কাসিম আমিন ও মুসলিম নারী মুক্তি

কাসিম আমিন ও মুসলিম নারী মুক্তি

বিশ্বস্ত সহধমিনী হিসেবে গরে নারীর স্থান। পারিবারিক, ব্যবস্থাপনায় ও সন্তান লালন-পালনে তার দায়িত্ব। পরিবার প্রধান ও পরিবারের ভরণ-পোষণে স্বামীর কর্তৃত্ব। স্ত্রীকে তালাক দেয়া এবং একাধিক বিবাহের বেলায় তার অধিকার, ১৩ শতক ধরে কোন প্রকার প্রশ্ন ছাড়াই আমাদের প্রিয় নবী, তাঁর সাহাবা, ইমাম, ঐতিহ্যবাদী, বিচারক, ধর্মতত্ত্ববিদ এবং সকল চিন্তার আলেমগণ সর্বসম্মতভাবে মেনে আসছেন। মুসলিম বিশ্বের ওপর বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত সার্বজনীনভাবে গৃহীত এসব বিধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সামান্য প্রবণতাও কারও মধ্যে দেখা যায়নি। কোরআন এবং সুন্নায় নারীর যে মর্যাদা দেয়া হয়েছে তাকেই নারী পুরুষ সকলেই সর্বোত্তম বলে মেনে নিয়েছেন।

কাসিম আমিনই প্রথম মুসলমান যিনি পর্দার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছেন। কুর্দী বংশের এই লোকটি পেশাগত দিক থেকে বিচারক এবং শেখ মোহাম্মদ আবদুহ-এর শিষ্য ছিলেন। জীবনের অধিকাংশ সময়ই তিনি কায়রোতে কাটান। ফরাসী শিক্ষার সময় খ্রীষ্টান মিশনারীর তার্কিক ব্যক্তিরা তাঁকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, পর্দা, বহুবিবাহ এবং তালাক প্রথা মুসলমানদের দুর্বলতা ও অধঃপতনের কারণ। যতই তিনি আধুনিক পশ্চিমী সংস্কৃতি অধ্যয়ন করেন ততই তাঁকে হীনমন্যতায় পেয়ে বসে। তিনি লিখলেন; “পরিপুর্ণ সভ্যতা বিজ্ঞানের ওপর নির্ভরশীল। বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠার  আগেই ইসলামী সভ্যতা চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে। সুতরাং একে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা যায় না

”। তিনি যুক্তি দিলেন “অতীতের সকল সভ্যতার মত ইসলামী সভ্যতারও ক্রটি রয়েছে। পরিপূর্ণতার পথ হচ্ছে বিজ্ঞানে। ইউরোপ বিজ্ঞানে সবচাইতে অগ্রসর। সুতরাং ইউরোপ সামাজিক পরিপূর্ণতার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। সব দিক থেকে ইউরোপ আমাদের অগ্রভাগে।

ইউরোপ বস্তুগত দিক থেকে আমাদের চাইত শ্রেষ্ঠ, কিন্তু নৈতিকতার দিক থেকে আমরা শ্রেষ্ঠ- এই ধারণা ঠিক নয়। ইউরোপীয়রা নৈতিকতার দিক থেকেও আমাদের চাইতে অগ্রসর এবং তাদের সকল শ্রেণীই সামাজিক গুণে গুণান্বিত। ইউরোপে নারীর স্বাধীনতা আবেগ অনুভূতির ওপর নয় বরং যৌক্তিক ও বিজ্ঞান ভিত্তিক। ইউরোপের নৈতিকতা ছাড়া বিজ্ঞান গ্রহণ করার আশা বৃথা। দু’টি দিক অবিভাজ্য। অতএব আমাদরেকে জীবনের সার্বিক পরিবর্তনের জন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে”।[Arabic thought in the Liberal age, Albert Hourani, oxford University Press, London, 1962 p-168-169]

এসব চিন্তা কাসিম আমিনকে পর্দার বিরুদ্ধে বই লিখতে অনুপ্রেরণা যোগায়। ১৯০১ সালে The New Women গ্রন্হে তিনি লিখেন “পুরুষ নিরঙ্কুম মনিব এবং নারী দাসী, সে পুরুষের ভোগ বিলাসের লক্ষ্য, এমন একটা কেলনা যা দিয়ে সে যখন যেভাবে খুশি খেলতে পারে। জ্ঞান পুরুষের জন্যে, অজ্ঞতা নারীর। উন্মুক্ত আকাশ আর আলো পুরুষের জন্যে, অন্ধকার এবং বদ্ধ কারাগার নারীর জন্যে। পুরুস আদেশ দেবে নারী অন্ধভাবে তা মেনে চলবে। পুরুষেরই সবকিছু নারী সবকিছুরই অনুল্লেখ্য অংশ”। [Childhood in Modern world, Smual Zwemer p-158.]

কাসিম আমিনই প্রথম মুসলমান যিনি পশ্চিমী ধারায় মুসলমান পরিবারে সংস্কারের ব্ক্তব্য রেখেছেন। তাঁর মতে মুসলিম বিশ্বের সামাজিক সমস্যার সমাধানের এটাই মহৌষধ। “প্রাচ্যের দেশগুলোর দিকে তাকাও দেকবে নারীরা পুরুসের দাসী আর পুরুষরা শাসকদের দাস, পুরুষ তার বাড়ীতে অত্যাচারী, শাসকদের কাছে অত্যাচারিত। ইউরোপের দিকে তাকাও! সরকার স্বাধীনতায় বিশ্বাসী, ব্যক্তিগত অধিকারের মর্যাদা দেয় এবং নারীর মর্যাদা চিন্তায় ও কাজে সর্বোচ্চ আসনে আসীন”।

কাসিম আমিনের মতে মুসলমানদের পতনের প্রকৃত কারণ হচ্ছে অজ্ঞতা বশতঃ সামাজিক গুণাবলী নিমূল করা। পরিবার থেকেই অজ্ঞতার শুরু। নারীর মর্যাদা বাড়াবার জন্যে কাসিম আমিন মহিলাদের জন্য আধুনিক পশ্চিমা শিক্ষার ওকালতি করেন। তাঁর মতে এই জ্ঞান তাদেরকে শুধু ঘরকন্না করতে সাহায্য করবে না উপরন্তু জীবন ধারণের জন্যে আয়েরও সুযোগ দেবে। নারী আত্মনির্ভর না হলে তাকে সব সময় পুরুসের করুণার ওপর নির্ভর করতে হবে। আধুনিক শিক্ষা এই অত্যাচারের পরসমাপিত ঘটাবে এবং তার নিঃসঙ্গার অবসান করবে। নারীকে ঘরের মধ্যে নিঃসঙ্গ রাখা ক্ষতিকর, কারণ এটা অবিশ্বাসের শামিল। পুরুষ নারীকে সম্মান করে না। তারা নারীকে দরজা বদ্ধ করে ঘরে রাখে কারণ তারা নারীকে সম্পুর্ণ মানুষ মনে করে না। পুরুষ নারীকে তার দেহ ভোগের কাজেই ব্যবহার করে। বহুবিবাহেও একই কারণ নিহিত। কোন মহিলাই স্বেচ্ছায় তার স্বামীকে অপর মহিলার সঙ্গে ভাগাভাগি করতে রাজী হবে না, যদি কোন পুরুষ দ্বিতীয় বিবাহ করে তবে তা প্রথম স্ত্রীর অজ্ঞাতেই করে থাকে। তালাক ঘৃণ্য, যদি তা মানতে হয় তাহলে নারীর তালাক দেয়ার অধিকার স্বীকার করে নিতে হবে। নারীরা কেন সমান রাজনৈতিক অধিকার পাবে না? তবে তাদের জনজীবনে অংশ গ্রহণের জন্যে পর্যাপ্ত শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।

The New Women খ্রীষ্টান ও মানবিক আদর্শের কাছে একজন নতজানু চিত্ত আধুনিক মুসলমানের অভিব্যক্তি। এটা পড়ে কারো পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন যে এর লেখক একজন মুসলমান, খ্রীষ্টান মিশনারী নয়!

The New Women- এ মুসলমান সমাজের বিরুদ্ধে যেসব যুক্তি দেয়া হয়েছে এগুলো ভিত্তিহীন। কাসিম আমিন মুসলমান নারীর অবস্থা খোলা মনে বিচার করার পরিবর্তে খ্রীষ্টানদের যুক্তিকেই অন্ধভাবে মেনে নিয়েছেন। সত্যিকার অবস্থা এই যে, এই ক্রমাবনতিশীল যুগে প্রায় প্রতিটি মুসলমান পরিবারে প্রেম-প্রীতি ও সমমর্মিতা বিরাজমান। মুসলমান সমাজের পারিবারিক বন্ধন যে কোন সমাজের চাইতে শক্তিশালী। পারিবারিক ঐতিহ্যানুসারে নারীরা স্ত্রী এবং মা হিসেবে মর্যাদা, সম্মান এবং শ্রদ্ধা পেয়ে থাকেন। নারী স্বামীর অত্যাচারে নয় বরং নিজের স্বার্থেই পর্দা মেনে চলেন।

পশ্চিমা সভ্যতার অন্ধ পূজারী হিসেবে কাসিম আমিন ১৯০১ সালে ভাবতে পারেননি যে, পাশ্চাত্যের স্ত্রী পুরুষের সমানাধিকার আন্দোলন, এক বংশ পর কিভাবে অপরাধ, বিশৃংখলা এবং সার্বজনীন অবৈধ যৌন সম্পর্কের মহামারীর পথ প্রশস্ত করেছে। বাড়ী ও পরিবারের সম্পূর্ণ অনৈক্যের ফলে পশ্মিী সভ্যতা নারীত্বের জন্যে বড় নিষ্ঠূর প্রমাণিত হয়েছে। একদিকে তারা চায় প্রকৃতির ভার নারী একলা বহন করুক এবং অপরদিকে সে চায় বাইরেও সে পুরুষের সঙ্গে বহুমুখী দায়িত্ব পালন করুক। এইভাবে তাকে দুটি শান পাথরের মাঝে আড়াআড়িভাবে বসানো হয়েছে। এছাড়া পুরুষদের কাছে লোভনীয় ও আকর্ষণীয় করে তোলার নামে তাদের স্বল্প পোষাক এমনকি নগ্নতার দিকে ঠেলে দেয়া হয়। তারা পুরুষদের হাতের খেলনায় পরিণত হয়েছে।

ইসলামই নারীর সব চাইত বড় রক্ষা কবচ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। কারণ তা প্রতিটি নারীকে একজন পুরুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছে এবং সকল পুরুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। প্রকৃতি প্রদত্ত দায়িত্ব পালনের জন্যে ইসলাম তাকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে। অপরদিকে পশ্চিমা সভ্যতা তাকে অগণিত পুরুষের দাসীতে পরিণত করেছে এবং নারীত্বের মর্যাদা বৃদ্ধিকারী সকল কাজের প্রতি তার বিতৃষ্ণা সৃষ্টি করেছে। বাড়ী ও পরিবার সম্পর্কিত ইসলামের শিক্ষা সত্যিকার নারী প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।[মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদীর ব্যক্তিগত পত্র থেকে, ১লা এপ্রিল, ১৯৬১।]

শতাব্দীর প্রারম্ভে কাসিম আমিন খ্রীষ্টান মিশনারী ও পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদের সমর্থন নিয়ে পর্দার বিরুদ্ধে বই-এর মাধ্যমে যে অভিযান শুরু করেছেন তার প্রচুর সাফল্য এসেছে। তাঁর চেষ্টার ফলে প্রতটি মুসলিম দেশে মহিলারা আগাছার মত লাফাতে শুরু করলো এবং মুসলিম নারীর সত্যিকার ভূমিকা ধ্বংস করতে এবং পশ্চিম দেশের বোনের মত নিজের জীবনকে গঠন করতে কৃতসংকল্প হলো।

InfotakeBD

View posts by InfotakeBD
InfotakeBD is a information sharing blog, We share information for you. Please visit us and if you want to contribute for this blog please email us infotakebd@gmail.com. Thank you
Scroll to top
error: Content is protected !!