব আদেশ যুক্তি দিয়ে প্রামান্য। শেখ মোহাম্মদ আবদুহ আধুনিক বিজ্ঞানে বিমোহিত ছিলেন। তিনি কোরআনের মধ্যেও তা পেতে চেয়েচিলেন। তাঁর একটি যুক্তির উদাহরণ- “উলামারা বলেন জ্বীন হচ্ছে অদৃশ্য জীবন্ত সত্তা। তবে অতি সম্প্রতি দূরবীনের সাহায্যে যেসব প্রাণীর অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়েছে সেগুলোকেও জীন বলা যেতে পারে। সাম্প্রতিক আবিষ্কারের আলোকে মুসলমানদেরকে চিরাচরিত ব্যাখ্যা পরিবর্তন করতে হবে। কোরআন আধুনিক বিজ্ঞানের বিরোধিতা করার মত অনুদার নয়”।
শেখ মোহাম্মদ আবদুহ শুধুমাত্র পদার্থবিদ্যা বিষয়ক বিজ্ঞানের প্রাধান্যে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি নেতৃস্থানীয় পম্চিমা দার্শনিকদের ব্যাখ্যানুযায়ী সামাজিক বিজ্ঞানের প্রাধান্যেও বিশ্বাস করতেন। তিনি তাঁর অনুসারীদের বোঝাতে চেষ্টা করেন যে, ডারউইনের বিবর্তনের মতবাদ কোরআনেও দেখা যায়।
১৮৮৩ থেকে ১৯০৭ পর্যন্ত মিশরের সত্যিকার শাসক এবং মুসলিম বিশ্বে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের অন্যতম স্থপতি লর্ড ক্রোমার বলেছেন- শেখ মোহাম্মদ আবদুহ খুবই উন্নত প্রকৃতির আলেম ছিলেন। খুবই ভাল প্রকৃতির খেদাইব তৌফিক বৃটিশ চাপের মুখে তাঁকে ক্ষমা করেন এবং বিচারক নিযুক্ত করেন। ১৮৯৯ সালে মোহাম্মদ আবদুহ গ্র্যাণ্ড মুফতি নিযুক্ত হন। তিনি সততার সঙ্গে তাঁর দায়িত্ব পালন করেন। শেখ মোহাম্মদ আবদুহ প্রমস্ত ও সজাগ মনের অধিকারী ছিলেন। তিনি প্রাচ্যের সরকারগুলোর অধীনে গজিয়ে উঠা কুপ্রথাকে স্বীকার করেন। তিনি সংস্কার কাজে ইউরোপীয়দের সহায়তার প্রয়োজনীয়তাও স্বীকার করেন। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে শেখ মোহাম্মদ আবদুহ’র অবহান উল্লেখ করে বলতে হয় ভারতের আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা স্যার সৈয়দ আহমদ খানের মত তিনি মিশরে একটা চিন্তার জগত সৃষ্টি করেন এবং এর মাধ্যমে গোঁড়ামি মুক্ত একটি মুসলিম জাতির পত্তন করেন, তাদের কাজ খুবই কষ্টসাধ্য। সুতরাং তাঁরা সর্বপ্রকার উৎসাহ সমর্থন পাওয়ার যোগ্য। তাঁরা ইউরোপীয় সংস্কারকদের আত্মিক মিত্র। (আধুনিক মিশর পৃঃ ১৭৯-৮০)
বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের লক্ষ্যের সঙ্গে সহযোগিতা এবং আধুনিক জীবনের সঙ্গে ইসলামের আপোষ সংক্রান্ত শেখ মোহাম্মদ আবদহর আকাঙ্ক্ষার ফলাফল অমঙ্গলজনক প্রমাণিত হয়েছে। তিনি তাঁর পরবর্তী পাশ্চাত্য পন্হীদের জন্যে পথ প্রশস্ত করে দিয়ে যান। কাসিম আমীন, আলী আবদ আর রাজিক, মোহাম্মদ কুরদ আলী এবং তাহা হোসাইন তাঁর আত্মপক্ষ সমর্থনকারী উদার ধারাকে যৌক্তিক সমাপ্তিতে টেনে নিয়ে যান। আশ্চর্যের ব্যাপার তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং শিষ্য রশিদ রিজা (১৮৬৫-১৯৩৫) তাঁর যুক্তিবাদে প্রতারিত হননি। রশিদ রিজা আবদুহর লেখা ও চিন্তার সম্পাদনা ও ব্যাখ্যা করেই তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। কিন্তু বছর যেতে না যেতে তিনি তাঁর গুরুর যুক্তির ভ্রান্তি সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠেন। শেখ আবদুহ’র মত পশ্চিমা সভ্যতার সত্যিকার প্রকৃতি সম্পর্কে রশিদ রিজার বিভ্রম ছিল না। জীবন সায়াহ্নে তিনি সঠিক ধারণা লাভ করেন এবং তাঁর গুরুর সবকিছুরই বিরোধিতা করেন।