ইসলামের ইতিহাসের পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তা
ইসলামী জ্ঞানের সবচাইতে বড় প্রয়োজন হচ্ছে কোরআনের ভিত্তিতে ইসলামের ইতিহাসের পুনর্মূল্যায়ন। অতীতের মুসলিম সভ্যতার ব্যাপারে যেসব ব্যাখ্যা বর্তমানে চালূ রয়েছে, তা ইসলামের জন্যে খুবই ক্ষতিকর। আমাদের পণ্ডিতেরা যতদিন এ ধরনের ক্ষমাপ্রার্থী রোমান্টিকতায় নিয়োজিত থাকবেন ততদিন ইসলামী পুনর্জাগরণ মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে। ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের আবির্ভাবের পর থেকে মুসলমানরা নিজেদেরকে এতই অপদস্ত ও হীনবল ভাবতে শুরু করেছেন যে, অতীতের কাল্পনিক চিত্র অংকন আমাদের লেখকদের ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। অতীত ঐতিহ্য গাঁথা প্রণয়নে তারা অনেক ক্ষেত্রেই বাড়াবাড়ির পরিচয় দিয়েছেন এবং মুসলিম সাম্রাজ্যের বস্তুগত ও পার্থিক সুখ-সমৃদ্ধিকে ইসলামী সমৃদ্ধি হিসেবে চিত্রিত করার প্রয়াস পেয়েছেন। তারা কখনো বিষয়টি চিন্তা করে দেখেননি যে, এই পার্থিব উৎকর্ষতা ও শ্রীবৃদ্ধি ইসলামের কোন কল্যাণে এসেছে কিনা।
পণ্ডিতদের এটা জানা থাকা উচিৎ ছিল যে, মুসলিম ছদ্মাবরণে বিধর্মী আচরণকে কোরআন নিন্দে করেছে। অতীতের ব্যাপারে আমাদের মতামত পুনর্গঠনে আমাদেরকে এই মুহূর্তে পশ্চিমা ধর্মনিরপেক্ষ ও বস্তুবাদী বিকৃত দৃষ্টিতে ইতিহাসের মূল্যায়ন বন্ধ করতে হবে। প্রথমতঃ আমাদের স্মরণ রাকা উচিৎ ‘মুসলিম’ সংস্কৃতির উদগাতা হিসেবে পরিচিত আলকিন্দি, ইবনে ফারবী, ইবনে সিনা এবং ইবনে রুশদ প্রাচীন গ্রীক দর্শনের আলোকে ইসলামের ব্যাখ্যা দেয়ার কারণে তাদের যুগের প্রখ্যাত আলেমদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। পরবর্তী পর্যায়ে তাঁদের খ্যাতি ইউরোপেই সীমাবদ্ধ ছিল। মুসলিম বিশ্বে তাদের কোন প্রভাব ছিল না। পশ্চিম দেশীয় প্রাচ্য গবেষকদের দ্বারা নতুন করে পরিচিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত মুসলিম বিশ্বে তাদের নামগন্ধও ছিল না।
তথাকথিত ‘মুসলিম’ দর্শন সক্রেটিস, প্ল্যাটো এবং এরিষ্টটলেরই শিক্ষা, ইসলামের সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই। বেশ কয়েক শতক ধরে মুসলিম বিশ্বে উন্নতিপ্রাপ্ত বিজ্ঞান এবং গণিত শাস্ত্রের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। দুঃখজনক সত্য হচ্ছে, মুসলিম নামধারী অধিকাংশ বিজ্ঞানী এবং গণিত শাস্ত্রবিদই মুতাজিলা ঐতিহ্যের অনুসারী। যদিও প্রাকৃতিক বিজ্ঞনের বিভিন্ন বিভাগে তাদের সাফল্য গ্রীক এবং রোমের প্রাচীন দর্শনেই সীমাবদ্ধ। অবশ্য এ কথার অর্থ এ নয় যে, ইসলাম ঐতিহ্যগতভাবে বিজ্ঞান গবেষণার বিরোধী। এর অর্থ হচ্ছে ঐতিহাসিক ঘটনা পরম্পরায় প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ধর্ম বিরোধী মূল্যবোধের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে। এটা এইরূপ হওয়া উচিৎ ছিল না, কিন্তু হয়ে গেছে।
আমাদের মহান মুজাদ্দিগণ মুতাজিলাদের দর্শন প্রত্যাখ্যান করলেও পদার্থ বিজ্ঞানে তাদের সত্যিকার অবদানকে অস্বীকার করেননি।
মুসলিম বিজ্ঞানী এমনকি আমাদের শ্রেষ্ঠ মুজাদ্দিদগণও বিজ্ঞানকে গ্রীক দর্শনমুক্ত করে কোরআনের ভিত্তির উপর স্থাপন করার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে বিজ্ঞান ইসলামের শক্রদের হাতে চলে গেছে এবং মুসলিম বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মানুষগুলো সুফীবাদ এবং ধর্মতত্বিক বিচার-বিশ্লেষনে আত্মনিয়োগ করেছেন। এই সুযোগ ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ তার উন্নত প্রযৌক্তিক সমরাস্ত্রের দ্বারা মুসলমানদের ওপর প্রাধান্য বিস্তার ও প্রভুত্ব করার সুযোগ পেয়েছে।
আমাদের পণ্ডিত এবং ঐতিহাসিকদেরকে এই বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। রোমান্টিকতা ও স্বেচ্ছাচারী চিন্তায় কোন লাভ নেই। অতীতে মুসরিম সংস্কৃতিতে যেসব প্রাচীন ধ্যান-ধারণা অনুপ্রবেশ করেছে তা প্রত্যাখ্যঅন করতে হবে। কারণ এখানকার ধর্মবিরোধী শক্তির মতই এগুলো ইসলামের সঙ্গে আপোষহীন। শুধুমাত্র বস্তুবাদী মেধা ও পার্থিব সাফল্য না দেখে আমাদেরকে ধর্মনিষ্ঠার বিচারে যারা শ্রেষ্ঠ তাদের কাছ থেকে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক প্রেরণা নিতে হবে।