১.৩ তৈমূরের অঙ্গুরীয়

০৩. তৈমূরের অঙ্গুরীয়

বাবর দরবারে প্রবেশ করতে সভাসদবৃন্দ বুকে হাত দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নত করে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে। বাবর ভাবে, কেবল আঠারজন, এবং তার উদ্দেশ্যে উচ্চারিত নানীজানের হুঁশিয়ারী, তাদের আনুগত্যের কি ভয়ঙ্কর পরীক্ষার মুখেই না এনে দাঁড় করিয়েছে। চোখ সরু করে সে প্রত্যেককে আলাদা আলাদা করে জরিপ করে। মাত্র একমাস আগে, যখন তার আব্বাজান জীবিত ছিলেন, তার ভাবনাচিন্তা কি বিচিত্রভাবে অন্যরকম ছিল। সে তখন কল্পনা করতে পোড় খাওয়া এসব যোদ্ধাদের ভেতরে কে তাকে অসি চালনা শেখার জন্য তাদের সাথে যোগ দিতে আহবান জানাবে, কে জাক্সারটাসের তীরে পোলো খেলার ছলে তাদের সাথে ঘোড়সওয়ারির জন্য আমন্ত্রণ করবে। এখন বিষয়টা একেবারে আলাদা। তার বাল্যকালের অকাল মৃত্যু হয়েছে। খেলার সময় শেষ। তারা এখন যুদ্ধের মন্ত্রণাসভায় সমবেত হয়েছে।

বাবর তার জন্য নির্দিষ্ট মখমলের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে, গোত্রপতিদেরও বসতে ইঙ্গিত করে, হাত উঁচু করে। “কাশিম, চিঠিটা নিয়ে এসো।”

তার পেছনে পেছনে সভাকক্ষে কালো আলখাল্লা পরিহিত যে লম্বা, শীর্ণকায় লোকটা প্রবেশ করেছিলো, সে এবার সামনে এগিয়ে এসে মাথা নত করে অভিবাদন জানায় এবং আগের দিন ক্লান্ত বার্তাবাহক যে চিঠিটা নিয়ে এসেছে সেটা তার হাতে তুলে দেয়। শান্তি হারাম করে দেয়া চিঠিটা হাতে ধরতে তার আঙ্গুলের সবগুলো গাট সাদা হয়ে আসে। এমনকি এখন তার নিজের আম্মিজানও কামরায় বসে কাঁদছেন, মুখটা নিজের বুকের উপরে ঝুঁকে পড়েছে, বাবরের বোন খানজাদার কোনো কথাই কানে তুলছেন না এমনকি নিজের মা, তার নানীজান এসান দৌলতের তীক্ষ্ণ যুক্তিও তার কান্না প্রশমিত করতে পারছে না। আম্মাজানের এভাবে ভেঙে পড়া দেখে তার নিজের আত্মবিশ্বাসে চিড় খেয়েছে। বাবার আকষ্মিক দুর্ঘটনার পরেও খুতলাঘ নিগার এভাবে ভেঙে পড়েননি, কিন্তু এখন হতাশা তাকে আপুত করে ফেলেছে।

“উজির সাহেব, চিঠিটা উচ্চকণ্ঠে পাঠ করুন যাতে উপস্থিত সবাই আমার চাচাজান, সমরকন্দের সুলতান আহমেদের, বিশ্বাসঘাতকতার কথা পরিষ্কার শুনতে পায়।”

কাশিম চিঠিটা পুনরায় তার হাত থেকে নিয়ে ধীরে ধীরে সেটা খুলে। বাবর ভাবে, তাকে উজির নির্বাচিত করে সে ভুল করেনি। পরিবার পরিজনহীন একজন দরিদ্র ব্যক্তি অথচ ঈর্ষণীয় জ্ঞানের অধিকারী তার পূর্ববতী উজির কামবার আলীর মত উচ্চাকাতি কুচক্রী না লোকটা, যার মাথা এখন দূর্গের প্রবেশদ্বারে একটা দণ্ডের শীর্ষদেশে সংস্থাপিত হয়ে পচছে।

কাশিম কেশে গলা পরিষ্কার করে। “বিষাদের এই মুহূর্তে আল্লাহতালার আশীর্বাদ আমার ভাতিজার উপরে অবিশ্রান্ত ধারায় বর্ষিত হোক। আল্লাহতালা, তার পিতা আমার ভাইকে পার্থিব বোঝা থেকে মুক্তি দেয়াকে যুক্তিসংগত মনে করে তার আত্মাকে বেহেশতের উদ্যানে ডেকে নিয়েছেন। আমরা যারা পেছনে রয়ে গিয়েছি যাদের শোকাহত হবার কারণ রয়েছে কিন্তু জীবিতদের প্রতি কর্তব্যও আমাদের স্মরণে রাখতে হবে। ফারগানা আমি কোনমতেই স্বজ্ঞানে এই ক্ষুদ্র, দারিদ্রপীড়িত এলাকাকে রাজ্য হিসাবে অভিহিত করতে পারি না- অরক্ষিত আর একলা হয়ে পড়েছে। তৈমূরের উত্তরসূরীদের শত্রুরা চারপাশ থেকে ঘিরে আসছে। আমার ভাইয়ের ছেলে, নিতান্তই বালক, নগ্ন আর আক্রম্য অবস্থায় রয়েছে। তাকে রক্ষার্থে আমি যদি এখনই কোনো পদক্ষেপ না নেই, তবে নিজের পরিবারের প্রতি যথাযথ ভালবাসা প্রদর্শনে আমি ব্যর্থ হয়েছি বলে মনে করবো। প্রিয় ভাতিজা, এই চিঠি যখন তুমি পড়ছে, আমার সৈন্যরা তখন সমরকন্দের নীলাভ-সবুজ তোরণ অতিক্রম করে ফারগানার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেছে। ফারগানার নিরাপত্তার জন্য আমি একে অঙ্গীভূত করছি। তোমার আন্তরিক ধন্যবাদ এক্ষেত্রে কেবল বাক্যের অপচয় ঘটাবে। কোনো ধরণের ঝামেলা বা প্রতিরোধ আমি বরদাশত করতে রাজি নই এবং আশা করছি খুদে ফারগানা একটা দারুণ শিকারের ক্ষেত্র বলে ভবিষ্যতে বিবেচিত হবে। তোমার প্রসঙ্গে বলি, প্রিয় ভাতিজা, আমি তোমাকে আমার আশ্রয়ে নিয়ে আসব এবং পিতার আদর কাকে বলে আমার কাছ থেকে তুমি সেটা আবার জানতে পারবে। এবং যখন তুমি প্রাপ্তবয়স্ক হবে, তখন আমিই তোমার জন্য একটা খুদে জায়গীর খুঁজে বের করবো, যেখানে তুমি শান্তিতে এবং সন্তুষ্টিতে বসবাস করতে পারবে।”

যোদ্ধার দল অস্বস্তির সাথে নড়েচড়ে বসে, ভুলেও কেউ কারো চোখের দিকে তাকায় না। তাম্‌বাল, বাবরের দুরসম্পর্কের আত্মীয়, অস্পষ্ট কণ্ঠে কিছু একটা বলে এবং আলি মাজিদ বেগ, সমরকন্দের আগুয়ান বাহিনী তারই এলাকার উপর দিয়ে সরাসরি এগিয়ে আসবে, ভেড়ার চামড়ার কারুকাজ করা আঁটসাট জ্যাকেট মনোযোগ দিয়ে খোটাতে শুরু করে যেন সহসা সেটায় পোকার সংক্রমণ ঘটেছে। বাবর তাদের আশঙ্কা অনুভব করতে পারে। তৈমূরের বংশধরদের ভিতরে তারা চাচাজান সবচেয়ে ক্ষমতাবান আর সমরকন্দ চীন আর পারস্যের ভিতরে বিদ্যমান সিল্ক রুটের উপরে অবস্থিত, চারপাশে উর্বর ফলের বাগান, আর গম এবং তুলার ক্ষেত থাকার কারণে তৈমূরের অধিকৃত এলাকার ভিতরে সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী। সমরকন্দ নামের অর্থই হল চর্বির শহর যাব দেয়ালের পাশ দিয়ে প্রবাহিত জারাফশান নদীকে বলা হয় স্বর্ণ প্রসবিনী।

“আমি আমার দ্রুতগামী অশ্বারোহীদের কেন পাঠিয়েছিলাম এত্তেলা দিতে আপনারা এখন বুঝতে পারছেন। ফারগানার স্বাধীনতার প্রতি এই জঘন্য হুমকীর সমুচিত জবাব দিতে হলে আমাদের প্রস্তুত হতে হবে। আমি অল্পবয়স্ক হতে পারি, কিন্তু আমি আপনাদের ন্যায়সঙ্গত সুলতান। আমার নামে মসজিদে খুতবা পাঠের সময়ে আপনারা উপস্থিত ছিলেন। কামবার আলী আর তার সহযোগীদের আমি শায়েস্তা করেছি। এখন আমি আপনাদের আহ্বান জানাচ্ছি, বহিঃশত্রুর মোকাবেলায় আমার পাশে এসে দাঁড়াবার জন্য, নিজেদের সম্মান রক্ষার্থেই যা আপনাদের করা উচিত।” বাবরের কণ্ঠস্বর শান্ত আর পরিষ্কার, তার উচ্চারিত শব্দ পাথরের দেয়ালে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে সুমধুর প্রতিধ্বনির জন্ম দেয়। ওয়াজির খানের সহায়তায় বাবর আজ যা বলবে সেটা আগে থেকেই অনুশীলন করেছে।

নিরবতা। বাবরের আশা স্তিমিত হতে থাকে এবং সে টের পায় তার পেটের ভিতরটা কেমন ফাঁপা লাগছে। প্রয়োজন হলে সে ওয়াজির খানকে ডেকে পাঠাবে কথা বলার জন্য তার অকাট্য যুক্তি গোত্রপতিরা যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবে, যদিও বাবর তার বিশ্বস্ত দেহরক্ষী বাহিনীর প্রধানের সহায়তা ছাড়াই সফল হবার আশা পোষণ করে। তাকে অবশ্যই কঠোর হতে হবে…বয়সের কারণে যতটা সম্ভব ঠিক ততটাই মন্দ্র কণ্ঠে সে আবার অনুরোধ করে: “আমাদের অবশ্যই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। আমরা যদি হাত গুটিয়ে বসে থাকি, তবে আগামী পূর্ণিমার আগেই সমরকন্দের বাহিনী আমাদের তোরণের বাইরে এসে শিবির ফেলবে।”

“মহামান্য সুলতানের অভিপ্রায় কি জানতে পারি?” আলি মজিদ বেগ মাথা তুলে সরাসরি বাবরের চোখের দিকে তাকায়। তার বাবার সবচেয়ে বিশ্বস্ত গোত্রপতিদের ভিতরে সে অন্যতম এবং বাবর লোকটার পটোলচেরা চোখের দৃষ্টিতে সমর্থন দেখতে পেয়ে কৃতজ্ঞ বোধ করে।

“সুলতানের বাহিনী সমরকন্দ থেকে জারাফশান নদীর তীর বরাবর পূর্বদিকে এগিয়ে যাবে। আমরা বৃত্তাকারে তাদের পাশ কাটিয়ে গিয়ে উত্তরের পাহাড়ের দিক থেকে তাদের আক্রমণ করবো। তারা সেদিক থেকে আক্রমণ প্রত্যাশা করবে না। আমরা আমার চাচাজানকে দেখিয়ে দেবো যে ফারগানা নিজেকে রক্ষা করতে জানে।” পরিকল্পনাটা ওয়াজির খান তাকে বলেছে এবং সে পুরো বিষয়টা তাকে একে দেখালে বাবর বুঝতে পেরেছে এতে কাজ হলেও হতে পারে।

আলি মজিদ বেগ চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। “সুলতান, আপনি ঠিকই বলেছেন। উত্তরের গিরিপথ থেকে আমরা তাদের আক্রমণ করতে পারি এটা ব্যাটাদের মাথাতেও আসবে না।”

“আমরা আপনার চাচাকে প্রতিহত করতে পারব। এটা সম্ভব- অন্তত এখনকার মত হলেও। কিন্তু সাইবানি খান আসলে আমরা কি করবো- সে আসবেই?” তামবাল শান্ত কণ্ঠে প্রশ্নটা করে। আলি মজিদ বেগের মত সে বাবরের চোখের দিকে তাকায় না, চোখ সরিয়ে নেয়।

বাবর টের পায় তামবালের কথায় আবার অস্বস্তিকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। তৈমূরের রাজত্বে অনেক আগে থেকেই উজবেক সম্প্রদায় হামলা করে এসেছে, উত্তরের তৃণভূমির মাঝে অবস্থিত আশ্রয়স্থল ছেড়ে তারা ঘনঘন আক্রমণ করেছে এবং লুঠতরাজ চালিয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে, তাদের নতুন নেতা সাইবানি খানের নেতৃত্বে তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। তারা এবার প্রভূত্ব স্থাপনের অভিপ্রায়ে অভিযানে বের হতে চাইছে। আর ক্ষুদ্র ফারগানা যথেষ্ট লোভনীয় একটা লক্ষ্যবস্তু হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। “সময় হলে সেই উজবেক আর তার ছুঁচোদেরও আমরা সমুচিত জবাব দেবো,” বাবর নির্ভীক কণ্ঠে বলে।

“কিন্তু আমাদের মিত্র প্রয়োজন। তৈমূরের বংশধরদের অধীনে শাসিত রাজ্য বা ফারগানা কেউই একা নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারবে না। উজবেকরা, শেয়াল যেমন একটা একটা করে মুরগী ধরে তেমনি এক এক করে আমাদের পরাজিত করবে,” তামবাল বলতে থাকে।

“অবশ্যই আমাদের মিত্র প্রয়োজন, কিন্তু আমরা সেটা স্বাধীন মানুষ হিসাবে বেছে নেব, ভাল মনিবের অধীনে নতজানু দাসের মত নয়,” বাবর তাদের বোঝাতে চেষ্টা করে।

“স্বাধীন মানুষের চেয়ে একজন দাস হয়ত বেশি দিন বেঁচে থাকতে পারে। আর সময় যখন অনুকূল হবে সে তখন আবার স্বাধীনতা লাভের জন্য প্রয়াস নেবে। আমরা যদি আপনার চাচার অধীনতা মেনে নেই তবে আমরা উজবেকদের শায়েস্তা করতে পারব। আর সাইবানি খানের মাথা তার কাঁধের উপর থেকে গড়িয়ে পড়লে এবং তার ভিতরে খড় ভরে হারেমে ঝোলাবার জন্য একটা দর্শনীয় বস্তুতে পরিণত হলে ফারগানার স্বাধীনতার বিষয়টা বিবেচনা করার জন্য আমাদের পক্ষে সেটা হবে উপযুক্ত সময়।”

কামরার ভিতরে একটা ঐক্যমতের গুঞ্জন ধ্বনিত হয় এবং অবশেষে এবার তামবাল তার চোখের দিকে তাকায়। তার মুখের অভিব্যক্তি বিষণ্ণ কিন্তু ঠোঁটের সামান্য বাঁক সেটা ভেস্তে দিয়ে সন্তুষ্টি ঠিকই ফুটিয়ে তুলেছে যে তার কথা মোক্ষম স্থানে আঘাত করেছে।

বাবর সহসা উঠে দাঁড়ায় এবং সিংহাসনের নিচে একটা পাদানি থাকায় ভাগ্যকে মনে মনে ধন্যবাদ জানায় যা তার কিশোর অবয়বকে সামান্য বাড়তি উচ্চতা দান করে। “অনেক হয়েছে! আমরা আমার চাচাজানের বাহিনীকে আগে ফিরিয়ে দেব, এবং তারপরে লোকবলের ভিত্তিতে আমি- আপনারা কেউ না- সিদ্ধান্ত নেব ফারগানা কার সাথে মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হবে।”

গোত্রপতিরা কিছু না বলে সবাই পড়িমড়ি করে উঠে দাঁড়ায়- সুলতান দাঁড়িয়ে আছেন এসময়ে বসে থাকাটা একটা অচিন্তনীয় ব্যাপার, সে তারা মনে মনে যাই ভাবুক না কেন। এমনকি অপরের বাহু ছিঁড়ে নেয়ার মত শক্তিশালী যোদ্ধাও দরবারের এসব আদবকায়দা সম্বন্ধে পরিপূর্ণ ওয়াকিবহাল।

“আগামী চারদিন পরে আমরা রওনা দেব। আমি তোমাদের আদেশ করছি সমস্ত লোকজন নিয়ে এখানে এসে আমার সাথে যোগ দেবার জন্য। তাদের সবাইকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে আসতে বলবে।” সহজাত প্রবৃত্তির বশে বাবর কথাটা শেষ করে ঘুরে দাঁড়িয়ে দরবার থেকে বের হয়ে আসলে, তার উজির আর ওয়াজির খান তাকে অনুসরণ করে।

“সুলতান আপনি ভালই সামলেছেন বিষয়টা আর তর্কের কোনো অবকাশ না দিয়ে বুদ্ধিমানের কাজ করেছেন।” দরবারের দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়া মাত্র ওয়াজির খান মন্তব্য করে।

“আমি সত্যিই জানি না। আমার আহবানের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য আমাকে আগামী চারদিন অপেক্ষা করতে হবে। তাদের ভিতরে কেউ কেউ সম্ভবত সমরকন্দে আমার চাচার কাছে ইতিমধ্যে দূত পাঠিয়েছে। আমার চেয়ে তিনি তাদের বেশি উপঢৌকন দেবার সামর্থ্য রাখেন।” বাবর হঠাৎ ক্লান্ত বোধ করে আর তার মাথা যেন ব্যাথায় ছিঁড়ে যায়।

“সুলতান, তারা আসবে।” কাশিমের নিরুদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর বাবরকে চমকে দেয়। উজির সাহেব সাধারণত তাকে কোনো প্রশ্ন করা না হলে নিজে থেকে কথা বলেন না। মাত্র চার সপ্তাহ আগে আপনার নামে “খুতবা পাঠ করা হয়েছে-আপনার গোত্রপতিরা নিজের লোকদের কাছেই মুখ দেখাতে পারবে না যদি তারা আপনাকে এত দ্রুত আর যুদ্ধে নিজেকে প্রমাণ করার কোনো সুযোগ না দিয়েই পরিত্যাগ করে। আর সুলতান, এখন যদি আমার জন্য আর কোনো আদেশ না থাকে তবে আমি আমার কাজে ফিরে যেতে চাই।” সে দ্রুত তাদেরকে রেখে গলিপথ দিয়ে এগিয়ে যায়। “আমি কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি যেন তার কথাই ঠিক হয়,” বাবর বিড়বিড় করে বলে, তারপরে সহসা ক্ষেপে উঠে পাথরের দেয়াল একবার না দুইবার, লাথি বসিয়ে দিলে তার ভিতরে জমা হওয়া আবেগ অনেকটা প্রশমিত হয়। সে যখন তাকিয়ে দেখে ওয়াজির খান বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, তখন নিজের মুখে সামান্য হাসি ফুটিয়ে তোলে এবং এক মুহূর্তের জন্য তার মন থেকে দুশ্চিন্তার সব মেঘ অপসারিত হয়েছে।

***

বাবর জেনানামহলের দিকে এগিয়ে যেতে, পরিচারকের দল আগে আগে দৌড়ে যায় সুলতানের আগমন সংবাদ ঘোষণা করতে। আজকের দিনটা সেসব দিন থেকে কত আলাদা, যখন সে এই একই গলিপথ দিয়ে দৌড়ে গিয়ে তার মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ত, আর তিনি প্রথমে বকা দিলেও পরক্ষণেই পরম মমতায় তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিতেন। আর এখন কত আড়ম্বরের ঘনঘটা। মধূমক্ষিকার মত ঘরের বিন্যাসে প্রবেশ করতে, কালো চোখের একটা ঝলক আর মসৃণ, সুগঠিত গোড়ালির শোভাবর্ধনকারী সোনার মলের আভা সে দেখতে পায় এবং চন্দনকাঠের গন্ধে ভারী হয়ে থাকা বাতাসে শ্বাস নেয়। সে এখনও যদিও নারী সংসর্গ করেনি এবং বয়স এখনও অল্প হওয়া সত্ত্বেও মেয়েরা তার চোখে পড়ার জন্য এখনই প্রতিযোগিতা শুরু করেছে- এমনকি ফরিদা, কামবার আলীর তরুণী বিধবা স্ত্রী, তার মা দয়াপরবশ হয়ে তাকে হারেমে আশ্রয় দিলে, সেও বাদ যায় না। সে যদিও এখনও তার মৃত স্বামীর জন্য শোকপালন করছে, কিন্তু বাবর ঠিকই তাকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেছে। আর বাকীরা ইচ্ছা করেই তার যাত্রা পথে উঁকি দেয়, তাদের প্রত্যেকের চোখে স্পষ্ট আমন্ত্রণ।

সে যেখানে দেখে গিয়েছিল সেখানেই তার মাকে দেখতে পায়, কিন্তু এখন তিনি ঘুমিয়ে আছেন। তার বোন খানজাদা পিঠ সোজা করে মাটিতে বসে রয়েছে, থুতনির নিচে হাটু ভাঁজ করা, কামরার এককোণে বসে আনমনে মেহেদী রাঙান হাতে, সোনালী শেকলের প্রান্তে ফিরোজা খচিত বকলেসে বাঁধা পোষা বেজীর সাথে খেলছে। ভাইকে দেখামাত্র সে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায়। “ভালো?” সে ব্যগ্র কণ্ঠে জানতে চায়, কিন্তু গলার স্বর নিচু রাখে যাতে খুতলাঘ নিগার জেগে না উঠেন।

“আমরা অচিরেই জানতে পারবো। আগামী চারদিনের ভিতরে রওয়ানা দেবার আদেশ দিয়ে আমি আসছি। আম্মিজান কেমন আছেন?”

খানজাদার ভ্রু কুচকে উঠে। “তাকে কিছুতেই বোঝাতে পারবে না। তিনি ধরেই নিয়েছেন আমাদের চাচাজান মসনদ দখল করে তোমাকে হত্যা করবে। তিনি একবার তাকে নাকি বলতে শুনেছেন যে ফারগানা সমরকন্দের সাথে একটা আকর্ষণীয় বাড়তি অংশ হিসাবে যুক্ত হতে পারে। আম্মিজান বারবার বলছেন তিনি সবসময়ে আমাদের রাজ্যকে দখলযোগ্য আর ঘৃণার সাথে অভিহিত করতেন। আব্বাজান এ কারণেই তার সীমান্তে মাঝেমাঝে হামলা চালিয়েছিল- গৌরবের খাতিরে, দেখাতে চেয়েছিলেন তিনি মোটেই ভীত নন।”

“বেশ, আমি নিজেও অবশ্য ভীত নই। আমরা যদি এই হুমকির যথাযথ উত্তর দিতে ব্যর্থ হই তাহলে তৈমূরের বংশধর বলে আমাদের মুখ দেখাবার উপায় থাকবে না। পরাভব স্বীকার করার চেয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে মারা যাওয়াও আমি মেনে নেব।” বাবর তার নিজের কণ্ঠের আবেগে নিজেই চমকে উঠে। আড়চোখে তাকিয়ে দেখে তার মা ঘুম থেকে জেগে উঠেছেন। তার কথা নিশ্চয়ই তিনি শুনতে পেয়েছেন। তার চোখ যদিও এখনও লাল কিন্তু তার অভিজাত মুখাবয়বে গর্ব ঝলসে উঠে। “আমার বেটা,” মৃদু কণ্ঠে হাত বাড়িয়ে তিনি বলেন। “আমার বালক বীর।”

***

দূর্গের প্রকারবেষ্টিত সমতল ছাদের উপরে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে, তারাদের এত উজ্জ্বল বা এত বেশি সংখ্যককে আকাশের গায়ে ভেসে থাকতে সে আগে কখনও দেখেনি। বাতাস শীতল আর নির্মল। বুক ভরে তাজা বাতাস টেনে নিতে আসন্ন শীতের আমেজ বাবর অনুভব করতে পারে যখন নদীগুলো জমে বরফে পরিণত হবে। আর পাহাড়ের উপর থেকে নেকড়ের দল গ্রামগুলোতে এসে হাজির হবে এবং পশুপালকের নধর ভেড়াগুলো শিকার করবে।

আর কয়েকঘণ্টা পরেই সে তার প্রথম অভিযানে রওয়ানা দেবে। তার বাবার ঈগলের মত বটের তরবারি, আলমগীর তার পরিকর থেকে ঝুলছে কিন্তু সুলতানের বর্ম তার এখনও বড় হয়। ওয়াজির খান শাহী অস্ত্রশালা থেকে তার জন্য একটা ধাতব-শৃঙ্খল নির্মিত অলঙ্কৃত বক্ষাবরণী আর চূড়াযুক্ত শিয়োস্ত্রাণ খুঁজে বের করেছে, যেগুলো তার গায়ের প্রায় মাপমতই হয়েছে। তৈমূরের কোনো শাহজাদার ছিল এসব যুদ্ধসাজ, উপরের তারকারাজির মত বর্মে খচিত শীতল আর উজ্জ্বল পাথরের উপরে আঙ্গুল বুলিয়ে সে ভাবে, আর তার কি পরিণতি হয়েছিলো?

নিচের আস্তাবল থেকে মৃদু হ্রেষারব ভেসে আসে। ওয়াজির খান তাকে বলেছে, ঘোড়া আগে থেকেই আসন্ন যুদ্ধের কথা টের পায়। দূর্গের দেয়ালের বাইরে, বাবর ঝুড়িসদৃশ পা-ওয়ালা বহনযোগ্য ধাতব পাত্রে কয়লার গনগনে লাল আভা এখান থেকেই দেখতে পায়। অস্থায়ী শিবিরগুলো জেগে উঠতে শুরু করেছে। চামড়ার তাবুর ভেতর থেকে আবছা অবয়ব বাইরে বের হয়ে এসে হাত পা নেড়ে প্রত্যূষের শীতের আমেজ ভাঙতে চেষ্টা করে। পরিচারকের দল পানি ভর্তি জগ নিয়ে আসা যাওয়া করে আর আলকাতরায় ডুবান কাপড়ে আগুন ধরিয়ে মশাল জ্বালিয়ে দেয়।

তার প্রায় সব গোত্রপতিই এসেছে, বাবর সন্তুষ্ট চিত্তে ভাবে। চারহাজার সৈন্যের একটা বাহিনী নিয়ে সে যাত্রা শুরু করবে। সমরকন্দের শক্তির কাছে নেহাতই ছোট, কিন্তু নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে আর ক্ষতি সাধনের জন্য পর্যাপ্ত হয়ত সন্ধি আর মীমাংসায় সম্মত করানোর জন্য যথেষ্ট। তার মরহুম আব্বাজানের রেখে যাওয়া কৌতূহলকর আর ঘটনাবহুল সামরিক অভিযানের প্রতি আরও মনোযোগ দেয়া তার উচিত ছিল। আর সেটা না দেবার কারণে তাকে এখন ওয়াজির খানের পরামর্শের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। কিন্তু নিজেকে সে প্রতিশ্রুতি দেয় যে শীঘ্রই সব শিখে নেবে। তাকে শিখতেই হবে।

ভোরের আলো এখন ফুটতে শুরু করেছে, একটা ধূসর কমলা রঙের আলোর আভা পাহাড়ের উপর দিয়ে ভেসে উঠে তার এবড়োখেবড়ো প্রান্তরেখা আলোকিত করে তোলে। বাবর সহসা একদল অশ্বারোহীকে উপত্যকার উপর দিয়ে দ্রুতবেগে ছুটে আসতে দেখে- সম্ভবত দেরি করে আসা কোনো যোদ্ধার দল। ঘোড়সওয়াড়দের এগিয়ে আসবার দ্রুততায় প্রীত হয়ে সে পাথরের সিঁড়ি বেয়ে নিচের আঙ্গিনায় নেমে আসে তাদের স্বাগত জানাতে।

দূর্গের প্রবেশ পথের ঢাল ধরে ঘোড়ার আগুয়ান বহর ভাপ ছড়াতে ছড়াতে উঠে আসে। তাদের দলনেতা চিৎকার করে দূর্গের গজাল দিয়ে মজবুত করে তোলা। দরজা খুলে তাদের ভিতরে প্রবেশ করতে দেবার অনুমতি প্রার্থনা করে।

“দাঁড়াও!” ওয়াজির খানের কণ্ঠস্বর বাতাস চিরে ভেসে আসে। বাবর দেখে হন্তদন্ত হয়ে নেমে এসে তার দেহরক্ষী বাহিনীর প্রধান সদর দরজার জাফরির ফুটো দিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে। তাদের সবুজ রেশমের বুকে গুঁড়িমেরে থাকা বাঘের নিশান ঘোষণা করছে নতুন আগত অশ্বারোহী বাহিনী ফারগানা নয় সমরকন্দ থেকে আসছে।

অশ্বারোহী বাহিনীর দলনেতার ঘোড়া লাগামে টান পড়তে পিছিয়ে আসে। “আমরা সংবাদ নিয়ে এসেছি,” সে কর্কশ কণ্ঠে বলে। “আমাদের সুলতান ইন্তেকাল করেছেন।”

“মহামান্য সুলতান, আপনি অনুগ্রহ করে সরে দাঁড়ান। আমাকে ব্যাপারটা সামলাতে দেন। পুরোটাই কোনো ধরণের চালাকি হতে পারে,” ওয়াজির খান তাকে সতর্ক করে দিয়ে তারপরে অশ্বারোহী বাহিনীকে ভিতরে প্রবেশের সুযোগ করে দেবার জন্য প্রহরীদের ইঙ্গিত করে দরজা খুলে দেবার জন্য। তরবারির বাঁটে হাত রেখে সে সামনে এগিয়ে আসে। “তোমাদের পরিচয় দাও।”

“আমি বাইসানগার, সমরকন্দের সুলতানের দেহরক্ষী বাহিনীর একজন অধিনায়ক। এরা আমার লোক।”

বাইসানগারের মুখ ঘাম আর ধূলোয় মাখামাখি কিন্তু বাবরের যেটা সবচেয়ে চোখে পড়ে সেটা হল ধূলোর আস্তরণের নিচে তার চরম ক্লান্তি। এটা কোনো ধোকাবাজির ঘটনা হতে পারে না। ওয়াজির খানের হুঁশিয়ারী অমান্য করে সে সামনে এগিয়ে আসে। “আমি বাবর, ফারগানার সুলতান। আমার চাচাজানের কি হয়েছে?”

“আমাদের সুলতান ফারগানার মহামান্য সুলতানকে… প্রতিরক্ষার অভয় দানের জন্য সমরকন্দ থেকে রওয়ানা হয়েছিলেন। রাতের বেলায় তিনি তার বাহিনীর সাথে একটা খরস্রোতা নদীর পাশে অস্থায়ী ছাউনি স্থাপন করেছিলেন এবং তার লোকের নদীর উপরে একটা অস্থায়ী সেতু নির্মাণের সময়ে উজবেকরা আমাদের অতর্কিতে আক্রমণ করে। আলো ফোঁটার দু’ঘণ্টা পরের ঘটনা এটা। বিস্ময় আর বিভ্রান্তিতে আমরা কচুকাটা হয়ে যাই। আমাদের রণহস্তী, উটের বহর আর অন্যান্য ভারবাহী জম্ভর দল আতঙ্কে দিগ্বিদিক ছুটে পালায়, তাদের সামনে যা কিছু পড়েছে সব কিছু তারা মাড়িয়ে গেছে। আমাদের লোকেরা বীরত্বের সাথে মোকাবেলা করতে চেষ্টা করে কিন্তু তাদের বেশিরভাগই মারা যায়। কেউ কেউ অসমাপ্ত সেতুর উপর দিয়ে পালাতে চাইলে তাদের ভারে সেতু ভেঙে পড়ে এবং পানির তোড়ে তারা ভেসে যায়। নদীর পানি শীঘ্রই লাল হয়ে উঠে- উজবেক আর আমাদের রক্তে, এটা সত্যি- কিন্তু আমরা পর্যদস্ত হয়েছি।”

“আর আমার চাচাজান?”

“আক্রমণ আরম্ভ হবার সময়ে তিনি নদীর তীরে তার লাল রঙের তাবুতে অবস্থান করছিলেন। তিনি সেখান থেকে কোনমতে ঘোড়ায় চেপে শত্রুর মোকাবেলা করতে এগিয়ে আসেন কিন্তু কোথা থেকে একটা তীর এসে তার গলা বিদ্ধ করতে তিনি মাটিতে পড়ে গিয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকেন। আমরা তাকে ঘোড়ার খুরের আওতা থেকে সরিয়ে নিয়ে আসি বটে, কিন্তু হেকিম বৈদ্যদের ডেকে কোনো লাভ হয়নি- হেকিমের কিছুই করার ছিল না। তারা রক্তপাতই বন্ধ করতে পারেনি। কয়েক ঘণ্টার ভিতরেই তিনি ইন্তেকাল করেন। খবরটা আমাদের লোকদের ভিতরে ছড়িয়ে পড়তে কোনো কোনো গোত্রপতি, অনাগত আশঙ্কায় নিজেদের লোকদের ডেকে নিয়ে গ্রামে ফিরে গেছে।” ক্ষোভে বাইসানগারের কণ্ঠস্বর তিক্ত শোনায়।

“আর তোমরা কেন এখানে এসেছো?”

“আপনার চাচাজানের অন্তিম ইচ্ছা পূরণ করতে। ফারগানার জন্য লোভ করার কারণেই আল্লাহতালা তাকে শাস্তি দিয়েছে। গলায় জমে থাকা রক্তের বুদবুদের ভিতর দিয়ে শেষ নিঃশ্বাস নেবার তিনি আপনার কাছে করুণা ভিক্ষা চেয়েছেন যাতে বেহেশতের উদ্যানে প্রশান্তিতে বিশ্রাম নিতে পারেন।”

বাবর ভাবে, আমি যে চাচাজানকে চিনি মোটেই তার মত আচরণ না, কিন্তু হয়ত মৃত্যু সন্নিকটে উপস্থিত বুঝতে পারলে মানুষ বদলে যায়।

“তুমি যা বলছে তার স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ তোমার কাছে আছে?” ওয়াজির খানের এক চোখে এখন জ্বলজ্বল করছে সন্দেহ এবং বাবর এবার খেয়াল করে সে তার লোকদের এখনও সরে দাঁড়াবার নির্দেশ দেয়নি। বাইসানগারের দিকে তার তিনজন সৈন্য এখনও ধনুক তাক করে দাঁড়িয়ে আছে।

“এই আমার প্রমাণ।” বাইসানগার তার আঁটসাট চামড়ার জ্যাকেটের গভীরে হাত ঢুকিয়ে একটা ছোট, দাগযুক্ত থলে বের করে। থলেটার গলার কাছের বেণী করা দড়ির ফাঁস আলগা করে সে ভেতর থেকে একটা কাপড়ের টুকরো বের করে আনে। যত্নের সাথে, শ্রদ্ধাবনত চিত্তে, সে কাপড়ের ভাঁজ খুলতে ভেতরের বস্তু দৃশ্যমান হয়: রক্তে রঞ্জিত একটা সোনার বেশ ভারী আংটি।

বাইসানগার আংটিটা বাড়িয়ে ধরলে বাবরের দম আটকে আসতে চায়। “দেখেন,” প্রায় ফিসফিস কণ্ঠে বাইসানগার বলে, “মহান তৈমূরের অঙ্গুরীয়।” হলুদ ধাতুর উপর খোদাই করা ক্রুদ্ধ বাঘটা এখনই বুঝি গর্জে উঠে লেজ ঝাপটাবে।

***

যুদ্ধকালীন মন্ত্রণা পরিষদের মেজাজ এবার একেবারেই আলাদা। বাবর, একপাশে উজির আর অন্যপাশে ওয়াজির খান পরিবেষ্টিত হয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে, ভেতরে অবস্থানরত গোত্রপতিদের ঘটনাবলীর অসাধারণ পরিণতি নিয়ে উচ্চকণ্ঠে আলাপ করতে শোনে।

“সুলতান, নিয়তির লিখন পরিষ্কার।” তামবালের চোখ উত্তেজনায় চকচক করে। “সুলতান আপনাকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করে গিয়েছেন তার কোনো পুত্র সন্ত নি ছিল না। অন্যরা সমরকন্দ দখল করতে চাইবে, কিন্তু আমরা যদি একটু তৎপরতা দেখাই তাহলে সেটা আপনার নিজের রাজত্ব হতে পারে।”

বাবর চেষ্টা করেও মুখে বিড়ম্বনার হাসি ফুটে উঠা ঠেকাতে পারে না। আর উজবেকদের কি হবে? কয়েকদিন আগেই আমরা তাদের সম্পর্কে আতঙ্কে ছিলাম। আর তোমাদের কথাই ফলেছে তারা আমার চাচাজানকে বেঘোরে মেরেছে, তার সৈন্যবাহিনী তছনছ করে দিয়েছে, তার রসদের বহর কুক্ষিগত করেছে। এখন তারাও যদি সমরকন্দ দখলের পায়তারা করে?”

“কিন্তু এখন প্রায় শরৎ কাল। মৌসুম আমাদের পরম বান্ধব। প্রতিবছর একই ঘটনা ঘুরে ফিরে ঘটে। প্রতিবার শীতের সময়ে সাইবানি খান উত্তরে তুর্কিস্তানের নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে যায় আর বরফ না গলা পর্যন্ত সেখানেই থাকে।”

“আলি মজিদ বেগ, আপনার কি অভিমত?” কিন্তু বাবর ইতিমধ্যেই তার উত্তরটা জেনে ফেলেছে। লোকটার পুরো দেহ থেকে ইতিমধ্যে উচ্ছ্বাস এবং আত্মবিশ্বাস চুঁইয়ে পড়তে শুরু করেছে। সম্ভাব্য গৌরব আর গনিমতের মালের কথা চিন্তা করে তার চোখে উজ্জ্বল দীপ্তি ফুটে উঠেছে। সমরকন্দ ধনী সমৃদ্ধ শহর ঠিকই, কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা এটা ছিল তৈমূরের সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু। তৈমূরের বংশোদ্ভূত প্রতিটা শাহজাদা আর অভিজাত ব্যক্তি সেখানে নিজের উপস্থিতি কামনা করে। বাবরও এর ব্যতিক্রম না। বয়স তার এখনও যদিও অল্প কিন্তু নিয়তি তাকে এমন একটা সুযোগের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে যা হয়ত জীবনে দ্বিতীয়বার সে পাবে না। সে দীর্ঘজীবন কামনা করে না বা রেশমের তাকিয়ায় শুয়ে কি সুযোগ হেলায় হারিয়েছে সেটা ভেবে শান্তিতে মরতেও চায় না। মনে কোনো খেদ নিয়ে সে বেহেশতে যেতে চায় না।

আলি মজিদ বেগ তাকে নিরাশ করে না। “আমি বলি কি শীত আসবার আগেই আমাদের রওয়ানা দেয়া উচিত।”

“আর ওয়াজির খান, আপনি কি বলেন?”

তার সাথে পরিকল্পনা আলোচনার সময় এখন বাবরের হাতে নেই। সে কি তার শরীরে ভীষণভাবে আলোড়ন তোলা উত্তেজনা যা তাকে রীতিমত কাঁপিয়ে তুলেছে তা প্রশমিত করতে কিছু বলবে? ওয়াজির খান তার একমাত্র চোখ দিয়ে বাবরের দিকে ভাবুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। বাবর ভাবে এই শুরু করলো শীতল যুক্তির বিন্যাস, আমার উত্তেজনা প্রশমিত করার অভিপ্রায়ে। সে আমাকে বলবে আমার বয়স অল্প নিজের রাজত্ব বজায় রাখা এক কথা আর আরেকটা রাজ্য দখল করা একেবারেই আলাদা কথা। সে আমাকে বলবে অপেক্ষা করেন, আমাকে বলবে অভিজ্ঞতাকে অবশ্যই সাহস, ধৈৰ্য্য আর উচ্চাশার সাথে সমন্বিত করতে হবে।

“তামবাল, ঠিকই বলেছে। রক্তের তৃষ্ণা নিবারন করে সাইবানি খান তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে এখন উত্তরের দিকে যাচ্ছে, জাল্লারটাস নদীর তীর বরাবর ফারগানা থেকে অনেকদূরে তাদের গন্তব্যস্থল। আমি রেকী করতে লোক পাঠাব। কিন্তু উজবেক নির্মমতা অনুপস্থিত থাকা সত্ত্বেও এধরণের অভিযানের জন্য আমাদের সৈন্য সংখ্যা অপ্রতুল। আমাদের মিত্র দরকার, বেতনভোগী- আপনি যাদের বলেন, ভাড়াটে সৈন্য। পার্বত্য গোত্রগুলোকে আমাদের সাথে যোগ দেবার জন্য প্ররোচিত করতে হবে। আমরা যদি বেতন দেই তাহলে তারা আসবে, এবং তারা যদি আসে আমরা তাহলে আল্লাহ সহায় থাকলে নিশ্চয়ই বিজয়ী হব।”

বাবর এমনভাবে ওয়াজির খানের দিকে তাকায় যেন সে আগে কখনও তাকে দেখেনি। “আপনি হবেন আমার সর্বাধিনায়ক। যা প্রয়োজন বিনা দ্বিধায় সেটা সম্পন্ন করেন। আমরা দু’সপ্তাহ পরে রওয়ানা দেব।”

“সুলতান।” ওয়াজির খান মাথা নত করে।

***

শীতল ধরণীর বুকে ঘোড়ার খুর আঘাত করে, তারপরে আবার, যেন তাদের খুরের বোলই একমাত্র বাস্তবতা। বাবর ক্লান্তিতে টলতে থাকলে সে তার ঘোড়ার কেশর আঙ্গুল দিয়ে পেচিয়ে ধরে নিজেকে সামলে নেয়। আকশী দূর্গ ত্যাগ করার পরে, প্রতিদিন সে অগ্রগামী বাহিনীর সাথে রওয়ানা হয়েছে, তাবু, রান্নার সরঞ্জাম আর রসদবাহী, ভারবাহী পশুর দলকে ছেড়ে এবং প্রতিদিন রাতের বেলা আবার পশ্চাদবর্তী তাদের সাথে এসে যোগ দিয়েছে। চারদিন আগে তার পুরো বাহিনী ফারগানা অতিক্রম করে সমরকন্দের ভূমিতে প্রবেশ করেছে কিন্তু নিঃসঙ্গ কয়েকজন পশুপালক ছাড়া আর কারও দেখা তারা পায়নি।

বাবর উপরের দিকে তাকায়। এক ঘণ্টার ভিতরে সূর্য তাদের সামনে অস্ত যাবে কিন্তু তার আগেই পাহাড়ী গিরিপথ আর খরস্রোতা নদী অতিক্রম করে পশ্চিমে তাদের তিনশ মাইল পথ পরিক্রমা শেষ হবার কথা। সমরকন্দের অট্টালিকাসমূহের গম্বুজ নৈবেদ্যের মত তাদের সামনে অবারিত পড়ে রয়েছে। সম্ভবত আজ রাতেই সে তৈমূরের রাজধানী অধিকার করবে। বাবর মানসপটে দেখতে পায় নতুন তৈমূর বংশীয় সুলতান তাদের রক্ষা করতে উপস্থিত হয়েছে দেখতে পেয়ে শহরের কৃতজ্ঞ মানুষ তার চারপাশে এসে জড়ো হয়েছে।

ভাবনাটা মনে উদিত হতেই সে তার ঘোড়র পেটে খোঁচা দেয় এবং ক্লান্তির শেষ সীমায় পৌঁছে যাওয়া সত্ত্বেও, জন্তুটা ছিটকে সামনে এগোয়, একটা টিলার ঢাল বেয়ে উঠে যায়। সেখান থেকে কিছুটা দূরে জারাফশান নদীর টলটলে পানির ওপারে রোমাঞ্চকর আকাশের গায়ে আবছাভাবে ফুটে আছে সমরকন্দ। বাবর সম্মোহিতের ন্যায় তাকিয়ে থাকে। তার শ্বাস গলায় আটকে আসে। সম্ভবত, এই মুহূর্তের পূর্বে, সে বিশ্বাসই করতো না সমরকন্দ বলে সত্যি কিছু একটার অস্তিত্ব রয়েছে। এখন আর সন্দেহের অবকাশ নেই। কোনো উপকথার গল্প না, কোনো অশরীরি প্রেতাত্মার আনাগোনায় অতিষ্ট না, কেবল রক্ত মাংসের মানুষের বসবাস রয়েছে এখানে, যা সে নিজের বলে দাবি করতে এসেছে।

বাবর তার কণ্ঠ চিরে একটা উল্লসিত চিৎকার বের করতে চায় কিন্তু তার উল্লাস গলাতেই শুকিয়ে আসে। দক্ষিণে শহর থেকে কয়েক মাইল দূরে সমরকন্দের প্রসিদ্ধ ফলের বাগানের পত্রহীন গাছ যা কয়েক সপ্তাহ আগেই সুগন্ধি আপেল আর ডালিমের ভারে নুয়ে ছিল সেখানে একটা অস্থায়ী ছাউনি দেখা যায়। হিম বাতাসে নিশান উড়তে দেখা যায় আর রান্নার জন্য তৈরি উনুন থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী পেঁচিয়ে আকাশে উঠে যাচ্ছে। তাকিয়ে থাকার সময়েই বাবর দেখতে পায় অশ্বারোহী একটা বাহিনী ছাউনিতে দুলকি চালে প্রবেশ করেছে, বিভিন্ন তাবুর ভিতর দিয়ে তারা দক্ষতার সাথে বিচরণ করতে করতে এগিয়ে গেলে ট্রাম্পেটের ধাতব শব্দ তাদের স্বাগত জানায়।

তারমানে, তার সমস্ত ব্যগ্রতা সত্ত্বেও, সমরকন্দে প্রথমে পৌঁছান সম্ভাব্য সুলতানের কাতারে সে পড়ে না। কেউ একজন তার আগেই এসে হাজির হয়েছে। ছুরিকাহতের মত হতাশার একটা অনুভূতি তাকে বিদ্ধ করে।

ওয়াজির খান তার পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে এবং সামনের দৃশ্যাবলী দেখে সেও উচ্চস্বরে গাল বকছে। “সুলতান, আমি আমার অগ্রগামী সৈন্যদের পাঠাব।”

“সাইবানি খানের শিবির এটা?”

“আমার মনে হয় না। শিবিরটা যথেষ্ট বড় না। আর মনে হয় না যে শহর কেউ আক্রমণ করেছে বা অবরোধ করেছে, সাইবানি খান এখানে উপস্থিত থাকলে সে চুপ করে বসে থাকতো না।”

“তাহলে কে?”

“আমি জানি না। আমাদের আর সামনে এগোনো ঠিক হবে না। আমরা ঐ পাহাড়ের পাদদেশে ফিরে যাবো, সেখানে বাতাসের আড়ালে ছাউনি ফেলবো, আমাদের অস্তিত্ব কেউ টের পাবে না, আর আগামীকাল আমাদের মূল বাহিনীর এখানে পৌঁছাবার জন্য অপেক্ষা করবো।”

ওয়াজির খান বাবরের অভিব্যক্তিতে ফুটে উঠা মূর্ত হতাশা ঠিকই বুঝতে পারে। “এই জায়গাটার নাম কোলবা টিলা, আশা আর স্বপ্নের মিলনস্থল। পাঁচ বছর আগে আপনার মরহুম আব্বাজানের সাথে, এখানে, এই স্থানে আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম আমাদের পিছনে ছিল ফারগানার সেনাবাহিনী। সুলতান, আপনার মত তিনিও সমরকন্দের দিকে তাকিয়ে ছিলেন এবং যা দেখেছিলেন সেটা তার হৃদয়ে শ্বাসরুদ্ধকর উচ্চাশা আর কামনার জন্ম দিয়েছিলো।”

“তারপরে কি হয়েছিলো?”

“সমরকন্দের সুলতান পশ্চিমে বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত ছিলেন। আক্রমণের জন্য সময়টা ছিল নিখুঁত, কিন্তু আল্লাহ্র অভিপ্রায় বোঝা মুশকিল। সেদিন রাতেই আপনার আব্বাজান, যিনি এত তীব্র গতিতে ঘোড়া দাবড়ে এসেছিলেন যে তার শ্রেষ্ঠ ঘোড়াগুলোর একটা ক্লান্তির ধকল সামলাতে পারেনি, এমন ভীষণ জ্বরে আক্রান্ত হন যে হেকিমরা তাকে বাঁচাবার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলো। আমাদের সামনে ফিরে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো গত্যন্তর ছিল না। আপনার আব্বাজান কষ্ট পেয়েছিলেন কিন্তু সেটাই ছিল তার নিয়তি।”

“আমার আব্বাজান আর চাচাজান পরস্পরকে এত ঘৃণা করতো কেন? তারা রক্তসম্পর্কের ভাই।”

“সৎ-ভাই, ভিন্ন মায়ের গর্ভে জন্ম নেয়া এবং যে মুহূর্ত থেকে তারা বুঝতে পারে যে দু’জনেই একই জিনিস কামনা করে-তৈমূরের শহর, তারা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বীতে পরিণত হয়। আপনার চাচাজান ছিলেন চার বছরের বড়। তিনি সমরকন্দ দখল করেন আর বাকি জীবনটা সেজন্য আপনার আব্বাজানকে বিব্রত করতে ব্যয় করেছেন। কিন্তু আপনার আব্বাজান এমন কিছু অর্জন করেছিলেন যেটা তিনি পারেননি। তার অসংখ্য স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও, এবং হেকিমের ভেষজ আর মালিশ ব্যবহার করেও তিনি একজন উত্তরাধিকারীর জন্ম দিতে ব্যর্থ হন যে তার অবর্তমানে মসনদে অধিষ্ঠিত হবে। অন্য কোনো কারণে না, কেবল এ জন্যই তিনি আপনার আব্বাজানকে ক্ষমা করতে পারেননি। এজন্যই তিনি আপনার কাছ থেকে ফারগানা ছিনিয়ে নেবার পায়তারা করেছিলেন। সম্ভবত আপনাকে জানে শেষ করে দেবারও অভিপ্রায় তার ছিল।”

বাবর মানসপটে চাচাজানের অগ্রসর হবার সংবাদে তার বিহ্বল আম্মিজানকে তীব্র যন্ত্রণায় কাঁদতে দেখে। চাচাজানের শত্রুতার আসল কারণ তিনি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু মৃত্যুর সময়ে তার চাচাজান ভুল বুঝতে পারেন এবং তৈমূরের আংটি তাকে দিয়ে যান। এটা নিয়তির কারসাজি ছাড়া আর কি? সমরকন্দ শাসন করাই তার নিয়তি, এবং তার আব্বাজানের মত সারা জীবন নিজেকে হতাশার জালে জড়িয়ে রাখতে হবে না।

“সুলতান, ফিরে চলুন।”

বাবর বুনো উন্মত্ততায় ঘোড়া দাবড়ে গিয়ে এসব অনাহুত আগন্তুকদের মুখোমুখি হয়ে তার স্বপ্নে বাগড়া দেয়ার জন্য তাদের একটা চরম শিক্ষা দেয়ার অভিপ্রায় অনেক কষ্টে দমন করে। বিষণ্ণ চিত্তে সে ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নেয় এবং কোলবা টিলার উপর থেকে বাড়ন্ত ঘাসের ঢিবির মধ্যে দিয়ে ওয়াজির খানকে অনুসরণ করে নিচে নেমে আসে।

শীঘ্রই তাবু টাঙানো হয় কিন্তু ধোঁয়ার গন্ধে সমতলে ছাউনি ফেলা লোকগুলো টের পেয়ে যাবে ভেবে গরম খাবারের বন্দোবস্ত করা হয় না। তাপমাত্রা হ্রাস পেতে বাবর কয়েক পরত ভারী ঝাঝালো গন্ধের ভেড়ার চামড়া গায়ে চাপিয়েও শীতে কাঁপতে থাকে। অবশেষে নিজের অজান্তে কখন যেন সে ঘুমিয়ে পড়ে তাকে ঝাঁকি দিয়ে কেউ তার তন্দ্রা ভাঙালে তার মনে হয় কয়েক মিনিট অতিক্রান্ত হয়েছে। “সুলতান, আমার কাছে সংবাদ আছে।” ওয়াজির খান তার পাশে হাঁটু ভেঙে বসে আছে। তার মুখের অভিব্যক্তিও অনেকটাই স্বাভাবিক। এমনকি সেখানে সামান্য হাসির আভাসও সে যেন দেখতে পায়। “আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে আমরা হৃদয় বিনিময়ের কোনো ঘটনায় বাগড়া দিয়েছি।”

“আপনি কি বোঝাতে চাইছেন?”

“পাঁচদিন আগে, কুনদুজের শাহজাদা, আপনার জ্ঞাতি ভাই মাহমুদ এখানে উপস্থিত হন। পুরো শহর না কেবল একটা মেয়েকে এখান নিয়ে যাবার অভিপ্রায় তার ছিল। সমরকন্দের বিশৃঙ্খলার ভিতরে সে ভেবেছিল নিঃশব্দে ভেতরে প্রবেশ করে তাকে খুঁজে বের করবে। মেয়েটা আর কেউ না প্রধান উজিরের কন্যা।”

“সে বসে আছে কেন?” বাবরের নিজের কানকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। তার আম্মিজানের প্রিয় বোনের ছেলে মাহমুদকে শেষবার যখন দেখেছে তখন সে ছিল উচ্ছল, দুরন্ত একটা ছেলে, যার মুখে তখনও দাড়ি গজায়নি আর বাঁদরামির কারণে, যাকে প্রায়ই ঝামেলায় পড়তে হত। বাবর অন্ধের মত তার পেছনে ঘুরে বেড়াত। সেই মাহমুদ একটা মেয়ের জন্য বিরহে কাতর হয়ে মনোকষ্টে ভুগছে এই ধারণাটাই তার কাছে হাস্যকর মনে হয়।

ওয়াজির খানের মুখে আবার চিরাচরিত গম্ভীর অভিব্যক্তি ফিরে এসেছে। “আপনার ভাই শহরের প্রবেশ দ্বার রুদ্ধ দেখতে পেয়েছেন। প্রধান উজির নিজেকে সমরকন্দের সুলতান বলে ঘোষণা করেছে- শহর আর আশেপাশের পুরো এলাকার।

“সে এই অধিকার কিভাবে লাভ করলো?”

“কোনভাবেই না। তৈমূরের সাথে তার কোনো রক্তের সম্বন্ধ নেই। কিন্তু সে ক্ষমতাবান। কোষাগার তার নিয়ন্ত্রণে সে ইচ্ছা করলে যে কাউকে ঘুষ দিয়ে বশ করতে পারে।”

“কিন্তু তিনি যখন শুনবেন প্রয়াত সুলতানের ভাস্তে আমি এখানে এসেছি তিনি নিশ্চয়ই তার দাবি ত্যাগ করবেন। তিনি তার চারপাশের লোকদের উদ্দেশ্যে যতই মোহর বর্ষণ করুক আমার দাবি তার চেয়ে অনেক জোরাল।”

বাবরের কণ্ঠের বালকসুলভ ক্রোধ টের পেয়ে ওয়াজির খান আবার হেসে উঠে। “তিনি সংবাদ পেয়েছেন যে আপনি আসছেন কিন্তু তিনি ঘোষণা দিয়ে বসেছেন যে কোনো অনভিজ্ঞ কিশোরের হাতে তিনি মসনদ ছেড়ে দেবেন না। আর শাহজাদা মাহমুদের সাথেও নিজের মেয়ে বিয়ে দেবেন না। তিনি মনে মনে পরিকল্পনা করেছেন আপনার আরেক জ্ঞাতি ভাই- কাবুলের শাহজাদার সাথে তার মেয়ের বিয়ে দেবেন।”

“আমরা তাকে বিয়ে দেওয়াচ্ছি।” বাবর লাফিয়ে উঠে দাঁড়াতে তার গায়ের ভেড়ার চামড়ার কম্বল ছিটকে যায়। “আমার ঘোড়া নিয়ে আসতে বলেন, আমি আমার ভাইয়ের শিবিরে যাব।”

আকাশে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে এমন সময় বাবর তার দেহরক্ষীদের সাথে নিয়ে, মাহমুদের ছাউনির দিকে এগিয়ে যায়, একটা কালো আলখাল্লায় তার আপাদমস্তক আবৃত।

“হুঁশিয়ার।” নির্জীব ধূসর আলোর পেছন থেকে এক সৈনিকের কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। “নিজের পরিচয় দেন।”

“বাবর, ফারগানার সুলতান, যিনি তার ভাই কুন্দুজের শাহজাদা মাহমুদের, সাথে দেখা করতে ইচ্ছুক।”

নিরবতা, তারপরে বিড়বিড় আলোচনা, তারপরে একটা জ্বলন্ত মশাল উঁচু করে ধরতে চারপাশ আলোকিত হয়ে উঠে। সৈন্যরা তার ছোট দলটা ঘিরে রাখতে বাবর হাত দিয়ে চোখ আড়াল করে। অবশেষে সে একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে পায়, সে শেষবার যেমন শুনেছিল তার চেয়ে এখন অনেক গম্ভীর হয়েছে কিন্তু আন্তরিকতা সেই আগের মতই আছে। “ভাই, তোমাকে স্বাগতম।” ঘাড় পর্যন্ত লম্বা কালো অবিন্যস্ত চুল, বাম হাতের দাস্তানায় একটা বাজপাখি নিয়ে মাহমুদ এগিয়ে এসে। ডানহাত দিয়ে বাবরের কাঁধ জড়িয়ে ধরে। “অসময়ে এসে ভোর বেলা বাজপাখি দিয়ে শিকারের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমি খুশি হয়েছি তোমাকে দেখে।” সে একটা বিশাল বর্গাকার তাবুর দিকে ইশারা করে।

মাটিতে পুরু গালিচা পাতা এবং দেয়াল আর ছাদ কাপড়ের পর্দা দিয়ে আড়াল করা। মাহমুদ তার বাজপাখির চোখে ঠুলি পরিয়ে সোনালী দাঁড়ে বসিয়ে দেয়, আর নিজে মখমলের তাকিয়ার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাবরও তার দেখাদেখি একই কাজ করে। “তোমার আব্বাজানের মৃত্যুর সংবাদ শুনে আমি দুঃখ পেয়েছি। তিনি ছিলেন একজন খাঁটি মানুষ আর মহান যোদ্ধা। তার আত্মা শান্তি লাভ করুক। কুন্দুজে আমরা তার স্মরণে নিশ্চয়ই শোক পালন করেছি।”

“ধন্যবাদ।” বাবর মাথা নামিয়ে বলে।

“আর আমার খুদে ভাইটা এখন তাহলে সুলতান।”

“আপনি যেমন একদিন হবেন।”

মাহমুদ হাসে। “সত্যি।”

“কিন্তু আজ আপনার ভাবনা অন্য খাতে বইছে।”

মাহমুদের হাসি কান পর্যন্ত গিয়ে ঠেকে। “বাবর, তুমি যদি তাকে দেখতে। রেশমের মত ত্বক, ধনুকের ছিলার মত টানটান দেহ আর প্রায় আমারই সমান লম্বা। আমি তাকে বেগম করবো। আমি প্রতিশ্রুতি দিয়েছি আর সেটা ভঙ্গ করার কোনো অভিপ্রায় আমার নেই।”

“তোমাদের দেখা হয়েছিলো কোথায়?”

“সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা কোরো না- আমি মোটেই মেয়েদের ছদ্মবেশে উজিরের হারেমে গোপনে প্রবেশ করিনি। ব্যাপার হয়েছে কি, গত বছর তার বাবা সমরকন্দ থেকে কুন্দুজ আসছিলো রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব নিয়ে তখন সে তার সাথে সফরসঙ্গী হিসাবে ছিলো। তারা আমাদের উত্তরের সীমান্ত দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতে দস্যুদের কবলে পড়ে। আমি আমার সৈন্যদের নিয়ে যাচ্ছিলাম তাদের অভ্যর্থনা জানাতে। আক্রমণ যখন হয় আমরা নিকটেই ছিলাম। আমরা শোরগোলের শব্দ শুনে তাদের উদ্ধার করতে ছুটে যাই। আর তখনই আমি তাকে প্রথম দেখি- সে একটা পাথরের পেছন থেকে যার আড়ালে সে লুকিয়ে ছিল বের হয়ে আসে, তার নেকাব আর পরণের কাপড় অর্ধেকই ছেঁড়া…” মাহমুদ চুপ করে যায় সেই নয়নাভিরাম দৃশ্য আবার কল্পনা করে।

“প্রধান উজিরের উচিত তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা।”

“সে তাই ছিল। কিন্তু কুন্দুজ কাবুলের মত সমৃদ্ধ না।” মাহমুদ কাঁধ ঝাঁকায়। “আর, ভাইটি তুমি কি জন্য এখানে এসেছো?”

“উচ্চাশা নেই এমন লোকের থেকে সাবধান।” বাবরের মনে তার আব্বাজানের এই কথাটা অনাদিষ্টভাবেই চকিতের জন্য উঁকি দেয়। কিন্তু যার উচ্চাশা আছে তার থেকেও কি সতর্ক থাকা উচিত নয়? মাহমুদ কি আসলেই এই সময়ে সমরকন্দ এসেছে কেবলই একটা মেয়ের জন্য, হোক না সে যতই রূপসী?

বাবর ঠিক করে সত্যি কথাই বলবে। “সমরকন্দের সুলতান যদিও আমার আব্বাজানের ভাই ছিলেন কিন্তু তিনি মোটেই ফারগানার মিত্র ছিলেন না আর আমাকে মসনদ চ্যুত করার ব্যবস্থা প্রায় পাকা করে ফেলেছিলেন। কিন্তু পথে মৃত্যু বরণ করার সময়ে তিনি তার লোকদের আদেশ দিয়ে যায় এটা আমার কাছে পৌঁছে দেবার জন্য।” বাবর তার হাত প্রসারিত করে দেখায়। তার অনামিকায় তৈমূরের অঙ্গুরীয়, এখন আর তাতে রক্তের দাগ লেগে নেই, শোভা পাচ্ছে। আংটিটা তার হাতে সামান্য বড় হলেও সে লাল রেশমের সুতো দিয়ে ব্যাপারটা আপাতত সামলে নিয়েছে। জ্বলন্ত কাঠ কয়লার কুলঙ্গি থেকে ভেসে আসা আলোয় আংটিটা দ্যুতি ছড়ায় আর সে শুনতে পায় মাহমুদ জোরে শ্বাস নেয়।

“তুমি বিশ্বাস কর যে তুমিই তৈমূরের উত্তরাধিকারী?”

“আমার ধমনীতে তার রক্ত বইছে। আমি আমার শহর ঠিকই আদায় করে নেব।”

“আমার ধমনীতেও তার রক্তই বইছে,” মাহমুদ মৃদু কণ্ঠে বলে। তারা পরস্পরের চোখের দিকে তাকায় আর সহসা যেন দুজনের চোখ থেকেই সব বালখিল্যতা উধাও হয়ে যায়। বাবর কৃতজ্ঞ বোধ করে যে তার খঞ্জরটা দামী রত্নখচিত খাপসহ তার কোমরের বেগুনী পরিকরের ভেতরে গোজা রয়েছে বলে।

“দুশ্চিন্তা কোরো না, খুদে ভাইটি- যদিও সম্ভবত তোমাকে আর খুদে বলার অবকাশ নেই। নেকড়ে মায়ের মুখের অনুভূতির মতই কিছু একটা আমি দেখছি যার শাবক সামান্য আগেই আমার হাতে খুন হয়েছে।” মাহমুদ আবার হাসতে শুরু করে। “এটা সত্যি যে আমি সমরকন্দে এসেছিলাম কারণ মনে হয়েছিলো শহরটায় একটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হবে। কিন্তু আমার ছাউনি ভালো করে দেখো আমার সাথে একশোর বেশি লোক নেই। শহর অবরোধের কোনো অভিপ্রায় আমার ছিল না, আমি এসেছিলাম আচমকা হামলা চালিয়ে কিছু সম্পদ বাগিয়ে নেয়া আর এখানের আগুন প্রশমিত করতে।” সে একটা ভেংচি কেটে দুপায়ের ফাঁকে উদ্দেশ্যপ্রনোদিত ভঙ্গিতে হাত বুলায়।

“তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হোক। আগুন নির্বাপিত হোক।”

“আর ভাইটি তোমার সাথে কতজন লোক আছে?”

“আমরা মূল বাহিনী যখন এসে পৌঁছাবে তখন সেটা হবে ছয় হাজারের বেশি যোদ্ধার একটা বহর যাদের ভিতরে অনেকেই তীরন্দাজ।” বাস্তবে বাবরের সৈন্য। সংখ্যা টেনেটুনে পাঁচ হাজার হবে কিন্তু একটু বাড়িয়ে বলতে ক্ষতি কি।

মাহমুদ বেশ অবাক হয়েছে বোঝা যায়। “আমি ভাবিনি যে ফারগানা এত বড় একটা সৈন্যবহর একত্রিত করতে পারবে।”

“অনেকেই আমার বেতনভোগী আর তাদের লোকজন কিন্তু বাকীরা পাহাড়ী গোত্রগুলি থেকে এসেছে।”

“চলো আমরা একসাথে আক্রমণ করি।” মাহমুদ বাবরের হাত আঁকড়ে বলে। “প্রধান উজিরের মাথা তুমি একটা বর্শার ফলায় গেথে নিলে আমি আমার বেগমকে লাভ করবো।”

“ক্ষতি কি?” বাবর হেসে বলে। তার প্রশিক্ষিত সৈন্যবহর থাকতে মাহমুদ কোনো বেগরবাই করতে পারবে না, আর মসনদের দিকে তাকাবার তার প্রশ্নই উঠে না।

***

দু’মাস পরে তার লোকেরা যখন ক্লান্ত পায়ে পূর্বে ফারগানার দিকে ফিরে চলে তখন ব্যর্থতার জ্বালায় জ্বলতে থাকা বাবর শীতের কোনো তীব্রতাই টের পায় না। ঘোড়াগুলোর, আলুথালু কেশরে তুষারকণা আটকে আছে, পেছনের পায়ের মাঝখানের জোড়া অব্দি বরফে দেবে যায়। নাক টেনে এগিয়ে যাবার জন্য তারা চেষ্টা করতে থাকলে তাদের নিঃশ্বাস থেকে কুয়াশার মেঘ সৃষ্টি হয়। কোথাও কোথাও বরফ এত পুরু যে সওয়ারী তখন বাধ্য হয় নিজের ওজনের ভার থেকে পশুটাকে রেহাই দিতে এবং তারপরে সেও তার পাশে পাশে কষ্ট করতে থাকে। মালপত্র রসদের বেশিরভাগই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরিত্যক্ত অবস্থায় বরফের ভেতরে পড়ে থাকে।

বাবর বিষণ্ণ মনে ভাবে, এবারের অভিযান এমনভাবে শেষ হবার কথা ছিল না। লাল সুতো দিয়ে মোটা করা আংটিটা তার আঙ্গুলে তারপরেও একটু ঢিলে হয়। পুরোটাই একটা দর্পোদ্ধত অভিজ্ঞতা তার ব্যর্থতা আর অপমানের সাক্ষর।

ওয়াজির খান তার পাশেই রয়েছে, ভারী উলের কম্বলে আবৃত থাকায় দাড়ি আর ভুরুতে বরফ জমেছে। ধূসর আকাশে ভারী তুষারপাতের সম্ভাবনায় মেঘের আনাগোনা শুরু হতে হাজির হয়েছে, ওয়াজির খান তাকে অনুরোধ করেছিলো আক্রমণ স্থগিত রাখার জন্য নিষ্ঠুর নিয়তে শীতকাল এবার আগেই এসে। কিন্তু বাবর সে অনুরোধে কর্ণপাত করেনি- মাহমুদও যখন তার দু’পায়ের মাঝের আগুন নির্বাপিত না করেই বাড়ির দিকে রওয়ানা হয়েছিলো তখনও না, বা যখন তার টাকা দিয়ে কেনা মিত্র আর পাহাড়ী অধিবাসীরা লুঠপাটের কথা বলে সেটা না করতে পারার জন্য গাল বকতে বকতে ফিরে যায় তখনও তার সম্বিৎ ফিরেনি। আর এখন সে তার অহঙ্কার আর ঔদ্ধত্যের মূল্য পরিশোধ করছে। সমরকন্দের প্রাকার তারা ভাঙতে পারেনি আর শহরের ভেতরে প্রধান উজির যে মসনদ তার না সেটা আগলে বসে রয়েছে আর সাথে আছে তার মেয়ে যার জন্য সে বিশাল পরিকল্পনা তৈরি করেছে- মাহমুদ না নিজের মেয়ের কুমারীত্ব সে কাবুলের শাহজাদার কাছে সমর্পন করবে।

“মহামান্য সুলতান, আমরা আবার ফিরে আসব।” ওয়াজির খান বরাবরের মতই এবারও তার মনের কথা বুঝতে পেরেছে। শীতে অসার হয়ে আসা ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে আসা শব্দগুলো ধীরে ধীরে ভেসে আসে। “এটা ছিল কেবল একটা হামলা। আমরা একটা সুযোগ দেখে সেটা নিয়েছিলাম কিন্তু পরিস্থিতি আমাদের অনুকূলে ছিল না।”

“ওয়াজির খান, সেটাই আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। আমি যখন চিন্তা করি কি হতে পারত তখন মনে হয় কেউ যেন আমার পাজরে জ্বলন্ত খঞ্জর ঢুকিয়ে দিয়েছে…”

“কিন্তু যুদ্ধের প্রথম স্বাদ আপনি লাভ করেছেন। পরেরবার আমরা প্রস্তুতি নিয়ে আসব এবং পুরো সাজসজ্জার সাথে আর তখন আপনি জানবেন সাফল্য কাকে বলে।” নিজের দুর্ভোগ সত্ত্বেও, কথাগুলো বাবরকে উৎফুল্ল করে তুলে। সে কিশোর বয়সী। ইতিমধ্যেই একটা রাজ্যের সুলতান। সমরকন্দ এই শীতে সে দখল করতে পারেনি- এই সত্যিটা স্বীকার করার ভিতরে সে কোনো দুর্বলতা খুঁজে পায় না। দুর্বলতা লুকিয়ে থাকে হতাশার ভিতরে, যখন বুকে দম আর বাহুতে বল থাকা সত্ত্বেও, কেউ হাল ছেড়ে দেয় এবং সেটা সে কখনই করবে না। “আমি আবার ফিরে আসব,” বাতাসের গর্জন ছাপিয়ে সে চিৎকার করে উঠে এবং মাথা উঁচু করে তার বাবার শিখিয়ে দেয়া রণহুঙ্কার দেয়। স্পর্ধিত শব্দটা শীতের ঝড়ো বাতাসে মিলিয়ে যায় বটে কিন্তু তার প্রতিধ্বনি বাবরের মস্তিষ্কে অনুরণিত হতেই থাকে।

InfotakeBD

View posts by InfotakeBD
InfotakeBD is a information sharing blog, We share information for you. Please visit us and if you want to contribute for this blog please email us infotakebd@gmail.com. Thank you
Scroll to top
error: Content is protected !!