ইসলাম কি বিশ শতকীয় ধারণার সঙ্গে আপোষ করতে পারে?
‘আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারলে ইসলামকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে হবে’। প্রতিটি মুসলিশ দেশের আধুনিক শিক্ষিত মুসলমানদের মুখে বারবার একথা শোনা যাচ্ছে। তারা সব সময় আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, আমরা অতিক্রান্ত যুগের ধ্যান ধারণা নিয়ে বাঁচতে পারি না। আমাদেরকে শেখানো হচ্ছে যে, ঘড়ির কাঁটা পেছনের দিকে ঘোরানো অবস্তাব, কারণ ইতিহাসের গতি কেউই পরিবর্তন করতে পারে না। অতএব ক্রম পরিবর্তনশীল ধর্মনিরপেক্ষ সমাজের সঙ্গে ঈমানকে খাপ খাওয়ানো ছাড়া আমাদের আর গত্যন্তর নেই। শক্তিশালী হওয়ার জন্যে আমাদেরকে কোরআনের চিরাচরিত ব্যাখ্যা বর্জন করতেহবে এবং আধুনিক জীবনের আলোকে যুক্তিসঙ্গতভাবে তা অধ্যয়ন করতে হবে। মুসলিম দেশের সরকারসমূহ নিজেদের লক্ষ্য অনুযায়ী ইসলামের সংস্কারের সুপারিশ করেছেন। আমরা এখন সবচাইতে গুরুত্বপুর্ণ সুপারিশসমূহ এবং ইসলামী সম্প্রদায়ে তার ফলাফল খতিয়ে দেখব।
সুবিধাবাদের দ্বারা প্রভাবিত দুনিয়ায় ইসলামী রাষ্ট্র ধর্মযাজকমণ্ডলীর অভিসম্পাতগ্রস্ত বস্তু। আধুনিক শিক্ষিত নেতারা আমাদেরকে খেলাফতের ধারণা সম্পূর্ণ বিলোপ করে ভবিষ্যতে এর পুনরুজ্জীবনের সকল দ্বার রুদ্ধ করে দেয়ার পরামর্শ দেন। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি এবং সরকারকে ‘মধ্যযুগীয়’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। অতএব আধুনিক বিশ্বে স্থান পাওয়ার জন্যে মুসলমানদেরকে ধর্মনিরপেক্ষ শাসনের সঙ্গে আপোষ করতে হবে। এই যুক্তির সারবত্তা প্রমাণের জন্যে আমাদের সকল অনিষ্টের মূলে খেলাফতকে দায়ী করে মুসলিম পুস্তক [Islam and Principles of govt (Al- Islam wa usul Alhukm) Ali Abd Al Raziq, Cairo, 1925 from here we start (min Huna Nabda) Khalid Mohmad Khalid, Cairo, 1950.] লেখা হয়েছে। দাবী করা হয়েছে যে, খেলাফত ইসলামদের অংশ নয় কারণ মহানবীর মিশন ছিল কেবলমাত্র প্রচারণার মধ্যে সীমাবদ্ধ। তিনি কখনো শাসনের ইচ্ছা প্রকাশ করেননি। কেবলমাত্র অপরিহার্য তাকে বাধ্য করেছিল। বুদ্ধিবৃত্তিক অসাধুতা পঙ্কে নিমজ্জিত হয়েছি। ইসলামী সমাজ ছাড়া ইসলাম বাঁচতে পারে না এবং ইসলামী সমাজ সুসংগঠিত নেতৃত্ব ছাড়া সম্ভব নয়।
আমাদের আধুনিক শিক্ষিতরা শরিয়তকে যুগের অনুপযোগী এবং এর বিচার পদ্ধতিকে পশ্চিমা বিচার পদ্ধতির চাইতে নিম্নমানের মনে করেন। তাদের মতে কেবলমাত্র ধর্মনিরপক্ষ আইনই সমাজের কল্যাণ সাধন করতে পারে। [A Modern Interpretetion of islam, Asat Ali Fyazee, Asia Publishing House, Bombay, 1963.] অবৈধ যৌন সম্পর্ক, মদ্যপান, জুয়া এবং সুদে টাকা ধার দেয়ার জন্যে কোরআন ও সুন্নাহের আরোপিত শাস্তিকে নিষ্ঠুর এবং অমানুষিক বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আইনের শিথিলতা থেকেই কি তার গুণাগুণ বিচার্য? অপরাধীরা কি সমাজের চাইতেও বেশী সহানুভূতি পাওয়ার অধিকারী? আইনের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া নৈতিক মূল্যবোধ কি শীগগীরই ফাঁকা উক্তিতে পরিণত হয় না?
বর্ণ, ভাষা এবং ভৌগলিক পার্থক্যের উর্ধে ইসলামের বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব জাতীয় সার্বভৌমত্বের প্রাধান্যেল সঙ্গে সামাঞ্জস্যহীন। এই কারণে একে বিশ শতকের ধ্যান ধারণার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্যে আমাদের আধুনিক শিক্ষিত নেতারা উম্মতের স্থলে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ [Turkish nationalism and Western civilization. Ziya gokalp, Columbia university Press, New York, 1859.] কে গ্রহণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এর ফলে বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন এবং নিঃসঙ্গ হয়ে পড়বে। অভিন্ন ইসলামী ঐতিহ্যের পরিবর্তে আমাদের নেতারা পৌরণিক ঐতিহ্যের ওপর জোর দেন, ভাবখানা এমন যে তা ছিল স্বর্ণযুগ, ইসলাম আমাদেরকে তা থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। এই কারণে তুর্কী জাতীয়তাবাদীরা ওসমানীয় যুগকে বিদেশী সংস্কৃতি ও ভাষার আধিপত্য বলে ঘৃলা করেন এবং একই ধ্যান ধারণার বশবর্তী হয়ে রেজা শাহ পাহলভী আর্যসম্প্রদায়ের কথিত আবাসভূমি হিসেবে ‘পারস্যকে’ ইরানে রূপান্তরিত করেন।
আরবী মূল পাঠ ছাড়া কোরআনের আনুষ্ঠানিক অনুবাদের জন্যে অব্যাহত চীৎকারের পিছনেও জাতীয়তাবাদী চিন্তাদারা কাজ করেছে। তুরস্ক, মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ায় ল্যাটিন হরফ চালু এবং অনারব মুসলিম দেশে আরবীকে অবজ্ঞা করে ইংরেজী ভাষার প্রাধান্য, চলিত ভাষার পরিবর্তে সর্বোকৃষ্ট ভাষা প্রচলনের জন্যে আরব জাতীয়তাবদীদের দাবীকে জোরদার করেছে। এই প্রচেষ্টা ভবিষ্যৎ বংশধরদের কাছে কোরআনের ভাষাকে ক্রমেই অস্পষ্ট করে তুলছে। আরবী মূল পাঠ ছাড়া কোরআনের অনুবাদ শুধুমাত্র উম্মাৎকেই ধ্বংস করবে না উপরন্তু (খোদা না করুন) মূল পাঠকেও বিকৃত করবে।
প্রতিটি মুসলিম দেশেই যারা কর্তৃত্ব ও প্রভাব প্রতিপত্তি নিয়ে থাকেন তারা দুনিয়ার সঙ্গে সকল প্রতিযোগিতার জন্যে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রয়োগের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তারা ভাল মন্দ বিচার না করে আধুনিক সভ্যতার সকল অবদানকে গ্রহণের জন্যে জোর দেন। অন্য কথায় তারা বোঝাতে চান যে, আমাদের সমাজকে শক্তিশালী করতে হলে কোন প্রকার বাছবিচার ছাড়াই জনগণের জীবন যাত্রার মানোন্নয়নের জন্যে বিদেশী কারিগরি ‘সাহায্য’ কর্মসূচী, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও শিল্পায়ণ করে দারিদ্র, রোগ ও নিরক্ষরতা দূর করতে হবে। যারা মনে করেন যে, আমরা কেবলমাত্র আধুনিক সভ্যতার ভাল দিক গ্রহণ করব এবং খারাপ দিক বর্জন করব তাদের মনে রাখা উচিৎ যে প্রত্যেক সভ্যতারই স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে। কোন সংস্কৃতির একটি বিশেষ দিককে পৃথক করা যায় না বরং তার একটি অপরটির ওপর নির্ভরশীল।
এই কারণে কোন সভ্যতার বাস্তব সাফল্য তার মৌলিক চরিত্রের প্রভাবমুক্ত হতে পারে না। আধুনিকতাবাদের শিষ্যরা এতই অর্থনৈতিক বাতিকগ্রস্ত যে, অর্থনীতিই তাদের বিচারের একমাত্র মাপকাঠি। পরকালকে অস্বীকার করার ফলে মার্কিন এবং ইউরোপীয়রা তাদের সকল প্রচেষ্টা স্বাস্থ্য ও দৈহিক আরাম আয়েসের জন্যে ব্যয় করে। পার্থিক সমৃদ্ধির জন্যে পর্যায়ক্রমে তারা এক্ষে্রে সকল মানুষকে পশ্চাতে ফেলে যায়। ইসলাম সহ অন্যান্য সভ্যতা কখনও এই সাফল্য অর্জন করতে পারে না। এর কারণ নীতিগতভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে অস্বীকার নয় বরং জীবনের অন্যান্য দিককে তারা আরও গুরুত্বপূর্ণ মনে করে সেদিকে দৃষ্টি দেয় বলে।
মুসলিম নারী মুক্তিকে সামাজিক অগ্রগতির জন্যে অপরিহার্য [The new woman, Qassim Amin bey, cairo 1901.] মনে করা হয়। নারীত্ববাদীরা নারী মুক্তি বলতে অত্যাধুনিক ফ্যাশন অবলম্বন, ঘরের বাইরে চাকুরী নেয়া, পরিবার ও বাড়ীর সঙ্গে অনিবার্য সম্পর্কচ্ছেদের মাধ্যমে জনজীবনে পূর্ণ অংশ গ্রহণকে বুঝিয়ে থাকেন। মুসলিম বিশ্বের প্রতিটি সরকার পাশ্চাত্যের পোশাক পরিচ্ছদ গ্রহণকে উৎসাহিত করেন। তুরস্ক আইনের মাধ্যমে পশ্চিমা পোশাক গ্রহণ বাধ্যতামূলক করে এই ক্ষেত্রে চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। পশ্চিমা পোশাককে প্রগতি ও অগ্রগতির প্রতীক এবং চিরাচরিক পোশাককে পশ্চাৎপদতার চিহ্ন আখ্যায়িত করা হয়। এই পোষাক ক্রমেই গ্রামের গরীব জনগণের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। মূসলমানিত্বের দৃষ্টিগোচর চিহ্নকে বর্জন এবং ইসলাম বিরোধী সভ্যতার পোশাক, কারুকার্য এবং জীবন পদ্ধতি গ্রহণ স্বধর্ম ত্যাগের নামান্তর। [Islam at the Cross Roads, Mohammad assad, Lahore 1904. Nationalism and India, Maulana Maudoodi, Pathankot 1939] আমাদের মহানবী বেঈমানদের অনুকরণকারীদের নিন্দা করার সময় এ বিষয়ের ওপর খুবই গুরুত্ব আরোপ করতেন।
এইভাবে আমরা দেখেছি যে, কেন বিশ শতকীয় প্রেরণার সঙ্গে ইসলামকে খাপ খাওয়ানো সম্ভব নয়। আমরা মুসলমানরা আধুনিক জীবনের সঙ্গে ইসলামকে খাপ খাওয়ানোর যতই চেষ্টা করব ততই দুর্বল হয়ে পড়ব। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নয় বরং সময়ের প্রতিকূলে লড়াই করেই আমরা শক্তিশালী ও জোরদার হবো।