মাওলানা আবুল কালাম আযাদ মুসলিম ভারতের জাতীয়তা ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রবক্তা
মুসলমানদের মোলিক গলদ হচ্ছে ইসলামকে পরিসমাপ্ত পদ্ধতি হিসেবে ব্যাখ্যা করা। বাইরের সত্য থেকে শুধু নয় বাইরের জনগনের জন্যেও তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ভারতের মুসলমানদের এবং ইসলাম সম্পর্কে মৌলিক আশার কথা হচ্ছে এ সম্প্রদায় তা ভাঙ্গতে পারে…. তারা অন্য ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে ভ্রাতৃসুলভ মানবীয় আচরণের জন্যে চেষ্টা করতে পারে। (পৃঃ ২৯০)। অতীতে রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং সামাজিক সংস্থা ইসলামের এতই মুখ্য বিষয় ছিল সবকিছু হাঁ অথবা না দিয়ে বিবেচনা করা হতো। মুসলমানদের হয় রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল অথবা ছিল না। এর আগে কখনও তারা অন্যের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করেনি। ইসলামের দ্বার বন্ধ- এই থে এই বিশ্বাস জন্মেছে যে, মুসলমানদের সামাজিক গ্রুপ বা দল একটি আইনানুগ পরিপূর্ণ সংগঠন। এই বিশ্বাসই পরিশেষে ইসলমাকে ভারতে অনুপযুক্ত প্রমাণ করেছে। (পৃঃ ২০৬-৭) [Islam in modern History, Wilfred cantwell smith Princetion university press. 195]
একজন খ্যাতনামা প্রাচ্যবিদ ভারতের মুসলমান ও হিন্দুদের সম্পর্কের বিষয়টি এভাবে দেখেছেন। মাওলানা আবুল কালাম আযাদ এই ভ্রান্তিপূর্ণ বিশ্লেষণকে আন্তরিকভাবে সমর্থন করেছেন। তিনিই প্রথম আধুনিক জাতীয়তা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে হিন্দু মুসলিম ঐক্যের কথা বলেন।
মাওলানা আবুল কালাম আযাদ সম্পূর্ণ ইসলামী পরিবেশে গড়ে উঠেন। তার বাবা মাওলানা মোহাম্মদ খয়েরুদ্দিন একজন জ্ঞানী পণ্ডিত ছিলেন এবং আরবী ফারসী ভাষায় বহু গ্রন্হ প্রণয়ন করেন। ভারতের সব এলাকায় তার হাজার হাজার শিষ্য ছিল। ১৮৫৭ সালে বৃটিশ বিরোধী বিক্ষোভ দমন করার পর হাজারো মানুষের মত মাওলানার বাবাও জীবনের তাগিদে দিল্লী ছেড়ে পালিয়ে যান। তার বিশ্বস্ত শিষ্যরা ব্যবস্থা করার পর তিনি আরবে চলে যান এবং মক্কায় আশ্রয় নেন। সেখানে তিনি নগরর খুবই ধার্মিক এবং বুজুর্গ ব্যক্তির কন্যার পানি গ্রহণ করেন। মহিলাটি খুবই বুদ্ধিমতি এবং আরবী ভাষার একজন পণ্ডিত ছিলেন। এই মহিলার গর্ভেই ১৮৮৮ সালে আবুল কালাম আযাদ জন্মগ্রহণ করেন। তার মা অন্য কোন ভাষা না জানার কারণে আরবীই তার মাতৃভাষা হয়। প্রাথমিক শিক্ষার জন্যে তাকে কোন বিদ্যালয়ে পাঠানো হয়নি। বরং তার মা বাবা এবং তার বাবার বন্দু আরবী পণ্ডিতদের কাছে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। ১৮৯৮ সালে একজন শিষ্যের জরুরী অনুরোধে তিনি ভারতে ফিরে আসেন এবং কলকাতায় বসবাস শুরু করেন। এখানে গৃহশিক্ষকের কাছে বালক আবুল কালাম আযাদ আরবী, ফার্সী, দর্শন, যুক্তিবিধ্যা, অঙ্ক, ভূগোল এবং ইতিহাস অ্যয়ন করেন। সাধারণভাবে এই বিদ্যা অর্জনে ১৪ বছর সময় লাগে। অসাধারণ মেধাবী আবুল কালাম ৪ বছরেরও কম সময়ে এই বিদ্যা অর্জন করেন। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিপদ অনুভব করে তার বাবা পশ্চিমা সভ্যতা এবং তার সকল বাহনের কঠোর বিরোধিতা শুরু করেন। ইংরেজী শিক্ষা এবং স্যার সৈয়দ আহমদ খানের নেয়া ইসলামের আধুনিক ব্যাখ্যাকে ধর্মের প্রতি অভিসম্পাত মনে করেন।
আবুল কালাম আযাদ প্রকৃতপক্ষে অসাদারণ প্রতিভাধর ব্যক্তি ছিলেন। মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি ইমাম আল গাজ্জালীর জীবনী লেখার আগ্রহ প্রকাশ করেন। ১৬ বছর বয়সে তিনি শ্রদ্ধেয় আলেম হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। অবসর সময়ে তিনি শিল্পগুণ সম্পন্ন অর্থহীন উর্দু কবিতা লেখেন। ১৪ বছর বয়সে Lisanus Sidq ‘সত্যের কণ্ঠ’ নামে পত্রিকা প্রকাশ করে সাংবাদিকতা শুরু করেন। ১৯৪০ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়স তিনি বার্ষিক ভাষণ দানের জন্যে আঞ্জুমানে হেমায়েত-ই-ইসলাম কর্তৃক লাহোরে আমন্ত্রিত হন। তার বক্তব্যের বিষয় ছিল “ধর্মের যৌক্তিক ভিত্তি”। তাঁর শ্রোতাদের মধ্যে উর্দূ গল্পকার নাজির আহমদ, কবি হালি এবং আল্লামা ইকবালের মত ব্যক্তিত্বও ছিলেন। তার বক্তৃতা এতই আকর্ষণীয় ছিল যে, এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সারা ভারতে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। কবি হালি তাঁকে যুবকের কাঁধে বৃদ্ধের মাথা বলে আখ্যায়িত করেন।
যৌবনের মধ্যভাগ ও শেষ দিকে তিনি তার ভবিষ্যৎকর্মপন্ঞা ঠিক করেন। তার মনে ইসলামই প্রাধান্য পেয়েছে এবং মুসলমান ভাইদের সাহায্যের দিকটিই তিনি বেশী করে ভাবতে থাকেন। এ্ই বাবে ১৯১২ সালে মাত্র ২৪ বছর বয়সে সাপ্তাহিক আল হিলাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তার কর্মজীবন শুরু করেন। এই উর্দু পত্রিকাটি মুসলিম বিশ্বব্যাপী বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের অসৎ উদ্দেশ্যের কঠোর সমালোচনার মাধ্যমে মূলতঃ জালাম উদ্দীন আফগানীর Al Urwah al Wuthqa- এরই দৃঢ় স্বাক্ষর বহন করে। সাংবাদিকতার মাধ্যমে আবু কালাম আযাদ নিজেকে প্রথম শ্রেণরি সাহিত্যিক মেধা হিসেবে প্রমাণ করেন। এই পত্রিকায় খুবই যুক্তিসঙ্গত বক্তব্যের মাধ্যমে স্যর সৈয়দ আহমদ খানের আলীগড় আন্দোলনের বিরুদ্ধে জোরালো অভিযান শুরু করেন। তিনি আধুনিক শিক্ষা এবং যে কোন ধরনের পশ্চিমী ধ্যান ধারণার বিরুদ্ধে যুক্তি দিতে থাকেন। তিনি কি ভারতে রাজনীতির চরমপন্হী অথবা মধ্যপন্হীদের অনুসরণ করছেন কিনা জানতে চাইলে কোন মুসলমান কোন ব্যাপারে অন্য কাউকে অনুসরণ করতে পারে এই ধারণাকে উপহাসের সঙ্গে উড়িয়ে দেন। তারা আল্লাহর বাছাইকৃত ব্যক্তি এবং তাদের জন্যে সুস্পষ্ট পথ রয়েছে। তিনি নিজে কোরআন অনুসরণ করেছেন এবং তার ধর্মাবলম্বীদেরকেও কোরআন অনুসরণ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
দেশব্যাপী ইসলামী পুনর্জাগরণে এটি অভূতপূর্ব উৎসাহের সৃষ্টি করে। এই কারণে স্যার সৈয়দ আহমদ খানের ক্ষমাপ্রার্থী মনোভাব ও আধুনিক দর্শনের সঙ্গে ইসলামকে খাপ খাওয়ানোর প্রচেষ্ঠার কোর আবেনদ রইল না। বৃটিশ কর্তৃক আল হিলাল নিষিদ্ধ ঘোষণা এবং আবুল কালাম আযাদকে কারাগারে পাঠানোর আগে এর প্রচার সংখ্যা পঁচিশ হাজারে গিয়ে পৌছায়। ১৯২০ সালে মাওলানা আবুল কালাম আযাদের কারামুক্তি তার জীবনে পটপরিবর্তন আনে। এই সময় তিন তার ধর্মীয় ধ্যান-ধারণা সম্পূর্ণ পরিবর্তন করেন। এজন্যে মুসলমান সম্প্রদায়ের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তার উদ্বেগ চিল না। ভারতে একটা সত্যিকার ইসলামী সমাজ গঠনে তিনি আর আগ্রহী ছিলেন না। এর পরিবর্তে ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তার লক্ষ্যে তিনি হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রবক্তা হয়ে যান”। ধর্মের মধ্যে পুনর্জাগরণ প্রয়োজন যারা বিশ্বাস করেন আমি তাদেরই একজন, তবে সামাজিক বিষয়ে এটা হচ্ছে প্রগতিকে অস্বীকার করা”।
“১৯২০-২১ সাল পর্যন্ত মাওলানা আবুল কালাম আযাদ ছিলেন ইসলামী পুনর্জাগরণ ও খেলাফত আন্দোলনের উৎসাহী প্রবক্তা। কিন্তু পরে তিনি কাজে ও চিন্তায় সম্পূর্ণ পাল্টে যান। তাঁর এই পরিবর্তন এতই অস্বাভাবিক ছিল যে, অনেকে চোখ রগড়াতে থাকেন যে, তাদের দেখা ব্যক্তিটি কি সেই আযাদ না রূপান্তরিত কেউ, যার মধ্যে একটি নতুন মানুষ জন্ম নিয়েছে। আবুল কালাম আযাদ এখন পুরোপুরি ভারতীয় জাতীয়তাবাদী এবং মুসলমান ও অমুসলমানদের নিয়ে একক ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সোচ্চার প্রব্ক্তা। তিনি কতিপয় হিন্দু দার্শনিকের ধর্মিয় ঐক্যের তথাকথিত মতবাদ এবং পশ্চিমা জৈবিক বিবর্তনবাদ মেনে নেন। পবিত্র কোরআনের ওপর তার ভাষ্যে এসব মতবাদের সুস্পষ্ট ছাপ দেখা যায়। [১৯৬২ সালের ৩০শে মার্চে লেখা মাওলানা আবুল আলা মওদূদীর ব্যক্তিগত পত্র থেকে উদ্ধৃত।]
জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা গ্রহণ করলে ভারতের মুসলমানদের মুক্তি হবে এই কথায় বিশ্বাস স্থাপন করে মাওলানা আবুল কালাম আযাদ ভারতে জাতীয় কংগ্রেস দলে যোগদান করেন এবং মহাত্মা গান্ধীর খুবই ঘনিষ্ঠ সহচরে পরিণত হন।
তিনি ঘোষণা করেন ভারতের মুক্তি এবং বর্তমান বিক্ষোভের জন্যে আমি মহাত্মা গান্ধীর যুক্তির সঙ্গে পূর্ণ একাত্মতা পোষণ করি এবং তার সততায় আমার পূর্ণ আস্থা রয়েছে। তাই আমার দৃঢ় বিশ্বাস অস্ত্রের শক্তিতে ভারত সফল হতে পারে না এবং তাকে সেপথে অগ্রসর হওয়ার পরামর্শও দেয়া যায় না। অহিংসা আন্দোলনের মাধ্যমেই কেবল ভারত বিজয়ী হতে পারে এবং ভারতের বিজয় নৈতিক শক্তির বিজয়ের স্মরণীয় উদাহরণ হয়ে থাকবে। [Mohadeb Desia, Moulana Abul Kalan Azad, George Allen & Urwin, London 1941, P. 82]
১৯২২ সালে মহাত্মা গান্ধী খেলাফত আন্দোলন বন্ধের আহবান জানানোর পর এবং হাজার হাজার মুসলমান নিধনকারী সাম্প্রদায়িক গোলযোগ দমনে তার ব্যর্থতার পর কংগ্রেসের মুসলিম সদস্যদের মদ্যে মাওলানা মোহাম্মদ আলী তার ভাই শওকত আলী এবং কায়েদে আজম এক এক করে কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করতে থাকেন। মাওলানা আবুল কালাম আযাদ শুধু থেকেই গেলেন না রবং প্রায় দুই দশকের জন্যে এর প্রেসিডেন্ট হিসেবে কংগ্রেসের একনিষ্ঠ রক্ষকে পরিণত হলেন।
জনাব জিন্নাহ অভিযোগ করেন যে, কংগ্রেসের নির্ধারিত নীতি হচ্চে মুসলিম বিরোধিতা, মুসলমানদের সংস্কতি ধ্বংস করা এবং অব্যাহতভাবে মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনে হস্তক্ষেপ এবং সব সময় মুসলমানদের রাজনৈতিক ও অর্থণৈতিক অধিকার খর্ব করা।
“আমি আগেও বলেছি এবং পূর্ণ দায়িত্বের সঙ্গে ঘোষণা করছি যে, কংগ্রেস মন্ত্রী সভার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। কংগ্রেসের নীতি মুলমান বিরোধী এবং মুসলমানদের রাজণৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় অধিকার খর্ব করছে এ কথা বলা বিরাট মিথ্যঅ কথা। যদি মিঃ জিন্নাহ এবং তার সহযোগিরা মনে করেন যে, মুসলমানদের কল্যাণের জন্যে তারা এসব বলছেন। আমি অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে বলব যে তারা তার বিপরীত কাজ করছেন। এটাই আজকের সবচাইত বড় প্রয়োজন”।[Desai op, Cit, pp 152-22.]
১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার পর মাওলানা আবুল কালাম আযাদ ভারতে শিক্ষামন্ত্রী হন এবং ১৯৫৮ সালে তার মৃত্যু পর্যন্ত এ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ভারতের মুসলমানদের জন্যে শিক্ষা ব্যবস্থাকে সত্যিকার ইসলাম ভিত্তিক করার চেষ্টার পরিবর্তে তিনি উর্দু এবং অন্যান্য ভারতীয় ভাষার জন্যে ল্যাটিন হরফ চালুর পশ্চিমা ধারণার পৃষ্ঠপোষকতা করেন। তিনি পরিবার পরিকল্পনার জন্যে সরকারী প্রচারাভিযানকেও সমর্থন করেন। তিনি বলেন, “জন্ম নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণভাবে জৈবিক ও সামাজিক সমস্যা” এবং ইসলামী আইনের এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের কোন কারণ নেই, যদি বিশেষজ্ঞরা একে জাতির জন্যে অপরিহার্য মনে করেন তবে তারা এর পক্ষে রায় দিতে পারেন”। [Abu Shehab Rafiullah, Islam and family planning, the Pakistan times. Dec. 2. 1966.]
মাওলানা আবুল কালাম আযাদের একনিষ্ঠ অনুসারী করিম চাগলা এই ব্যাপারে অনেক দূরে এগিয়ে যান। ভারতে শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালে তিনি মসলিম পারিবারিক আইন বিলোপ, বহুবিবাহ, পর্দা নিষিদ্ধ এবং মুসলমান মেয়ে ও অমুসলমান যুবকের বিয়ে বাধ্যতামূলক করে আইন প্রণয়নের জন্য ভারত সরকারের ওপর প্রচণ্ড চাপ দিতে থাকেন। জাতীয় পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচীর সাফল্যের জন্যে গর্ভপাত বৈধকরণ এবং তিন সন্তানের পিতার জন্য বাধ্যতামূলক বন্ধ্যাত্বকরণের পক্ষে প্রকাশে ওকালতি করেন।