ডঃ তাহা হোসাইন : মিশরের বুদ্ধিজীবিদের মূর্ত প্রতীক
প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে ড৬ তাহা হোসাইন মিশরের বুদ্ধিজীবি সম্প্রদায়ের মূর্ত প্রতীক ছিলেন তাঁর গুণগ্রাহীরা তাঁকে শেখ মোহাম্মদ আবদুহর শিষ্য বলতেন। তবে ডঃ তাহা হোসাইন কখনো তাঁর সাহচর্যে ছিলেন কিনা এটা সন্দেহের বিষয়। অবশ্য তাঁর আধুনিক চিন্তা এবং কাজকমৃ তাঁকে প্রভাবিত করেছে এতে কোন সন্দেহ নেই।
নীল নদের উপরিভাগের একটি ক্ষুদ্র গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। শিশু অবস্থায় তিনি চক্ষু রোগে আক্রান্ত হন। অন্ধ হওয়া সত্ত্বেও তাহা হোসাইন মাত্র ১৩ বছর বয়সে সম্পূর্ণ কোরআন মুখস্থ রাখার কৃতিত্ব দেখান। এই সময় তিনি হাফেজ হিসাবে আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্তি লাভ করেন। কায়রোয় অধ্যয়নকালে তিনি ইউরোপীয় ছাত্রদের সাহচর্য লাভের চেষ্টা করেন। তাদের সমকক্ষ হওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে হতাশায় তিনি আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেন, তাঁর এই প্রাথমিক জীবনের বিবরণ আধুনিক আরবী ভাষায় লিখিত ‘দিনের স্রোত’ নামক আত্মজীবনীতে রয়েছে। কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর তাঁকে পি এইচ ডি ডিগ্রী দেয়া হয় এবং সরকারী বৃত্তি দিয়ে প্যারিসে অধ্যয়নের জন্যে পাঠানো হয়। সেখানে তিনি আরেকটি পি এইচ ডি ডিগ্রী লাভ করেন এবং তাঁর স্ত্রী সুজানে ব্রেসু-র সাক্ষাৎ পান। ১৯১৮ সালে তিনি এই মহিলাকে বিয়ে করেন। মিশরে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী সাহিত্যের অধ্যাপক নিযুক্ত হন এবং পরে এর ডীন নিযুক্ত হন। এই সময় তিনি তাঁর বিতর্কিত গ্রন্হ ‘ইসলামী গোঁড়ামীর’ তীব্র সমালোচনা সম্বলিত বইটি রচনা শুরু করেন।
১৯২৬ সালে প্রতারণামূলক শিরোনামযুক্ত ‘ইসলাম পূর্ব কবিতা সম্পর্কিত বইটি প্রকাশিত হলে বোমা বিস্ফোরিত হয়। এই বই এর লক্ষ্য ছিল কোরআন এবং হাদীসের যথার্থতা সম্পর্কে সন্দেহ সৃষ্টি করা। খোদা মানুষের মন সৃষ্টি করেছেন যা সন্দেহ করে তৃপ্তি এবং উদ্বেগ ও বিমূঢ়তার মধ্যে আনন্দ পায়। এই পদ্ধতির প্রয়োজনীয় ফলাফল খুবই গুরুত্বপূর্ণ তার পরিণাম বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব ছাড়া আর কিছুই নয়।
এই গ্রন্হে ডঃ তাহা হোসাইন ইসলামের ইতিহাসের প্রথমদিকের চিন্তানায়ক, বিচারক এবং ধর্মতত্ত্ববিদদের সম্পর্কে পরিহাস করার কোন সুযোগই নষ্ট করেননি। তাঁর মতে তাঁরা স্পষ্ট চালকির দ্বারা কোরআন সৃষ্টি এবং হাদীস তৈরী করেছেন। এতে সন্তুষ্ট না হয়ে তিনি আরও লিখেন মূসা (আ) নামে কেউ ছিলেন না এবং ইব্রাহিম (আ) ও ইসমাঈল (আ) সম্পর্কিত কোরআনের কাহিনী রূপকথার রাজ্য থেকে নেয়া। তাওরাতে ইব্রাহিম এবং ইসমাঈল সম্পর্কে বলা হতে পারে এবং কোরআন ও তাদের কথা বলতে পারে কিন্তু কোরআন এবং তাওরাতে তাদের কথা বলাই তাদের অস্তিত্বের জন্যে যথেষ্ট নয়। কোরআন ইব্রাহিমের পুত্র ইসমাঈলের মক্কায় অভ্যুদয়ের কথা এবং সেখানে আরব জাতির জন্মের কতা বলা হয়েছে। আমরা এই গল্পের মধ্যে আরব এবং ইহুদী জাতি এবং ইসলাম ও ইহুদী ধর্মের মধ্যে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্যে এক ধরনের রূপকথা দেখতে বাধ্য।[Egypt in search of political Community p-155.]
তাঁর অপর গ্রন্হ The Future of Culture in Egypt সমসাময়িকদের মনে বিরাট প্রভাব ফেলেছে। ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত এই গ্রন্হের লক্ষ্য হচ্ছে মিশরকে সাংস্কৃতিক দিকে থেকে ইউরোপের অংশ হিসেবে প্রতীয়মান করা এবং সেভাবে জনশিক্ষার কর্মসূচী প্রণয়ন। ডঃ তাহা হোসাইন বলেন- মিশর কি পূর্বের না পশ্চিমের? আররা বিষয়টির ব্যাখ্যা এভাবে করতে পারি। একটি মিশরীয়মন কি চীনা, বা হিন্দু বা ইংরেজ অথবা ফরাসীকে সহজে বুঝতে পারবে? আমাদের সাংস্কৃতিক ভিত্তি সম্পর্কে চিন্তা করার আগে আমাদেরকে এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। (পৃঃ৩)
এরপর তিনি ব্যাখ্যা দিয়ে বলেনঃ ইতিহাসের শুরু থেকে দু’টি পৃথক প্রতিদ্বন্দ্বী সভ্যতা বিরাজমান ছিল। একটি ইউরোপের অপরটি দূর প্রাচে। ইতিহাসের কি সরল ব্যাখ্যা! যদি স্মরণাতীত সময় থেকে ইউরোপেই একক সভ্যতা না থেকে থাকে দূর প্রাচ্যের ব্যাপারে এটা কতদূর প্রযোজ্য। দূর প্রাচ্য সাংস্কৃতিক দিক থেকে কখনো একরূপ ছিল না। হিন্দু ভারত এবং কনফুশিয়াসের চীনের পার্থক্য মধ্যযুগীয় ইউরোপের সঙ্গে পার্থক্যের মতই সুস্পষ্ট।
গ্রীসের সঙ্গে প্রাচীন মিশরের সম্পর্ক এবং দূর প্রাচ্যের সঙ্গে যোগাযোগের অভাবের কারণে ডঃ তাহা হোসাইন যুক্তি দেন যে, মিশর বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে সব সময় ইউরোপের অবিচ্ছেদ্য অংগ ছিল। বিজ্ঞ ডক্টর ভুলে গেছেন যে, কেবলমাত্র মহামতি আলেকজাণ্ডারের দ্বারা হেলেনীয় যুগেই মিশর সাংস্কৃতিক দিক থেকে ইউরোপের সঙ্গে এক ছিল। তবে pericles এবং Byzantium এর এথেন্স এর চাইতে ফেরাউনী এবং ইসলামী মিশরের ঐতিহাসিক পারম্পর্য কম ছিল।
ডঃ তাহা হোসাইন জোর দিয়ে বলেন ইসলাম এবং আরবী ভাষা গ্রহণের ফলে মিশর যতটুকু প্রাচ্য রূপ নিয়েছে খ্রীষ্টান ধর্ম গ্রহণ করে ইউরোপ তার চাইতে বেশী পরিবর্তিত হয়েছে। মিশরের সবচাইত বিজ্ঞ ব্যক্তি ইসলাম এবং খ্রীষ্টান ধর্মের মধ্যে কোন ঐতিহাসিক পার্থক্য স্বীকার করেন না। তাঁর দেশের পশ্চিমীকরণে ইসলামের কোন বাধা নেই- এ কথা প্রমাণের জন্যে তিন ইতিহাসের ঘটনাবলীর নীতি জ্ঞান শূণ্য বিকৃতি ঘটিয়েছেন।
“আমরা মিশরীয়রা পশ্চিম থেকে আমাদের গ্রহণের পরিমাণের ভিত্তিতে আমাদের জাতীয় অগ্রগতি পরিমাপ করে থাকি। আমরা ইউরোপের কাছ থেকে শিখেছি কিভাবে সভ্য হতে হয়। ইউরোপীয়রা আমাদের টেবিলে বসে কাঁটা চামচে খেতে শিখিয়েছে। মেঝে শোওয়ার পরিবর্তে বিছানায় শু’তে এবং পশ্চিমা পোষাক পরিধান করতে শিখিয়েছে। আমরা আমাদের সরকার পরিচালনার জন্যে খেলাফত থেকে কোন পথনির্দেশ চাই না। এর পরিবর্তে আমরা জাতীয় ধর্মনিরপেক্ষ আদালত প্রতিষ্ঠা করেছি, ইসলামী আইনের বিকল্পে পশ্চিমা ভাবধারার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আইন প্রণয়ন করেছি। আমাদের সময়ের অনস্বীকার্য সত্য হচ্ছে আমরা দিন দিন ইউরোপের নিকটবর্তী হচ্ছি এবং সবদিক থেকে তার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হচ্ছি। (পৃঃ ১১-১২)
ডঃ তাহা হোসাইনের মতে ইউরোপীয়দের সঙ্গে মিশরীয়দের মৌলিক পার্থক্য থাকলে পশ্চিকীকরণ কষ্টকর হবে। একইভাবে এই ব্যাপারে জাপানের তুলনায় পিছিয়ে থাকার জন্যে তিনি তাঁর জাতিকে তিরস্কার করেন- আমরা কি চীনের ধর্ম ও দর্শন গ্রহণ করবো যখন তারা দ্রুত পশ্চিমীরূপ নিচ্ছে? যেসব মিশরবাসী পশ্চিমা সভ্যতাকে উপহাস করে তারা কখনো চীনা বা হিন্দুদের মত বাস করতে চাইবে না।
ডঃ তাহা হোসাইন কেন চেয়েছেন তাঁর জাতি দু’টির যে কোন একটি গ্রহণ করুক। কেন মিশরীয়দেরকে হয় ইংরেজ নতুবা চীনা হতে হবে? কেন তারা মুসলমান হিসেবে গর্ববোধ করবে না্ ডঃ তাহা হোসাইন উদ্দেশ্য- প্রণোদিতভাবে এই প্রশ্ন এড়িয়ে গেছেন। সম্ভবতঃ স্বতন্ত্র্য ও পূর্ণাঙ্গ সভ্যতার ধারক হিসেবে ইসলামকে তাঁর পাঠকদের চোখে খাট করার জন্যই তিনি এই প্রশ্ন এড়িয়ে গেছেন।
‘মিশর ইউরোপের অংশ’ খেদিব ইসমাঈলের এই বিবৃতিতে বাড়াবাড়ি বা অতিরঞ্জন নেই। খোদা যদি আমাদেরকে তুর্কী বিজয় থেকে রক্ষা করে থাকেন আমরা ইউরোপের সঙ্গে এবং তার রেনেসাঁর সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য থাকব। এটা মিশরীয়দের জন্যে নিম্চয়ই একটা স্বতন্ত্র সভ্যতার সৃষ্টি করবে, যার মধ্যে আমরা এখন বাস করছি (পৃঃ৯)। অবশ্য খোদা আমাদের দুর্ভাগ্য এবং দুযোর্গ পুষিয়ে নেয়ার দায়িত্ব দিয়েছেন। বর্তান অগ্রগতি সাধনের জন্যে বিম্বকে শত শত বছর সংগ্রাম চালাতে হয়েছে। এক জেনারেশনের মধ্যেই এখন আমরা সেই অগ্রগতি সাধন করতে পারব। সুযোগ গ্রহণ না করলে আমাদের জন্যে তা দুঃখজনক হবে। সত্যিকার ঘটনা হচ্ছে মধ্যযুগে ইসলামী বিশ্বে যা বিরাজিত ছিল ইউরোপীয়রা তা গ্রহণ করেছে। আমরা এখন যা করছি তারাও তাই করছে। এটা মাত্র সময়ের হেরফের। (পৃঃ১৩)
ডঃ তাহা হোসাইনের মত অধিকাংশ হীনমন্য সাহিত্যিকদের মত হচ্ছে- ইউরোপীয়রা আরবদের কাছ থেকে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসার প্রেরা সঞ্চার করেছে, সেই কারণে পশ্চিমীকারণ প্রচেষ্টায় মুসলমানরা শুধু মাত্র তাদের ঐতিহ্যিক অধিকার ফিরে পাওয়ার দাবী করছে। এই ধরনের ভ্রান্তিপূর্ণ যুক্তি দিয়ে আধুনিক শিক্ষিত মুসলমানরা তাদের ঈমান পরিত্যাগ করাকেই আইনসঙ্গত করতে চাচ্ছে। ডঃ তাহা হোসাইন এই ঐতিহাসিক সত্যকে অস্বীকার করছেন যে, মুসলিম বিশ্ব থেকে গ্রীক শিক্ষা ইউরোপে আসার অর্থ কখনো তাকে ইসলামী সভ্যতার অংশ হওয়া নয়। যদিও মধ্যযুগের ইউরোপ মুসলিম বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের সাফল্যকে স্বাগত জানিয়েছে, সে কখনো তার সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ত্যাগ করেনি, যা ডাঃ তাহা হোসাইন তাঁর দেশের জন্যে চাচ্ছেন।
“কোন শক্তিই মিশরীয়দেরকে ইউরোপীয় জীবন পদ্ধতি থেকে দূরে রাখতে পারবে না। সভ্যতার ক্ষেত্রে ইউরোপীয়দের সমকক্ষ হওয়ার জন্যে মিশরীয়দেরকে পুরোপুরি পশ্চিমা সভ্যতার অনুকরণ করতে হবে। যে এর বিপরীত পরামর্শ দেবে হয় সে প্রতারক নতুবা নিজে প্রতারিত। (পৃঃ ১৫)
১৯৫২ সারে বাদশাহ ফারুককে ক্ষমতাচ্যুত করার কিছু পূর্ব পর্যন্ত ডঃ তাহা হোসাইন শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন। এ সময় তিনি তাঁর কর্মসূচী বাস্তবায়নের চেষ্টা করেন। তিনি আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়কে যুগোপযোগী করার জন্যে বিস্তারিত পরামর্শ দেন। প্রেসিডেন্ট জামাল আবদুল নাসের তাঁর এই পরামর্শ গ্রহণ করে ১৯৬১ সালের ১৮ই জুলাই এক আদেশ জারী করেন। এই আদেশে আল আজহার তার সরাসরি নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ডঃ তাহা হোসাইনের কর্মসূচী মোতাবেক প্রেসিডেন্ট জামাল আবদুল নাসের আল আজহারে সম্পূর্ন ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা পদ্ধতি চালূ করেন। নতুন পরিকল্পনায় ইসলামের স্টাডিজ বিভাগ অপাংতেয় এবং নৈর্বাচনিক বিষয়ে পরিণত হয়। ডঃ তাহা হোসাইনের পরামর্শে প্রেসিডেন্ট মাত্র একটি আঘাতে বিশ্বের ইসলামী শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ধ্বংস করে দেন।
ডঃ তাহা হোসাইনের পক্ষ সমর্থনকারী ক্ষমা প্রার্থীদের মধ্যে কেউ কেউ বলেন তিনি যৌবনের কার্যাবলীর জন্যে দুঃখিত, তার সাম্প্রতিক লেখায় ইসলামের প্রতি বেশ আনুগত্যের স্বাক্ষর রয়েছে। সুতরাং তার পূর্বেকার কাজের জন্যে তাকে ক্ষমা করা উচিৎ। আমি তা বিশ্বাস করি না। তার লেখার কুফল রচনার সময়ের চাইতে এখন বেশী প্রকট অথচ তিনি প্রকাশ্রে আগের লেখার ভুল স্বীকার করেননি এবং এ জন্য ক্ষমাও প্রার্থনা করেননি।