সমসাময়িক মুসলিম পাণ্ডিত্যের ওপর প্রাচ্যবাদের প্রভাবের একটি উদাহরণ
আধুনিকতাবাদী আন্দোলনের সবচাইতে আশ্চর্যজনক দিক হচ্ছে কতিপয় মুসলমান পণ্ডিত ইসলামী গবেষণার শ্লোগানের আবরণে ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস এবং আচরণ সম্পর্কিত প্রাচ্যবাদীদের বক্তব্যকে কোন প্রকার প্রশ্ন ছাড়াই গ্রহণ করতে প্রস্তুত হয়ে পড়েন। অন্যতম বিখ্যাত প্রাচ্যবাদী H.A.R GIBB তার Modern Trends in Islam গ্রন্হে আধুনিক খৃষ্টানরা যেভাবে বাইবেলকে গ্রহণ করছেন ঠিক সেইভাবে কোরআনও হাদিসের ব্যাপক ব্যাখ্যা গ্রহণে আধুনিকতাবাদীদের ব্যর্থতার জন্যে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এতে কোরআনের অলৌকিক উৎসের চাইতে মানবিক দিকই পরিস্ফুটিত হত- এই ছিল তার ধারণা।
আধুনিক প্রাচ্যবাদীদের প্রাথমিক লক্ষ্য হচ্ছে মুসলিম নামধারী পণ্ডিতদেরকে বৈজ্ঞানিক গবেষণার নামে পবিত্র কোরআন এবং হাদীসের ব্যাখ্যায় উৎসাহিত করা। যাতে তারা পরবর্তী পর্যায়ে প্রমাণ করতে পারেন কোরান হাদীস নবীল কাছে নাজিল হয়নি, এগুলো তার রচনা অথবা বাইেবলের মত কোরআনও সময়ের বিবর্তনে পরিবর্তিত হয়েছে। এটা অসম্বব প্রমাণিত হলে (যা হতে বাধ্য) প্রাচ্যবাদীরা মুসলমান নামধারী পণ্ডিতদেরকে কোরআনের ঐতিহাসিক দিকটির মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টিতে উদ্বুদ্ধ করবে। যা তাদের মতে নবীল সময়ের আরবের প্রাথমিক অবস্থার জন্যে প্রযোজ্য ছিল এবং বর্তমান যুগের জন্যে তা অপ্রাসঙ্গিক এবং তার কোন চিরন্তন মূল্য নেই। এই ভাবে প্রাচ্যবিদদের প্রভাবে মুসলমান নামধারী পণ্ডিতেরা যদি কোরআনকে অন্যান্য সাধারণ বই এর মত একটি বই মনে করতে শুরু করে তাহলে খোদা না করুন কোরআন পর্যায়ক্রমে তার কর্তৃত্ব হারিয়ে ফেলবে এবং কোরআনের আনুগত্য বা তার প্রতি কেউ সম্মান দেখাবে না।
সৈয়দ আমীল আলীর স্পিরিট অফ ইসলাম (১৯২২) ডঃ তাহা হোসাইনের On Pre Islamic Poetry (১৯৬৬) সুস্পষ্টভাবে একথাই বলেছে। তিনি লিখেছেন: “নবী এবং নবীর ওপর নাজিলকৃত ওহির বক্তব্য স্বাভাবিক এবং কিছুটা উৎসাহ ব্যঞ্জক ছিল। বস্তুতঃ পরে এটাকে প্রায় গোঁড়ামিতে আকীর্ণ করা হয়েছে। এতে জিব্রাইলের বাহ্যত্যের নিশ্চয়তা এবং ওহির লক্ষ্য রক্ষা করতে হতো। আমাদের কাছে বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে এই পদক্ষেপ অপরিপক্ক মনে হতে পারে তবে যে সময় গোঁড়ামির প্রাধান্য ছিল তখন এই পদক্ষেপ বিশেষ করে যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে বিতর্ক ছাড়া কোন উপায় ছিল না। সাধারণভাবে গৃহীত অনেক হাদীসে নবীকে জন সমক্ষে জিব্রাইলের (আ) সঙ্গে কথা বলতে এবং জিব্রাইল সম্পর্কে সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। জিব্রাইলের বাহ্যত্ব এবং ওহি সাধারণ মুসলমানদের মনে এতই বদ্ধমূল হয়েছে যে, প্রকৃত ব্যাপারটি অস্বীকৃত হয়েছে। কোরআনে পরোক্ষভাবে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, নবী শেষ সীমা পর্যন্ত দেখতে পান। এর ফলে তার অভিজ্ঞতালব্ধ বাণী খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মহাবনীর মেরাজে যাওয়অর বিষয়টি গোঁড়াদের তৈরী। যীশুর স্বর্গারোহণের ধারণা থেকেই তারা এ বিষয়টি অবতারণা করেছে। যার প্রমাণ হিসেবে তারা হাদীসের উদ্ধৃতি দেন। হাদীস ঐতিহাসিক উপকথা ছাড়া আর কিছুই নয় এবং বিভিন্ন সূত্র থেকেই তার উপাদান এসেছে, (পৃঃ ১৪)। যদিও ওহির বিষয়কে কোরআনে আধ্যাত্মিক ব্যঅপার বলে বর্ণনা করা হয়েছে। হাদীস বা প্রাচীন পন্হায় গোঁড়ামি এমন সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা বা অলঙ্কৃত করা হয়েছে, হাদীস নির্ভর ধর্মতাত্মিক বিজ্ঞানের দ্বারা বলা হয়েছে কর্ণ এবং বাহ্যিকভাবে নবী ওহি পেয়েছেন এবং জিব্রাইল অন্তরের মধ্য দিয়ে অভিব্যক্ত হয়েছেন বলে বলা হয়েছে”। (পৃঃ ৩১-৩২)
বিজ্ঞ লেখক পবিত্র কোরআনের আরও কঠোর সমালোচনা করেছেন এবং বিধি নিষেধ আরোপের দুঃসাহস দেখিয়েছেন।
এইব ঘটনা প্রাক ইসলামী যুগের গল্প এবং রূপকাহিনীর সঙ্গে সামণ্ডস্য পূর্ণ হওয়ায় খুবই আনন্দদায়ক তবে সংকটাবিষ্ট। কোরআনের ভবিষ্যৎ বাণীর ভিত্তি সম্পর্কে প্রশ্ন না তুলে বলা যায় প্রকৃত বিষয় নির্ণয়ে এবং নবলি বাণী আমদানীতে এগুলো খুবই অর্থবহ। যে সবক্ষেত্রে এগুলো ব্যবহৃত এবং এর ফল অর্জিত হয়েছে তার আলোকেই এগুলো বিচার্য। অপরদিকে মুসলমানদের উচিৎ নয় এগুলোর ঐতিহাসিক আবেদনে ভীত হওয়া বা প্রত্যাখ্যান করা। কোরআন অবশ্যই বলে য, এসব গুল্প সত্যিই নাজিল হয়েছে। তবে অবশ্যই যা নাজিল হয়েছে, তা হচ্ছে তার বক্তব্য এবং উদ্দেশ্য। (পৃঃ ১৬)
অপর কথায় বিজ্ঞান লেখক পরোক্ষ বোঝাতে চেয়েছেন যে, পবিত্র কোরআনের নবীর সম্পর্কে যে কাহিনী বলা হয়েছে এগুলোকে ওহি হিসেবে গ্রহণ করার কোন প্রয়োজন নেই। সুস্পষ্ট ঐতিহাসিক প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও লেকক ইসলামের মৌলিক এবাদতের ওপরও হামলা করতে কুণ্ঠা করেননি। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের কথা কোরআনে বলা হয়নি। নবীর পরবর্তীকালে কোন বিকল্প ছাড়াই পাঁচ ওয়াক্ত নামায অনমনীয়ভাবে নির্ধারণ করা হয়। মৌলিক তিনি ওয়াক্ত হাদীসের স্রোতে বিলীন হয়ে যায়। এসব হাদীস ও সুন্নার যথার্থতা সম্পর্কে ডঃ ফজলুর রহমানের তীব্র আক্রমণ Joseph Schacht এর the origin of Mohammadan jurisprudence- এর বক্তব্য থেকে এর বক্তব্য থেকে স্বতন্ত্র নয়- মৌলিক বিষয়ের বাইরে নবীর সুন্নাত সম্প্রদায়ের লোকদের নৈতিক জীবনের ওপর তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি।…. সামাগ্রিক বিষয় থেকে বোঝা যায় যেখানে নবীকে ডাকা হয়েছে সিদ্ধান্ত নেয়া অথবা কর্তৃত্ব ঘোসণার জন্যে বা তিনি যেতে বাধ্য হয়েছেন সবগুলোই ছিল অন্তর্বর্তী বা বিশেষ পরিস্থিতি। সাধারণ পরিস্থিতিতে মুসলমানেরা তাদের দৈনন্দিন ব্যবসা ও সামাজিক লেনদেনের সমস্যা নিজেরাই মীমাংসা করেছে।(পৃঃ ৫১)
অতএব সুন্নত যদিও নবীল আচার আচরণ হিসেবে ধরা হয় তার বিষয়বস্তু কিছু না কিছু পরিবর্তন হতে বাধ্য এবং এর অধিকাংশই সম্প্রদায়ের প্রথমাবস্থার অনুশীলন থেকে এসেছে। তবে চলমান সম্প্রদায়ের প্রকৃত অনুশীল, সংযোজনের দ্বারা পরিবর্তন হতে বাধ্য। প্রাথমিক ইসলামী সমাজের মত একটি দ্রুত সম্প্রসারণশীল সমাজে প্রায়ই নতুন প্রশাসনসহ নতুন নৈতিক ও আইনগত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। নৈতিক বিষয়ের উত্তর দিতে হবে এবং আইনগত পরিস্থিতির সমাধান করতে হবে। যা কিছু নতুন চিন্তা বা উদ্ভাবনা করা হয়েছে তাকে কোরআন এবং হাদীসের আলোকে একটা ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। এইসব ব্যাখ্যা প্রথম দিকে ব্যক্তিগত মতামত ছিল কিন্তু দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দীতে এগুলো নিয়মিত সিদ্ধান্তের জন্যে অনুরনীয় হয়ে পড়েছে। (পৃঃ ৫৬)
আধুনিক ইসলাম সৃষ্টিশীল প্রেরণায় উন্মুখ এবং নতুন অগ্রগতির জন্যে কতিপয় গ্রুপের আবির্ভাব হযেছে যারা সকল হাদীস বাতিল করতে চায় এবং কোরআনের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করতে চায় না। তবে এইসব গ্রুপ বিষয়টির প্রকৃত বিপদ সম্পর্কে সজাগ নয়। কারণ সকল হাদীস অস্বীকার করলে এক মুহূর্তেই কোরআনের ঐতিহাসিক ভিত্তি শেষ হয়ে যায়। তবে বর্তমান অস্থিরতা খুবই স্বাভাবিক এবং প্রয়োজনীয়। নতুন ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তা ঠেকিয়ে রাখা যায় না এবং তা সম্ভবও নয়। এটা খুবই বাঞ্চনীয় যে মুসলমানেরা তাদের হাদীসের অগ্রগতির একটা খোলাখুলি এবং দায়িত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ চালাবে”। (পৃঃ ৬৬-৬৭)
এইভাবে লেখক কোন যৌক্তিকতা ছাড়াই ইসলামের কার্যকারিতা এবং মানব জীবনের ব্যাপক পথ নির্দেশিকা হিসাবে ইসলামের পারদর্শিতার বিরুদ্ধাচারণের চেষ্টা করেন। কারণ হাদীস এবং সুন্নাহ যদি মহানবীর সঠিক এবং নির্ভরযোগ্য শিক্ষা না হয়ে থাকে তাহলে তার জায়গায় খেয়াল খুশির জগাখিচুড়ি ছাড়া আর কি পেশ করা যাবে? এই বিভ্রান্তিকর বুদ্ধিমত্তার পরিণতি হচ্ছে-“বহুবিবাহ এবং দাস প্রথার উদাহরণ থেকে এটাই সুস্পষ্ট হয় যে, কোরআনের আইন মানবিক মূল্যবোধের প্রগতির দিকে নতুন আইন গ্রহণের ইঙ্গিত দেয়। অপর কথায় কোরআনের কিছু আইন তখনকার সমাজের কিছু আইনকে ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করেছে। এ থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, কোরআনের আইনকে কোরআন নিজেই অবিনশ্বর করেনি।
খুব শীগগীরই মুসলমান আইনবিদ এবং যুক্তিহীন লোকেরা বিষয়টিকে এলামেলো করে ফেলে এবং কোন বাছ-বিছার ছাড়া যে কোন সমাজে কোরআনের বিধান প্রয়োগের কথা চিন্তা করেন। প্রাথমিক যুগের মুসলমানরো কোরআনকে অনেক উদারতার সঙ্গে ব্যাখ্যা করেছেন। এ ব্যাপারে যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। কিন্তু সপ্তম শতকের শেষার্ধের প্রথম দিকে এবং অষ্টম শতকের দ্বিতীয়ার্ধ পর্যন্ত আইন শাস্ত্রের উন্নতির পর ঐতিহ্যের সৃষ্টি এবং প্রযুক্তি ও সাদৃশ্যপূর্ণ বিচার শক্তি জাগ্রত হওয়ার ফলে আইনবিদরা পবিত্র গ্রন্হের মূল পাঠকে আঁকড়ে ধরে। আন্তরিকতাবাদের প্রভাবে মুসলিম আইন এবং ধর্মতত্বের সমাধি হওয়া পর্যন্ত তা অব্যাহত ছিল”। (পৃঃ ৩৯-৪০)
একটি হাদীসকে মিথ্যা হতে হলে হাদীসের বর্ণনাকারী সাহাবী অথাব তার থেকে যিনি শুনেছেন তাকে মিথ্যুক হতে হবে। সাহাবীদের বেলায় এটা হওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব। বিষয়টি মনস্তাত্বিক সমস্যার দিকে দৃষ্টি দিলে এটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। মহানবীর ব্যক্তিত্ব এসব মানুষকে এমনভাবে প্রভাবিত করেছে যে, এইসব পুরুষ মানব ইতিহাসের সুবিদিত সত্য এবং ইতিহাসে এদের যথার্থতা সম্পর্কে সন্দেহের কোন অবকাশ নাই। এটা কোন রকমেই বিশ্বাসযোগ্য নয় যারা আল্লাহর নীর কথায় নিজেদের জীবন এবং তাদের সম্পত্তি বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত ছিলেন তারা সেই নবীরই কথা নিয়ে চাতুরী করবেন। নবী করেছেন, “যারা স্বেচ্ছায় আমার সম্পর্কে মিথ্যা বলবে তার দোজখের বাসিন্দা হবে”। সাহাবীরা এটা জানতেন। আল্লাহর দূত হিসেবে তারা যাকে বিশ্বাস করেছিলেন সে নবীর কথা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন।
মনস্তাত্বিক দিক থেকে এটা কি সম্ভব যে তারা নিশ্চিত শাস্তিকে অবিশ্বাস করেছেন? আরও একটি যুক্তির ভিত্তিতে হাদীসের যথার্থতা চ্যালেঞ্জ করা হয়। যে সাহাবী নবীর কথা শুনেছেন অথবা যারা পরে বর্ণনা করেছেন তারা ভুল শুনতে পারেন অথবা স্মরণশক্তির অভাবে ভুল করতে পারেন বা বুঝতে ভুল করতে পারেন। তবে মনস্তাত্বিক সাক্ষ্য প্রমাণ থেকে এ ধরনের ভুলের কোন অবকাশ অন্ততঃ সাহাবীদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। যারা নবীর সঙ্গে বাস করেছেন, তাদের প্রতিটি কথা এবং কাজ উল্লেখযোগ্য ছিল। এটা শুধু এ কারণে নয় যে, তার প্রতি অগাধ ভক্তি ছিল বরং তাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, নবীর মাধ্যমে আল্লাহর প্রতিটি আদেশের আলোকেই তাহাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষণ পরিচালিত করতে হবে। এই কারণে নবীর কোন কথাকে তারা হাল্কাভাবে নেননি বরং ব্যক্তিগত চরম অসুবিধা সত্ত্বেও তা স্মরণ রাখতে চেষ্টিত ছিলেন।
নবীর সঙ্গে যারা ঘনিষ্ঠভাবে ছিলেন তারা প্রত্যেকেই দুইজন করে গ্রুপে থাকতেন এবং একজন পালাক্রমে নবলি কাছে থাকতেন এবং অপরজন তার জীবনোপকরণ সংগ্রহ করতেন। যিনি কাছে থাকতেন নবীর কাছ থেকে শোনা এবং নবীর আচরণ দ্বিতীয় ব্যক্তিকে দেখা মাত্রই অবহিত করতেন। প্রতিটি মুহুর্তে তারা এতই সচেতন ছিলেন যে নবীর কোন কাজই তাদের দৃষ্টির আড়ালে যাওয়া সম্ভব ছিল না। এই অবস্থায় কি করে বিশ্বাস করা যায় যে, হাদীসের সঠিক শব্দ সম্পর্কে তারা উদাসীন ছিলেন? শত শত সাহাবীর পক্ষে প্রতিটি খুটিনাটি বানানসহ পুরো কোরআন মনে রাখা যেমন সম্ভব ছিল ঠিক তেমনি কোন প্রকার বর্জন, সংযোজন ছাড়া হাদীস মনে রাখাও সম্ভব ছিল। পূর্ব এবং পশ্চিমের আধুনিক সমালোচকরা বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলাফল সম্পর্কে সংবেদনশীল সমালোনা করতে পারেননি।
এটা করা কষ্টকর কারণ হাদিসের প্রাথমিক সংকলকরা বিশেষ করে ইমাম বুখারী এবং মুসলিম হাদীসের যথার্থতার জন্যে মানবের সাধ্যানুসারে যা কিছু করণীয় ছিল সবকিছু করেছেন। তারা যে কষ্ট স্বীকার করেছেন কোন ইউরোপীয় ঐতিহাসিক কোন ঐতিহাসিক ঘটনার যথার্থতার জন্যে এত কষ্ট স্বীকার করেন না। এখন পর্যন্ত কোন সমালোচকই যথার্থ হাদীসের কোনটির অযথার্থতা সম্পর্কে কোন প্রমাণ দিতে পারেননি। কোন যথার্থ আচারের পুর্ণাংশ বা অংশ বিশেষ প্রত্যাখ্যান সংবেদনশীলতার পরিচায়ক নয়। কারণ পক্ষপাতশূণ্য বৈজ্ঞানিক গবেষণার দ্বারা তা প্রকাশ সম্ভব হয়নি। তবে আমাদের যুগের অনেক মুসলমানের এই বিরোধী মনোভাবের উদ্দেশ্য সহজেই বোঝা যায়। আমাদের নবীর সুন্নায় প্রতিফীলত ইসলামের সত্যিকার মেজাজের সঙ্গে বর্তমানের অধঃপতিত জীবনকে খাপ খাওয়াতে না পারাই এই বিরোধিতার উদ্দেশ্য। নিজের এবং পরিবেশের অসম্পূর্ণতাকে ন্যায়সঙ্গত প্রমাণ করার জন্যেই হাদীসের ভিত্তিহীন সমালোচকরা সুন্নাত অনুসরণের প্রয়োজনয়িতা এড়াতে চান কারণ এটা করা সম্ভব হলে তাদের খেয়াল খুশিমত কোরআনের ব্যাখ্যঅ করা সম্ভব হবে।
এইভাবে ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন পদ্ধতি হিসেবে ইসলামের ব্যতিক্রমী অবস্থান ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। একই সঙ্গে নবীর সুন্নাহর অনুসরণ ও পশ্চিমা জীবন পদ্ধতির স্বাদ গ্রহণ অসম্ভব। এই পশ্চিমী ধ্যান ধারণার কারণেই আমাদের নবীর আদর্শ সুন্নাহর সমগ্র কাঠামো আজ এত অপ্রিয় হয়ে উঠেছে। পশ্চিমা সভ্যতার অন্ধ অনুসারীরা সুন্নাহর বিরোধিতা ছাড়া কোন পথ খুঁজে পায় না। তারা বলেন সুন্নাহ অপ্রাসঙ্গিক, সুতরাং তা ইসলামের অপরিহার্য দিক নয়। কারণ তা অনির্ভরযোগ্য ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। এরপর কোরআনের শিক্ষাকে পাল্টিয়ে দেয়া সহজ হয়ে পড়ে। তখন তারা পশ্চিমা সভ্যতার সাথে খাপ খাইয়ে কোরআনের ব্যাখ্যঅ করতে পারেন।
শরিয়তের অগ্রগতি সংক্রান্ত ডক্টরের বক্তব্য যোশেফ স্কচ এর ধারণার শব্দান্তরিত রূপ ছাড়া আর কিছুই নয়। স্কচের মতবাদ হচ্ছে প্রাথমিক যুগের মুসলমানরা অনেকটা স্বাধীন চিন্তা এবং স্বাধীন বিচার শক্তির অধিকার ছিলেন। ইমাম শাফেয়ী প্রথম মুসলিম আইনবিদ যিনি ইসলামী শরিয়তের জন্যে কোরআনের পর হাদীসকেই সব চাইতে শক্তিশালী ও নির্ভরযোগ্য সূত্র হিসেবে গ্রহণ করেছেন। আইনকে আরও জোরদার করার জন্যে তিনি সাহাবীদের ‘ইজমা’কে অভ্রান্ত নির্দেশিকা হিসেবে গ্রহন করেছেন।
ইজতেহাদের যোগ্যতা এত নিষ্পাপ ও কঠোর এবং উচ্চে স্থাপন করা হয়েছে যে, মানুষের পক্ষে তা অর্জন অসম্ভব। প্রাথমিক যুগের ধর্মীয় নেতারা সেই হিসেবে নিজেদেরকে খুবই আদর্শবান করে গড়ে তুলেছিলেন। পুরোপুরি ইজতেহাদের ক্ষমতা সম্পূর্ণ বিলোপ করা হয়েছে। প্রাথমিক ইজতেহাদের অনুমতি দেয়া হয়েছে-এর অর্থ হচ্ছে একজন তার নিজস্ব চিন্তার গণ্ডির মধ্যে আইনের ব্যাখ্যা দিতে পারেন অথবা বিভিন্ন চিন্তার বিশ্লেষণ করে আইনের ওপর তুলনামূলক গবেষণা চালিয়ে কিছুটা বিস্তারিত বিবরণ খাড়া করতে পারেন। ইবনে তাইমিয়ার মত অসাধারণ লোকের সংখ্যঅ খুব দুর্লভ, যারা পুরোপুরি ইজতেহাদের দাবী করেছেন। কিন্তু মধ্যযুগে এ ব্যাপারে তাদের স্বীকৃতি খুবই সীমিত ছিল। আমরা পরে দেখব যে, আধুনিক চিনতানায়কদের প্রবল প্রচেষ্টায় এই দিকটি আবার কিভাবে শুরু হয়েছে। কিন্তু সমগ্র মধ্য শতাব্দী ধরে আইনের সংজ্ঞা এবং ব্যা সম্প্রদায়ের ওপর শেলের মত নিক্ষিপ্ত হয়েছে। (পৃঃ ৭৮-৭৯)
এখন আমরা সংক্ষেপে দেখব যে, মহান আইনবিদদের সর্বসম্মত মতের বিরুদ্ধেই ইজতেহাদ করা যায় কিনা? এই বিষয়ের দুইটি দিক আছে তাত্বিক এবং বাস্তব। তাত্বিক দিক থেকে এ ধরনের ইজতেহাদের ব্যাপারে কোন আপত্তি থাকতে পারে না, যেহেতু আমাদের খ্যাতনামা ইমামরা অভ্রান্ত ছিলেন না তাদের সর্বসম্মত মতে ভুলের সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। তবে এটা স্মরণ রাখতে হবে যে, তাত্বিক দিক থেকে যা সম্ভভ তাই সত্যি হওয়া অপরিহার্য নয়। উদাহরণস্বরূপ আমাদের সময় আল্লামা ইকবাল দেশের সবচাইতে বড় কবি। এমন কোন কবির আবির্ভাব অসম্ভব নয় যিনি ইকবালের চাইতেও নিজেকে বড় প্রমাণ করবেন। ইকবালের চেয়ে বড় কবির আবির্ভাব সম্ভব এটা ধরে নেয়ার পর ডঃ ফজলূর রহমান নিজেকে সেরূপ দাবী করেন। কবিত্বের দাবির কোন কাজ বা প্রমাণ উপস্থাপন না করলে তার মুখের কথাকে বিশ্বাস করা কি কারও পক্ষে সম্ভব? এখন কথা হচ্ছে, যে বিষয়ে আবু হানিফা, মালিক, শাফী এবং আহমদ ইবনে হাম্বলের মত ইমামগণ সম্পূর্ণভাবে ঐক্যমতে পৌঁছেছেন সে বিষয়ে কোন মুসলমানের পক্ষে আধুনিকতাবাদদের ফতোয়া বিবেচনা করা কি সম্ভব?
ইসলামের ইতিহাসের বিচার বিশ্লেষণ ডঃ ফজলূর রহমান H.A.R. Gibb’s এর Mohammadism কে অনুসরণ করেছেন। একমাত্র পার্থক্য হচ্ছে গিবস এর বই এর চাইতে ফজলূর রহমানের বইতে বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে। আধুনিক সংস্কার আন্দোলনের পূর্ববর্তী অধ্যঅয়ে তিনি যুক্তি দিয়েছেন যে, মধ্যযুগীয় কর্তৃত্ব এবং ইজতেহাদের ওপর তাদের জেদকে অস্বীকার করে তারা আধুনিকতাবাদী আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপন করেছেন। কিন্তু যেহেতু আগের আন্দোলনগুলো কর্তৃত্ব পরিহার করার সময় ইসলামী আইনে সংযোজনযোগ্য কিছু দিতে না পেরে শুধুমাত্র প্রাচীন ইসলামে ফিরে যেতে চেয়েছে ফলে এই শূন্যতা আধুনিকতাবাদীরা পশ্চিমা সভ্যতার বুদ্দিবৃত্তিক উপাদান দিয়ে পূরণ করেছে। (পৃঃ ২১৫)
তিনি নৈতিক প্রত্যক্ষবাদের পরামর্শ দান এবং পার্থিব আত্মিক আন্দোলনের পরিবর্তে সমাজ কল্যাণের ওপর জোর দেয়ার কথা বলেছেন ফলে পরে আধুনিক জীবন ও শিক্ষার ওপর ধর্মনিরপেক্ষবাদ বলবৎ হয়েছে। এইসব আন্দোলন আধুনিকতার অগ্রপথিক এই যুক্তি সম্পূর্ণ ভ্রান্তিকর। পার্থিব সুখ-শান্তির জন্য পরকালকে বিসর্জন দেয়া তাদের লক্ষ্য ছিল না। বরং তা ছিল জীবন পদ্ধতি হিসেবে নিখুঁত ও নির্ভেজাল ইসলামের বাস্তবায়ন। অপরদিকে আধুনিকতাবাদীরা মুসলিম সমাজকে পশ্চিমারুপ দিয়ে কি করতে চান তা আর গোপন নেই।
ডঃ ফজলূর রহমানের ধারণা ঐতিহাসিকভাবে উন্নয়ন প্রাপ্ত আমাদের শিক্ষা পদ্ধতি মুসলমানদের নিশ্চলতা, দুর্বলতা এবং অধঃপতনের জন্য বিরাট অংশে দায়ী। সকল প্রাক আধুনিক শিক্ষার মত মধ্যযুগের মুসলমানদের শিক্ষার মৌলিক গলদ ছিল শিক্ষার ধারণা সংক্রান্ত। আধুনিক শিক্ষার ধারণা হচ্ছে- তা অবশ্যই অনুসন্ধান এবং আবিস্কারের ফসল হতে হবে। মুসলমানরা এর সম্পুর্ণ বিপরীত ধারণা পোষণ করতেন। তাদের মতে শিক্ষা অর্জন করতে হবে- এই মনোভাব নিষ্ক্রিয় এবং ধারণক্ষম। সৃষ্টিশীল ও ইতিবাচক একদিকে প্রেরিত বা চিরাচরিতের বিরোধিতা অপরদিকে যৌক্তিকতার কারণে মুসলিম বিশ্বে এই বৈপরিত্য এখন আরও তীব্র। এই বিতর্ক, গোঁড়ামি, ঐতিহ্য রক্ষার উদ্বেগ সামগ্রিকভাবে যুক্তির বিরুদ্ধে মাথা চাঁড়া দিয়েছে যাকে সে অন্ধত্বের কড়া নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেয়েছিল। (পৃঃ ১৯১)
বিজ্ঞ ডক্টর জানতে আগ্রহী হতে পারেন, কি করে বর্তমান শতকের প্রথম দিকের খ্যাতিম্যান খৃষ্টান মিশনারী Dr. Samuel zwemer একইভাবে মুসলিম শিক্ষার সমালোচনা করেছেন; ঠিক এখানে তাদের শিক্ষা দর্শনের চূড়ান্ত গলদে আমরা হোঁচট খাই। স্মৃতি শক্তিকে খুবই জোরদার করা হয়েছে কিন্তু যুক্তিবাদী ক্ষমতা একেবারে অনুন্নত রয়েছে। একজন মুসলিম প্রতিদিন যা আবৃতি করে, সে জানে না ঐ শব্দ এবং বাক্যে বি বোঝায়। কোরআনের বক্তব্য সম্পর্কে প্রশ্ন করলে গাল খেতে হবে অথবা তার চাইতে বেদনাদায়ক পরিস্থিতির সম্মখীন হতে হবে। এমনকি মোহাম্মদীয় উচ্চ বিদ্যালয়ে ব্যাকরণ, তর্কশাস্ত্র, ইতিহাস এবং ধর্মতত্বও মুখস্ত করানো হয়। যেহেতু গোঁড়ামি অধ্যাপককে ব্যক্তিগত বিচার বিচক্ষনতা প্রয়োগের সুযোগ দেয় না, সেক্ষেত্রে ছাত্ররা কেন নিজেদের জন্যে চিন্তা করবে? আল্লাহ ওহির ১১৪ টি অধ্যায়ে জ্ঞানের আরম্ভ এবং শেষ, অন্য পাঠ্য বইয়ের প্রয়োজন কোথায়? [Chidhood in Moslem world Dr. Samuel M. zwemer Fleming H. Revell co. New York, 1915 pp 137-38]
চিরাচরিত মাদ্রাসা শিক্ষা-যেখানে বুঝার পরিবর্তে শুধু মুখস্ত করার ওপর জোর দেয়া হয় তার বেলায় এই সমালোচনা সত্য। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ডঃ ফজলুর রহমান এবং তার সহানুভূতিশীলরা দেশীয় পদ্ধতির বিকল্প হিসেবে যে আধুনিক শিক্ষা দিতে চান তা কি কোন ভাল কিছু করতে সক্ষম? বস্তুতঃ ডঃ ফজলূর রহমান নিজে এর উত্তর দিয়েছে। তার বই-এর সমাপ্তিতে তিনি লিখেছেন- প্রথম অবস্থা থেকে মাদ্রাসা শিক্ষায় নতুন পদ্ধতি সৃষ্টির চিন্তার কোন সুযোগ নেই। আমাদের আধুনিক পণ্ডিতদের মধ্যেও এই প্রয়োজনীয় প্রেরণা পর্যাপ্তভাবে সঞ্চারিত হয়নি। আমাদের আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষঅ পুরোপুরি ধর্ম নিরপেক্ষ এবং ইসলাম অধ্যয়ন ও গবেষণা কখনো এতে স্থান পায়নি। ফলে আমাদের আধুনিক শিক্ষঅয় শিক্ষিত লোকদের মধ্যে ইসলামের কোন জ্ঞান নেই।
দ্বিতীয়তঃ এই শিক্ষা পদ্ধতির যেসব ছাত্র বৈজ্ঞানিকভাবে ইসলাম অধ্যয়নে যত্নবান হলেন তারা প্রায় সকলেই পশ্চিমী প্রাচ্যবাদের শিষ্য। ফলে তাদের মুসলমান শিষ্যরাও প্রাচ্যবাদী হয়ে পড়েছে। প্রাচীবাদীরা একই সঙ্গে মুসলমানও রয়ে গেলেন। সামগ্রিকভাবে এতে কোন কাজ হয়নি এবং কোন ফলোদয় হয়নি। (পৃঃ ২৫১-৫২)
বিষয়টির সবচেয়ে জটিল অবস্থা হচ্ছে আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিত আধুনিকতাবাদীরা ইসলামে পণ্ডিত নয় এবং ইসলামের অতীতের সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারে না। সুতরাং কলহপ্রিয় সংস্কারবাদীদের মোকাবিলায় তারা আত্মরক্ষামূলক ভূমিকা পালন করেন। ইসলামের রাজণৈতিক মতবাদের ওপর আধুনিকতাবাদদের একটি বইও নেই। (পৃঃ ২৩০)
পশ্চিমী শ্রেণী পর্যাপ্ত সময়ের অভাবে সংস্কৃতির দিক থেকে ঐতিহ্যবাদীদের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে না। পশ্চিমী আধুনিকতাবাদ অপশ্চিমী পরিবেশে উৎকর্ষ সাধন করতে পারে না। এমনকি আধুনিক ক্ষেত্রেও নয় কারণ নতুন পরিস্থিতিতে খাপ খাওয়াতে এর সময় লাগে। সমসাময়িককালে খুব সীমিত কিন্তু গুরুত্বপুর্ণ কিছু অগ্রগতি হয়েছে যেমন ইসলামের পুনঃব্যাখ্যা, সৃষ্টিশীল পণ্ডিতদের প্রশিক্ষণ এবং আলআজহারকে পুনর্গঠনের জন্যে পাকিস্তানে ইসলামী রিসার্স ইনষ্টিটিউট স্থাপিত হয়েছে। অবশ্য এর ফল পেতে সময় লাগবে। তবে সময়ের প্রাচুর্যতার অভাবই সব কথা নয়। পশ্চিমীবাদের মোলিক অসুবিধা হচ্ছে এর নৈতিকতার অভাব যা একই এর শক্তি যোগাতে পারতো। কেবলমাত্র আধুনিকতার কয়েকটি কার্যকর দিক প্রয়োজনীয় নৈতিকতা দিয়ে নতুন জায়গায় আসন পেতে পারতো। কার্যকর আধুনিকতা সৃষ্টি হয়নি, মৌলিকত্বের শক্তিই পশ্চিমীবাদের দুর্বলতা। (পৃঃ ২২২-২২৩)
এখানে লেখক খোলাখুলি স্বীকার করছেন যে, আধুনিকতার আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে। তুরস্কের মত এত ব্যাপকভাবে কোথাও এই ব্যর্থতা আসেনি। সম্পূর্ণ পশ্চিমী ধ্যান ধারণার অধিকারী শাসকদল ৪০ থেকে ৪৫ বছর সেখানে শাসন করেছেন। কামালবাদীরা শুধুমাত্র একজন বিচক্ষণ নেতার নেতৃত্বই পায়নি বরং এই লক্ষ্য অর্জনের কাজে সকল একনায়কের সমর্থন পেয়েছে। এই বইতে ডঃ ফজলুর রহমান আরও স্বীকার করেছেন যে, সামরিক ও রাজীনতক ক্ষমতার মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষ কর্মসূচী পরিচালিত হয়েছে। এই কারণে সরকারী শিক্ষানীতির দ্বারা তুকী শহরগুলো প্রভাবিত হয়েছে। কামাল আতাতুর্কের শাসন থেকে তুকী বুদ্ধিজীবীরা ধর্মনিরপেক্ষতার কোন উল্লেখযোগ্য বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যাখ্যা দেননি। (পৃঃ ২২৪)
এর অর্থ হচ্ছে মুসলমানদের উপর বর্বর অত্যাচার এবং শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে পশ্চিমীবাদ চাপিয়ে দেয়া যায়। কোন মুসলিম দেশেই সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক স্বতঃস্ফূর্তভাবে পাশ্চাত্যকরণকে স্বাগত জানায়নি।
এসব সত্যকে অস্বীকার করে তিনি ঘোষণা করেন ‘তৃতীয় থেকে নবম শতক পর্যন্ত মুসলমানরা যেসব অবস্থার মোকাবিলা করেছে বর্তমান মুহূর্তে ইসলাম সম্পর্কে নতুনভাবে চিন্তা এবং এর পুনর্গঠন অনেক বেশী প্রয়োজন, প্রথম আড়াই শতকে যা করতে হয়েছে এখনও তাই করা প্রয়োজন। অপর কথায় মুসলমানদের নবলি সময়কালের পরবর্তী সময়ের মত এখন চিন্তা করতে হবে এবং একে পুনরায় পুনর্গঠন করতে হবে।(পৃঃ ২৫১)
এই বইয়ের লেখকের মত আধুনিকতাবাদীদের প্রবল শ্লোগান হচ্ছে সৃষ্টিশীল আদি ও স্বাধীন অনুসন্ধানের জন্যে ইজতিহাদ এবং ইসলামী গবেষণা চালাতে হবে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে এর ফলে কি পাওয়া গেছে?
এমনকি নিজের পাণ্ডিত্যের মাপকাঠিতে ডঃ ফজলূর রহমান উদ্দেশ্য সমাপ্ত করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তার কুরআন সম্পর্কিত অধ্যায়ে তিনি স্যার সৈয়দ আহমদ খানের অতি প্রাকৃতবাদ বিরোধিতা মেনে নিয়েছেন, হাদীস এবং শরীয়তের অগ্রগতি সম্পর্কে Schacht- এর আধুনিকতার যুক্তি সৈয়দ আমীর আলীর Spirit of Islam এবং ইসলামের ব্যাখ্যা Wilfred Centwell smith- এর Islam in modern History-র বক্তব্যকে সমর্থন করেছে। অপর কথায় পাকিস্তানের সরকারী ইসলামিক রিসার্স ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডঃ ফজলুর রহমানের মত পণ্ডিত ব্যক্তি আদি সৃষ্টিশীল এবং স্বাধীন চিন্তার সামান্য পরিচয়ও দিতে পারেননি। তার কম বুদ্ধিমান অনুসারীদের কাছ থেকে কি আর আশা করা যায়?