রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ইসলাম বনাম আরববাদ

রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ইসলাম বনাম আরববাদ

অনেক সরলপ্রাণ কিন্তু ভুল পথে পরিচালিত মুসলমান বিশ্বাস করেন আল্লাহ আরবী ভাষায় কোরআন নাযিল করেছেন, হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (রা) এবং তার প্রাথমিক অনুসারীরা ছিলেন আরব অতএব সমগ্র আরব ঐতিহ্য ইসলামী সাংস্কৃতিক ঐহিহ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। শত শত বছর ধরে মুসলমানরা এই বংশসূত্রে গর্ববোধ করে আসছেন অথচ তারা ভুলে যান যে, ইসলামের সবচাইতে বড় শক্রু আবু জেহেল, আবু লাহাব মহানবীর খুবই নিকটতম আত্মীয় ছিলেন। সরলপ্রাণ মুসলমানরা আরব জাতীয়তাবাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে চিন্তা করে থাকেন- আরবই হচ্ছে দারুল ইসলামের প্রাণ কেন্দ্র অতএব পর্যায়ক্রমিক মুসলিম ঐক্যের জন্যে আরবের সংহতির সংগ্রাম অপরিহার্য। তাদের মতে আরব জাতীয়তাবাদ বিদেশী প্রভুত্বের বিরুদ্ধে আরবদের বিদ্রোহ প্রকাশ করে। এসব সরলপ্রাণ লোকেরা যদি আরবদের সূত্রপাত, ইতিহাস এবং আদর্শ সম্পর্কে অবহিত হতেন তাহলে কখনো তাকে ইসলামের সঙ্গে গোঁজামিল দেয়ার কথা ভাবতেন না।

বর্ণ, ভাষা, গোত্র এবং স্বাদেশিকতার শ্লোগান আরব জাতীয়তাবাদ হাজার হাজার বচর আগে প্রাক-ইসলামী আরবে জন্ম নেয়। যখন কোরআন এবং মহনবী (স)-এর শিক্ষায় খুব জোর দেয়া হলো যে, ঈমানদাররা বর্ণ, ভাষা, জন্মসূত্র নির্বিশেষে একে অপরের ভাই তখন তারা খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করলেন। ইসলামের শিক্ষা হচ্ছে প্রতিটি মানুষকে তার কাজের হিসাব আল্লাহর কাছে দিতে হবে অপরদিকে আরবাদের শিক্ষা ছিল তার জবাব দিতে হবে গোত্র প্রধানের কাছে। তার নিজের গোত্রের বাইরে যে কোন নিষ্টুর আচরণের অনুমতি ছিল। প্রাচীন আরবদের সত্যিকার কোন ধর্ম ছিল না। আধুনিক ইউরোপীয় ও মার্কিনীদের মত তারা পুরোপুরি বস্তুবাদী ছিল। হযরত (স)-এর জন্মের প্রায় একশত বছর আগের একটি কবিতায় পার্থিব জীবনের যে বর্ণনা দেয়া হয়েছে তার মূল বক্তব্য হচ্ছে- সুস্বাদু খাদ্য, সুপেয় পানীয়, সুন্দরী নারী, আরাম-আয়েশের জীবনই মানুষের একমাত্র কাম্য। জীবন সংক্ষিপ্ত বা দীর্ঘ হোক মৃত্যু অনিবার্য। অতএব যেটকু সময় হাতে পাওয়া যায় তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা দরকার। আরবী সাহিত্যের সবচাইতে উচ্চ প্রশংসিত কবিতা হচ্ছে ইমরুল কায়েসের ‘the golden ode’ নবীর জন্মের প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে এটি রচিত হয়। ‘মোয়াল্লাকাত’ কবিতায় কবি তার চাচাতো বোনের সঙ্গে তার অবৈধ সম্পর্কের যে বিবরণ দিয়েছেন তার মধ্যে দৈহিক সংসর্গ, যৌন সম্ভোগ, রূপের বর্ণনা, সঙ্গমের আগে ও পরের অনুভূতি তার প্রতি চাচাতো বোরনের আচরণ- প্রভৃতি ইনিয়ে বিনিয়ে তুলে ধরা হয়েছে।

এইভাবে প্রাক ইসলামী আরবী সভ্যতা এবং সংস্কৃতি ভোগবাদী ও বস্তুবাদী দর্শনে আকীর্ণ ছিল। আব্বাসীয় এবং উমাইয়া শাসনামলেও এসব অনিষ্টকর জিনিসের প্রাধান্য বিরাজিত ছিল। অপরদিকে প্রাক ইসলামী আরবের সারল্য, মনুষ্যত্ব, সাহস এবং কঠোর পরিশ্রমের দিকটি সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যাত হয়। ৮১০ খৃঃ আবু নুয়াসের কবিতায় তার জন্মস্থান বাগদাদের যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে তাতে ভোগ বিলাস এবং আরাম-আয়েশের কথা ছাড়া আর কিছু নেই।

ইসলামের আবির্ভাবের শত বছর পরও জাহেলিয়াত বা অন্ধকার আরব যুগের আচার প্রথার প্রাধান্য বিরাজিত ছিল। প্রাক ইসলামী আরব যুগের ক্লাসিক্যাল কবিতার যুগের পর আরেকজন কবি খুবই সুখ্যাতি অর্জন করেন। তিনি হচ্ছেন আবু তৈয়ব আল মুতান্নবী। তার নামে শাব্দিক অর্থ হচ্ছে ভূয়া নবী। তাঁর কবিতায় তিনি প্রাক ইসলামী আরব পূর্বসূরীদের আদর্শকে সমুন্নত করেন। আরবী সাহিত্যের অপর খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব সিরিয়ার অন্ধ কবি আবুল আলা মারী (৯৭৩-১০৫৭)। তিনি তার ‘লুজুমিয়াতৱ কবিতায় নাস্তিকতার প্রচার করেন।

এইসব কবিরা তাদের কাব্যের মধ্য দিয়ে যে ভাব প্রকাশ করেছেন তা আরবী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইসলামের বিশ্বাস এবং ইসলামী ধ্যান-ধারণা সঙ্গে এ সবের কোন সঙ্গতি নেই। পাঠক আরব সংস্কৃতির আবরণে আরব জাতীয়তার কিছুটা পরিচয় পেলেন। আমরা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এ প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করব। অনেকে জেনে আশ্চর্যান্বিত হবেন যে, মার্কিন প্রটেষ্টান্ট মিশনারীদের সরাসরি প্রভাব ও পৃষ্ঠপোষকতায় লেবাননে প্রথম আরব জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন দু’জন খ্রীষ্টান পণ্ডিত Nasif yazeji (1800-1971) এবং utrus Bhustani (১৮১৯-১৮৮৩)। তাদের নীতি বাক্য ছিল দেশপ্রেম ঈমানের একটি অঙ্গ। পশ্চিমা পাণ্ডিত্যের চশমায় আরব ইতিহাস অধ্যয়ন করে তারা সিদ্ধান্ত পৌঁচেন যে, আরবী সভ্যতার উপকরণ ইসলামের অধীন নয়। তারা আরব প্রেমের মাহাত্ম্য প্রচারমূলক কবিতার দ্বারা তুর্কী শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের উত্তেজিত করেন।

বৈরুতের মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে আরব জাতীয়তাবাদ আন্দোলন চূড়ান্ত শক্তি লাভ করে। ১৮৬৬ সালে মিশনারী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত প্রথম দিকে সিরীয় প্রটেষ্টান্ট কলেজ নামে পরিচিত এই কলেজের প্রভাব শীগগীরই সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে অনুভূত হয়। বৈরুত বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামের শক্র সৃষ্টির ব্যাপারে বিশেষ স্বাতন্ত্রের দাবী করতে পারে। খুবই চাতুর্যের সঙ্গে মুসলমান ছাত্রদের বিভিন্ন পাঠ্যক্রম এবং পাঠ্য বহির্ভূত কাজের মাধ্যমে ইসলামের আচার অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধে মানসিকভাবে গড়ে তোলা হয়। ইসলাম বিরোধী প্রচারণা এতই শক্তিশালী ছিল যে, অধিকাংশ ছাত্রই ইসলামের আচার-অনুষ্ঠান পরিত্যাগ করে। সব চাইতে খারাপ ব্যাপার হচ্ছে এসব ব্যক্তিরাই বংশ পরস্পরায় আরব বিশ্বের নেতৃত্ব লাভ করে।

প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে মিশর-এর দ্বারা মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়। কারণ তুর্কী অত্যাচারে বহু খ্রীষ্টান এবং মুসলমান গ্রাজুয়েট সেখানে আশ্রয় নেয়। খেদিব ইসমাঈল তাদের স্বাগত জানান তাঁর নীতিবাক্য “মিশর ইউরোপের একটি অংশ”।

মিশরে প্রথম যিনি জাতীয়তাবাদের সংগ্রাম করেন তিনি হচ্ছেন লুৎফী আসসাঈদ। শিষ্যদের কাছে তিনি ছিলেন জেনারেশনের শিক্ষক। তিনি ফেরাউনের কাছ থেকে সাংস্কৃতিক প্রেরণা লাভের জন্য তার দেশবাসীর প্রতি আহবান জানান। তিনি বলেন প্যান ইসলামের জন্যে আমাদের কোন সহানুভূতি নেই কারণ এটা ধর্ম এবং আমাদের বিশ্বাস জাতীয়তা ও প্রগতিই আমাদের খ্যাতনামা পদক্ষেপের পথ নির্দেশিকা। লুৎফী আসাঈদের একজন খ্যাতনামা সহকর্মী হচ্ছেন সাদ জগলুল। তার সময়ই মিশরের রাজনীতি থেকে ইসলামের সর্বশেষ প্রভাব বিতাড়িত হয়। তার নীতিবাক্য ছিল- “ধর্ম আল্লাহর জন্যে এবং দেশ জনগণের জন্যে”। আজ পর্যন্ত তিনি আরব জাতীয়তাবাদের গুরু হয়ে আছেন। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামে মুসলমানদের উচিত আরব জাতীয়তাবাদীদের সমর্থন করা এই মনোভাব প্রচার পদ্ধতির প্রতারণামূলক ভ্রান্তি। আরব বিশ্বের সাম্প্রতিক ইতিহাসের সতর্ক পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে তারা সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতার পরিবর্তে তাকে উৎসাহিত করার জন্যেই সবকিছু করেছেন।

ফিলিস্তিনের দুঃখনক ঘটনা শুধু আরবদের নয় বরং সমগ্র মুসলিম বিশ্বের জন্যে একটা দুযোর্গ। জাতীয়তাবাদীরা ফিলিস্তনে আরব অধিকারের মূখ্য রক্ষাকর্তা হিসেবে নিজেদেরকে তুলে ধরে সকল মুসলমানের কাছ থেকে ব্যাপক সহানুভূতি পেয়েছেন। অন্যান্য বিষয় বাদ দিয়ে তারা কেবল এ বিষয়ে বহু গ্রন্হ লিখেছেন এবং বক্তৃতা দিয়েছেন। কিন্তু আমরা কি দেখি? ইংরেজদেরা কাছে যেমন ইংল্যান্ড ঠিক তেমনি ইহুদীদের কাছে ফিলিস্তিনকে গড়ে তুলতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ Chaim Weizmann এবং অন্যান্য শীর্ষ স্থানীয় নেতার সঙ্গে আমারী ফয়সল আপোষ আলাচনা করেছেন। পরবর্তী দশকে ইহুদীরা ক্রমেই শক্তিশালী হয়েছে। তবে তার মত অনেক আরবই ইহুদীদের কাছে জমি বিক্রি করে প্রচুর অর্থের মালিক হয়েছেন। ১৯৪৯ সালের অক্টোবরে ওয়াশিংটনে সিরিয়ার সাবেক মন্ত্রী এবং সিরীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের রেকটর Dr. Zurayk ‘the meaning of disaster’ নামে ফিলিস্তিন সম্পর্কে একটি গ্রন্হ প্রকাশ করেন। তিনি লিখেন- ইস্রাইলের ইহুদীরা বর্তমানে বাস করছে, ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আছে আর আমরা আরবরা এখনও অতীতের স্বপ্ন দেখছি। আরবদের চিন্তা ও কাজে বিপ্লব সাধন করে নতুন সমাজ গঠন করতে হবে। এই সমাজকে হতে হবে গণতান্ত্রিক সর্বোপরি প্রগতিমনা। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্যে-

১. রাষ্ট্র থেকে ইসলামের প্রভাব সম্পূর্ণ নির্মূল করতে হবে।

২. শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রয়োগিক ও পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।

৩. আধ্যাত্মিক, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং পশ্চিমা সভ্যতার বস্তুগত দিকের প্রতি উদারমনা হতে হবে।

উপরোক্ত বক্তব্য থেকে বোঝা যায় যে, ইহুদীদের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্যে জাতীয়তাবাদীরা ইহুদীদের অনুসারী হওয়া অপরিহার্য মনে করতেন। যারা আধুনিক আরব জাতীয়তাবাদ ও ইসলামের মধ্যে কোন পার্থক্য দেখেন না তাদের জন্যে কিছু বক্তব্য তুলে ধরা হলো- আরবী ভাষা প্রষঙ্গে বুলেটিন অফ দি ইজিপশিয়ান এডুকেশন ব্যুরো পত্রিকার ১৯৪৭ সালের মে সংখ্যায় The teaching of Araic শিরোনামে আহমদ খাকী লিখেন- মিশরের কথিত আরবী, আঞ্চলিক আরবী এবং কোরআনের ক্লাসিক্যাল আরবীর মধ্যে বিরাট ব্যবধার বিরাজমান। আমাদের অধিকাংশ শিশুই চিন্তা ও কথা বলে একভাবে এবং পড়ে ও শিখে অন্যবাবে। যদিও ভাষার দু’টি ধারার মধ্যে একই শব্দ রয়েছে, লিখিত ভাসার জন্যে ব্যাকরণের যে নীতি অনুসৃত হয় তাতে অনেক শব্দের রূপ পরিবর্তন ও অবস্থানের পরিবর্তন প্রয়োজন। না হয় ১০ বছরের আরব বালকের জন্যে কোরআনের ভাষা বোধাতীত থেকে যাবে।

যতদিন বাড়ীতে কথিত আরবী ভাষা আঞ্চলিক থাকবে এবং যতদিন স্কুলের পাঠ্যক্রমের অধিকাংশ ভাষা এই আরবী থাকবে ততদিন এটাই প্রধান জীবন্ত ভাষা। কোরআনের ক্লাসিক্যাল ভাষা বিশ্বাস হিসেবেই থেকে যাবে। আমাদের যুবকেরা এ ধরনের বিলাস বরদাশত করবে না এবং এটা যদি তাদের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেয়া হয়, এটাতে পাণ্ডিত্য অর্জিত হল কি না সে পরোয়া তারা করবে না।

The ideas of Arab nationalism গ্রন্হে জর্দানের পররাষ্ট মন্ত্রী Hasem Zaki nuseibah বলেছেন- আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষতার আলোকে একটি জাতি হিসেবে আবরদেরকে প্রথম থেকে শুরু করতে হবে। বস্তুতঃ তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে একনজ আরবের কাছে ধর্মই যখন জীবনের ভিত্তি হয় তখন ভাল ব্যবহারে গুণাগুণ ও মাপকাঠি নির্ধারিত থাকে। এই মাপকাঠি সকল সময় এবং সব জায়গায় গৃহীত হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে- ধর্মনিরপেক্ষ ভিত্তির কারণে ইসলামের ঐতিহাসিক ঐতিহ্য উমাইয়া শাসনকে সার্বজনীনভাবে নিন্দা করা হয়ে থাকে। এসব ইতিহাসের অধিকাংশই আব্বাসীয় যুখে লেখা হয়েছে, ফলে পক্ষপাতিত্ব এড়ানো সম্ভব হয়নি। অবশ্য এতেও সন্দেহের অবকাশ নেই যে, ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাপারে বাড়াবাড়ির কারণে উমাইয়ারা সাধারণ মুসলমানদের বিরাগভাজন হন।

একজন আধুনিক আরব জাতীয়তাবাদীকে উমাইয়াদের প্রতি তার পূর্ব পুরুষদের দেয়া রায়কে পুনঃ ব্যাখ্যা ও পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। আধুনিক জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণায় উমাইয়াদের ধর্মনিরপেক্ষ কাজের প্রশংসা করতে হবে যা এক সময় নিন্দিত হয়েছিল। উমাইয়াদের পতনের সঙ্গে সঙ্গে আবরদের ভাগ্যের বিপর্যয় ঘটেছে পৃঃ ৬১-৬২। National consciousness গ্রন্হে Dr. Zurayk ইসলামের ইতিহাসকে উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্যে কিভাবে ব্যাখ্যা করেছেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় নিম্নোক্ত উদ্ধৃতিতে- মুহাম্মদ (স) শুধু আরবদের নবী ছিলেন না বরং আরব ঐক্যের স্থপতি ছিলেন। কেউ কেউ বলতে পারেন তখন ধর্মীয় বন্ধন জাতি বন্ধনের চাইত শক্তিশালী ছিল এবং ইসলাম আরববাদের চাইতে জোরদার ছিল। এর উত্তর হচ্ছে মধ্যযুগে এর বিপরীত হওয়া সম্ভব ছিল না এবং এটা ইসলামিক প্রাচ্য ও খ্রীষ্টিয় পাশ্চাত্যের বেলায় একইভাবে সত্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইসলামের ইতিহাসের প্রথম দিকে আমরা আরবদের মধ্যে বেশ সচেতনতা দেখতে পাই যখন ধর্মীয় আবেগ খুবই উত্তপ্ত ছিল। মুসলমানরা অনারব খ্রীষ্টানদের চাইতে আরব খ্রীষ্টানদের প্রতি অনেক উদার ছিলেন এবং কিছু আরব খ্রীঃ প্রথম দিকে মুসলমানদের পাশাপাশি ধর্ম প্রচার করেছেন। আরব গোত্রের সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার পর এই আরব সচেতনতা আরও বৃদ্ধি পায়। পার্সী, তুর্কী এবং অন্যান্যদের হামলার মোকাবিলায় এই ভাব আরও জোরদার হয়। এই ভাব আজ পর্যন্ত জোরদার হচ্ছে, জাতীয়তাবাদের বন্ধন অন্য সকল বন্ধনের চাইতে শক্তিশালী। (পৃঃ ১২৮-৩২)

এর ফলে আমরা দেখি প্রেসিডেন্ট জামাল আবদুল নাসের মিশরের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে আসওয়ান বাঁধের ফলে সৃষ্ট পানিস্ফীতি থেকে প্রাক-ইসলামী আরবদের মন্দির এবং মূর্তি রক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। তিনি সব সময় ফেরাউনের গুণকীর্তন করে গান গাইতেন এবং তাকে আরবদের গৌরব বলে আখ্যায়িত করেন। কায়রোয় বিরাট মূর্তি স্থাপন করে তার স্মৃতি রক্ষা করা হয়েছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে আমরা নির্ভয়ে বলতে পারি আরব প্রত্নতত্ববিদরা শীগগীরই আরব ঐতিহ্য বৃদ্ধির জন্য বালি খনন শুরু করবেন। তারা কি পাবেন বলে মনে করেন! হুব্বাল, আললাত, আল মানাত, আল উজ্জা! হ্যাঁ এসব মূর্তি পুনরায় কাবা গৃহে স্থাপিত হবে এবং তখন হজ্জের প্রধান বৈশিষ্ট্য হবে আবু জেহেল ও আবু লাহাবের প্রশংসা কীর্তন করে কে কত সুন্দর কবিতা লিখতে পারে। এই হবে জাতীয়তাবাদের প্রতিযোগিতা্

এই বিপর্যয় প্রতিরোধের জন্যে আরব মুলমানদেরকে সজাগ হতে হবে এবই এই পদক্ষেপসমূহ নিতে হবেঃ

১. ডঃ সাইদ রজমানের নেতৃত্বে আল ইখওয়ানুল মুসলিমুন-এর পুনরুজ্জীবনের জনে পূর্ণ সমর্থন ও আর্থিক সহযোগিতা দিতে হবে। মুসলিম ভ্রাতৃসংঘই আরবে একমাত্র আন্দোলন যা নির্ভেজাল ইসলামের প্রচার করেছে এবং জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতিরোধ করতে সক্ষম। বিশ্বের অন্যান্য যায়গার মুসলমানদেরও ইখওয়ানের পুনরুজ্জীবনের জন্যে মিশরের উপর চাপ সৃষ্টি করা উচিৎ।

২. আরবের ভবিষ্যৎ বংশধরদেরকে এটা বোঝাতে হবে যে, আরব জাতীয়তাবাদের শ্লোগান খ্রীষ্টান মিশনারী, ইহুদীবাদ এবং বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্ত। আরবদেরকে ইসলামী বিশ্ব থেকে দুরে সরানোই এই চক্রান্তের একমাত্র লক্ষ্য।

৩. আরব নেতাদেরকেও বুঝতে হবে যে, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র বা মার্কসবাদ নয় বরং ইসলামই আরব ঐক্য সংহত করতে পারে। বিশ্বের মুসলমানদের সঙ্গে ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় ঐক্য পুনঃ প্রতিষ্ঠার জন্যে শিক্ষা ব্যবস্থা ও গণসংযোগ মাধ্যমের সাহায্যে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে।

৪. আরব যুবকদেরকে বোঝাতে হবে যে, ফিলিস্তিন সমস্যা কেবল আরবদের নয় বরং সমগ্র মুসলিম বিশ্বের উদ্বেগের কারণ। ইহুদীবাদের বিরুদ্ধে বিলম্ব ছাড়াই সর্বাত্মক জিহাদ সংগঠন করতে হবে। মুসলিম ভ্রাতৃসংঘের নেতৃত্বে সমগ্র বিশ্বের মুসলমান যুবকদেরকে নিযে আন্তর্জতিক বাহিনী গঠন করতে হবে।

৫. এই ব্যাপারে প্রক্যাত ঐতিহাসিক ইবনে খালদুনের (১৩৩২-‌১৪০৬) মন্তব্যের প্রতি আমি আরবদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি- নবীর ঐশী বাণী ছাড়া রাজনৈতিক ঐক্য ও স্থায়িত্ব অর্জয়নে আরবরা অক্ষম। কারণ চারিত্রিক কঠোরতা, গর্ব, বর্বরতা এবং রাজনৈতিক ব্যাপারে পরস্পরের প্রতি হিংসা তাদের মজ্জাগত। ইচ্ছা ও আকাঙ্কার ঐক্য ছাড়া এগুলো দূরীভূত হওয়া খুবই কষ্টকর। নবীর ধর্মই তারেদ রুক্ষতা ও প্রতিহিংসাকে দমন করতে পারে। কারণ এই ধর্মই তাদেরকে বর্বর জাতি থেকে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত করেছে। তাদের মধ্যে এমন ব্যক্তির আবির্ভাব হওয়া উচিৎ যিনি তাদেরকে সত্যের দিকে আহ্বান জানাবেন, অসত্য থেকে বিরত রাখবেন। তবেই তারা ঐক্যবদ্ধ হতে পারবে এবং নেতৃত্ব করতে পারবে। (মুকাদ্দীমা)

InfotakeBD

View posts by InfotakeBD
InfotakeBD is a information sharing blog, We share information for you. Please visit us and if you want to contribute for this blog please email us infotakebd@gmail.com. Thank you
Scroll to top
error: Content is protected !!