৩.৩ চেঙ্গিসের যোগ্য তনয়া

১৭. চেঙ্গিসের যোগ্য তনয়া

ছয় মাস পরের কথা। বাবর তার সোনার গিল্টি করা সিংহাসনে নির্বিকার মুখে বসে আছে। তার চারপাশে সব অমাত্য অবিচল ভঙ্গিতে শক্ত হয়ে বসে আছে। এরই মাঝে বাবুরী তার বয়ে আনা বস্তাটা বাবরের সামনে রাখে।

“সবাইকে দেখাও।”

বাবুরী তার নীল রঙের পরিকর থেকে খঞ্জরটা বের করে, বস্তার সেলাই খুলে ভেতরে কি আছে দেখায়: রক্ত জমাট বাঁধা দুটো ছিন্ন মস্তক, এবং বেগুনী-নীল ছোপ ধরা। যার পচনক্রিয়া অনেক আগেই শুরু হয়েছে। পরিক্ষয়ের পূতিগন্ধে বমি উদ্রেককারী মিষ্টি মিষ্টি আর পচা- পুরো ঘরটা ভরে যায়। গলার কাছের এবড়োথেবড়ো পেশী, যেখানে একটা ভোঁতা কিছু দিয়ে গলা থেকে মাথাটা কেটে নেবার চিহ্ন স্পষ্ট বোঝা যায়, বলে যে মাথাগুলো যাদের তারা সহজে মৃত্যুবরণ করেনি। স্যাইয়েদিমের একদা সুদর্শন মুখাবয়ব, তরুণ নিশান-বাহক, বাবর নিজে যার হিমদষ্ট হাত কর্তনের সময়ে তাকে চেপে ধরে রেখেছিলো, তার ফুলে ওঠা মুখ কোনোমতে চেনা যায়। তার ফুলে টসটস করতে থাকা ঠোঁট বেঁকে গিয়ে পুঁজ জমে পেকে ওঠা মাড়িতে তখনও সন্নিবিষ্ট সাদা দাঁতের সারি দেখা যায়। অন্য মাথাটা যে কার বাবর সেটা ঠিক চিনতে পারে না- বাইসানগারের অধীনস্ত এক সৈনিক-কিন্তু স্যাইয়েদিমের মতো তার মৃত্যুরও বদলা নেয়া হবে।

মৃত সৈন্য দু’জনকে বাবরের একটা বার্তা খোরাসানের সুলতানের কাছে তার অনেক দূরের আত্মীয়, যার দরবার হিরাতে অবস্থিত। সেখানে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো। সেই বছর কাবুলে সবচেয়ে বড় সওদাগরী কাফেলা নিয়ে আসা বণিকেরা বলাবলি করছিলো, হিন্দুকুশের অপর প্রান্তে সাইবানি খান আবার একটা বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে অগ্রসর হতে শুরু করেছে। কেউ কেউ বলে কাবুলের পশ্চিমে সমৃদ্ধ খোরাসান তার লক্ষ্য। আবার কারো মতে সে কাবুলেই হামলা করবে। বাবর খোরাসানের সুলতানকে সতর্ক করে বার্তাটা পাঠালেও, তাতে তাদের মাঝে মৈত্রীর একটা ইঙ্গিতও দেয়া হয়েছিলো। মুশকিল হলো বার্তাটা আদতে কোথাও পৌঁছায়নি….

ভেড়া চোর কাফির সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে পরিচালিত একটা নিয়মতান্ত্রিক অভিযানের সময় কপালগুণে বাবুরী বার্তাবাহকদের ভাগ্যে কি ঘটেছে সেটা জানতে পারে। তাদের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত গ্রামের মাটির বাড়িগুলো তল্লাশি করার সময়ে সে বার্তাবাহকদের ছিন্ন মুণ্ডগুলো একটা বিশাল মাটির পাত্রে নীল ডুমো মাছির ভনভন ভীড়ের মধ্যে খুঁজে পায়। তাদের সাথে দেয়া দশজনের রক্ষীবাহিনীর বাকি সবার মাথাও কাছেই পড়ে রয়েছে। গ্রামের মোড়লের কাছ থেকে বাবুরী যতোটুকু জানতে পারে, সেটা হলো কফুরীরা তাদের হত্যা করার আগে কেবল পৈশাচিক আনন্দ লাভ করতে তাদের উপরে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়েছে। তাদের কারো কারো জিহ্বা কেটে ফেলা হয়, কিন্তু বার্তাবাহকদের একজনের সাথে তারা যা করেছে সেটা শুনে। সে কেঁপে উঠে। সেই বেচারা ধরা পড়ার সময়ে সংঘটিত যুদ্ধে পেটে তরবারির আঘাত পেয়েছিলো। কুফরী জানোয়ারগুলো এরপরে তার পেটে হাত ঢুকিয়ে ক্ষতস্থানটা আরো চিরে সেটার ফাঁক দিয়ে আংশিক নাড়ীভুড়ি বের করে আনে এবং সেই বার্তাবাহক যখন যন্ত্রণায় চিৎকার করছে তখন একটা খুটির সাথে তার সেই আংশিক বের হওয়া নাড়ীভুড়ি বেঁধে দিয়ে বেচারাকে বাধ্য করে খুঁটির চারপাশে ঘুরে ঘুরে নাচতে। সে ঘুরতে থাকলে বাকী নাড়ীভূড়িও পেট থেকে নাটাইয়ের সুতা খোলার মতো বেরিয়ে আসতে থাকে, যতক্ষণ না মৃত্যু এসে তার যন্ত্রণার নিবৃত্তি ঘটায়।

বাবুরী সর্দারকে সেখানে কবন্ধ করার উদগ্র বাসনা অনেক কষ্টে দমন করে। সর্দারের গোড়ালীর সাথে কব্জি দেহের পেছনে টেনে মুরগী বাঁধার মতো বাঁধে। আর বাকী কুফরী যাদের সে খুঁজে পায় সবাইকে খেদিয়ে নিয়ে কাবুলের দূর্গপ্রাসাদে। নিয়ে আসে। সে মাত্র কয়েকঘন্টা আগে এসে পৌঁছেছে। প্রাসাদের নিচের অন্ধকার কারাকক্ষে কে তাদের এমন নৃশংস কাজ করতে প্ররোচিত করেছিলো, সেটা তাদের। দিয়ে কবুল করাতে বেশি কসরত করতে হয়নি।

বাবর নির্বিকার কণ্ঠে তার অমাত্যদের উদ্দেশ্যে কথা বলে। “আমি আমার সামনে আপনাদের উপস্থিত হতে বলেছি একটা ষড়যন্ত্রের সাক্ষ্যপ্রমাণ শুনতে। এই ছিন্ন। মস্তকগুলো খোরাসানের সুলতানের কাছে পাঠানো আমার বার্তাবাহকদের। তাদের হত্যা করা হয়েছে এমন একজনের আদেশে যাকে আমি বিশ্বাস করতাম। যার ধমনীতে আমারই রক্ত বইছে…তাকে নিয়ে আসা হোক।”

প্রহরী পরিবেষ্টিত অবস্থায় মির্জা খানকে প্রবেশ করতে দেখে উপস্থিত সবাই আঁতকে উঠে। তৈমূরের বংশধর হিসাবে তাকে রেয়াত করে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়নি। তার পোশাক-পরিচ্ছদ বা অবয়বের ভিতরে ভীতিকর বা বিনয়ী কোনো কিছুই প্রকটিত নয়: তার গলায় একটা কলাই করা হার ঝুলছে এবং মুক্তার কারুকাজ করা পরিকরের সাহায্যে পরণের বেগুনী রঙের রেশমের জোব্বা দিয়ে তার গাট্টাগোট্টা শরীর বেশ ভালোভাবেই আবৃত। তার অভিব্যক্তি ঔদ্ধত্যপূর্ণ।

মির্জা খান গলিত মাথা দুটোর দিকে একবার তাকিয়ে দেখে, যেনো সেগুলো তার লাল নাগরায় লেগে থাকা ধূলিকণা ছাড়া কিছু না। নিজের হাত দিয়ে বুক স্পর্শ করে, কিন্তু আর কোনো কথা বলে না।

“আমার বার্তাবাহকদের যারা খুন করেছে পাহাড়ের কুফরী কুকুরের দল- তারা তাদের অপরাধের কথা কবুল করেছে। তারা আপনার নাম বলেছে মূল চক্রান্তকারী হিসাবে…”

“আমরা সবাই, কুচক্রী দলও বাদ যাবে না, নির্যাতনের মুখে অনেক কথাই স্বীকার করব…”

“কখনও কখনও সত্যি কথাটাও…তারা বলেছে বার্তাবাহকদের লাপাত্তা করার জন্য আপনি তাদের অর্থ দিয়েছেন- যাদের ভিতরে একজন কোনো এক সময়ে আপনার নিশান বাহক ছিলো- শিবার্তু গিরিপথে প্রবেশের পরে আপনি তাদের উপরে চড়াও হবার আদেশ দিয়েছিলেন এবং খোরাসানের সুলতানের কাছে আমার পাঠানো বার্তা যেটা তারা বহন করছিলো সেটা চুরি করতে বলেছিলেন। তাদের নাম খরচের খাতায় তুলে দিয়ে আপনি বলেছিলেন বন্দিদের সাথে তারা মর্জিমাফিক আচরণ করতে পারে। ব্যাটারা আহাম্মক বলেই নিজেদের অপকর্মের প্রমাণ হিসাবে কর্তিত মস্তকগুলো সংরক্ষণ করেছিলো…”

মির্জা খান অবজ্ঞার ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকায়। “কাফিররা মিথ্যা কথা আর ছলনার জন্য বিখ্যাত…”

“আমার অশ্বশালার প্রধান তাদের নগণ্য দ্রব্যাদির ভিতরে এটা খুঁজে পেয়েছে।” একজন পরিচারক বাবরের হতে ফুলের ছোপ তোলা রেশমের একটা বটুয়া ধরিয়ে দেয়। বটুয়াটার দড়ি খুলে বাবর ভেতর থেকে হাতির দাঁতের তৈরি টুকরো বের করে যার তলদেশে একটুকরো অনিক্স সংবদ্ধ রয়েছে। “আপনার সীলমোহর। মির্জা খান। যে শিল্পী আপনার নাম উৎকীর্ণ করেছে সে দারুণ একটা কাজ করেছে দেখেন কি পরিষ্কার করে আপনার নাম আর পদবী এখানে দেখা যাচ্ছে। ভাড়াটে গুণ্ডাদের কাছে ষড়যন্ত্রে নিজের সংযুক্তির প্রমাণ পাঠিয়ে আপনি বোকামী করেছেন। কিন্তু আমি সবসময়ে জানতাম আপনার ঘিলুতে হলুদ পদার্থ কম আছে…”

মির্জা খানের চেহারায় ভয়ের অভিব্যক্তি এবার ফুটতে শুরু করে। কুলকুল করে ঘাম তার সুগন্ধি মাখানো দাড়ি বেয়ে নামতে থাকে এবং বেগুনী রেশমের জোব্বার বগলের নিচে গাঢ় দাগ দ্রুত দৃশ্যমান হয়ে উঠে।

“আমি একটা ব্যাপার কেবল বুঝতে পারছি না, কেন?”

লাইলাকের একটা রুমাল দিয়ে মির্জা খান দ্রুত তার মুখ মুছে। কিন্তু কথা বলা থেকে বিরত থাকে।

“তুমি যদি আমার প্রশ্নের উত্তর না দাও, তবে আমি বাধ্য হব তোমাকে নির্যাতন করার আদেশ দিতে।”

“আপনি সেটা পারেন না- আমি তৈমূরের বংশধর, সম্পর্কে আপনার ভাই।”

“আমি পারি এবং প্রয়োজন হলে সেটা করবোও। তুমি আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার সময়েই তোমার অধিকার হারিয়েছ।” বাবরের শীতল শব্দগুলো শেষ পর্যন্ত মনে হয় মির্জা খানের ঔদ্ধত্যপনা ঘুচিয়ে দেয়। সে বুঝতে পারে তার চারপাশে জাল ক্রমশ গুটিয়ে আসছে।

“সুলতান…” প্রথমবারের মত মির্জা খান তাকে এই উপাধিতে সম্বোধন করে।

“আমার সামনে আর কোনো পথ ছিল না। আমি যা করেছি বাধ্য হয়েই করেছি…”

“একজন মানুষের সামনে সবসময়েই বেছে নেবার সুযোগ থাকে। তুমি কার পক্ষের হয়ে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছিলে?”

মির্জা খান সহসা বমি করতে শুরু করে। তার ঠোঁটের কোণে হলুদ বমির সরু একটা ধারা বের হয়ে এসে গড়িয়ে পড়তে শুরু করে, তার বেগুনী আচকানের দফারফা করে দেয়। সে মুখটা মোছে, মাথা তুলে করুণ দৃষ্টিতে বাবরের দিকে তাকায়। “আমরা একই রক্তের উত্তরাধিকারী, এটা ভুলে যাবেন না…”

“আমার সেটা মনে আছে আর আমি আজ সেজন্য লজ্জিত। আবার জানতে চাইছি কার কাছে নিজের মাথা বিক্রি করেছো?”

মির্জা খানকে দেখে মনে হয় সে আবার বমি করবে। কিন্তু সে বহুকষ্টে একটা ডোক গিয়ে এবং বিড়বিড় করতে থাকে।

“উত্তর দাও।”

“সাইবানি খান।”

বাবর নির্বাক তাকিয়ে থাকে। তারপরে সম্বিত ফিরে পেতে সে মঞ্চ থেকে লাফিয়ে নেমে এসে মির্জা খানের কাধ ধরে প্রচণ্ড ঝাঁকি দিয়ে তার মুখের উপরে চিৎকার করে ওঠে। “সেই উজবেক বর্বরটা, সাইবানি খানের সাথে তুমি হাত মিলিয়েছে আমাদের বংশের জানের শত্রু?”

“সে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে আমার যে জমিদারি সে দখল করেছে সেটা ফিরিয়ে দেবে। আপনার দরবারে শোভাবর্ধক হিসাবে না, সে আমাকে যথার্থ মর্যাদা দেবে বলে প্রতিজ্ঞা করেছে। আমি তাকে জানিয়েছিলাম আপনি খোরাসানের সুলতানের সাথে মৈত্রী চুক্তি করার চেষ্টা করছেন। সে সেটা থামাতে চেয়েছিলো। সাইবানি খান প্রথমে খোরাসান, পরে আপনাকে আক্রমণ করবে বলে ঠিক করেছে, আমার সুলতান। সুলতান, আপনি আমাকে এখন তার বিরুদ্ধে গুপ্তচর হিসাবে নিয়োগ করতে পারেন…সাইবানি খান আমাকে বিশ্বাস করে। আপনার পছন্দমাফিক আমি যে কোনো বার্তা তাকে পাঠাতে পারবো…আমরা সম্ভবত তাকে এভাবে ফাঁদেও ফেলতে পারি।”

লোকটার এই নির্লজ্জ কাকুতি মিনতি তার নিঃশ্বাসের সাথে ভেসে আসা বমির গন্ধের মতোই বাবরের গা গুলিয়ে তোলে। সে তার কাঁধ ছেড়ে দিয়ে পেছনে সরে আসে। “এই বিশ্বাসঘাতককে আমার সামনে থেকে নিয়ে যাও এবং দূর্গ প্রকারের উপর থেকে মাথা নিচের দিকে করে তাকে ছুঁড়ে ফেলল। তাতেও যদি ব্যাটা না মরে, তবে আবার তুলে এনে আবার নিচে ছুঁড়ে ফেলবে। তারপরে তার শবদেহটা বাজারের আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করবে যাতে চিল কুকুর তার লাশটা ভক্ষণ করে।”

“সুলতান বখশ দেন…” মির্জার পায়ের নরম চামড়ার নাগরা উষ্ণ হলুদ প্রস্রাবে ভিজে উঠে এবং ধীরে ধীরে পাথরের মেঝেতে একটা ছোটখাট জলাশয়ের জন্ম। দেয়। সে সহসা আবার বমি করে এবং বমির সাথে যোগ হওয়া নতুন আরেকটা গন্ধ বাবরকে বলে যে মির্জা খানের উদর আর তার নিয়ন্ত্রণাধীন নেই।

“বেল্লিকটাকে আমার সামনে থেকে নিয়ে যাও!” বাবর দরবারের প্রহরীকে চিৎকার করে আদেশ দেয়। “আমার আদেশ যেনো এখনই কার্যকর করা হয়।”

এক ঘণ্টা পরে, বাবর কাফিরদের প্রাণদণ্ডাদেশ কার্যকর করা দেখতে বের হয়। তার লোকদের সাথে হারামজাদারা এমন আচরণ করেছে যে, সে বিশ্বাসঘাতকদের জন্য সবচেয়ে পুরাতন আর ভীতিকর শাস্তি তাদের জন্য বরাদ্দ করেছে। শহরের দেয়ালের নিচে তাদের তীক্ষ্ণ কাঠের দণ্ড, যাকে অনেক স্থানে শূল বলে, তাতে বিদ্ধ করা হবে। নগরদূর্গে তাদের মরণ চিৎকার পৌঁছাবে না। সে এজন্যই কৃতজ্ঞ। মাহাম, খুতলাঘ নিগার বা তার নানীজান যেনো তাদের যন্ত্রণাক্লিষ্ট মরণ চিৎকার শুনতে না পায়। যদিও এখন সে ভাবে, এসান দৌলত সম্ভবত তার মতোই চোখের পলক না ফেলে পুরো ব্যাপারটা তাকিয়ে দেখতে পারবে।

মির্জা খানের প্রতি তার ক্ষোভ আর তার লোকদের সাথে এমন নির্মম নিষ্ঠুরতা প্রদর্শনের জন্য কুফরীদের প্রতি তার ক্রোধের কারণে সে কোনো ধরণের করুণা প্রদর্শন করে না। সে তাকিয়ে দেখে সাজাপ্রাপ্ত লোকগুলোকে ন্যূনতম কাপড় পরিহিত অবস্থায় অপেক্ষমান শূলের কাছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। জল্লাদের দল তাদের জোব্বার উপরে চামড়ার তৈরি কালো আলখাল্লা জড়িয়ে রেখেছে- যা শীঘ্রই রক্তে লাল হয়ে উঠবে- মুরগী ধরার মতো একজন একজন করে বন্দিদের শূলে উঠাচ্ছে। কোনো কোনো বন্দির পায়ুপথে শূলের তীক্ষ্ণ অগ্রভাগ প্রবিষ্ট করান হয়। আবার কাউকে শহরবাসীদের বুনো উল্লাসের ভিতরে শিককাবারের মতো আড়াআড়ি গাথা হয়। বাবর শহরবাসীর দোষ দেখে না- প্রতিবার যন্ত্রণাক্লিষ্ট দেহের নরম মাংসে তীক্ষ্ণ শূল গেথে গিয়ে রক্ত ঝিটকে বের হলে, সন্তুষ্টি ছাড়া সে আর কিছুই অনুভব করে না। সে মির্জা খানকেও একই শাস্তি পারলে দিতো- কেবল রাজপরিবারে জন্ম হওয়াতে বেজন্মাটা বেঁচে গেছে।

সেই রাতে বাবর একেবারে মনমরা হয়ে থাকে। হুমায়ূন আর তার সদ্য জন্ম নেয়া ভাই কামরানকে, যার মাথা ভর্তি ঝাড়র মতো কালো চুল একেবারে ড্যানডেলিয়ন ঔষধি গাছের পাতার মতো কোমল, পাশাপাশি শুয়ে থাকতে দেখেও-দু’মাস আগে গুলরুখের গর্ভে জন্ম নিয়ে এখনই বেশ শক্ত করে বাবরের বুড়ো আঙ্গুল আঁকড়ে ধরতে পারে- তার চিত্তচাঞ্চল্য ঘটে না। এমনকি মাহামের কামাতুর দেহের উষ্ণ আমন্ত্রণ সেদিন তার আসন্ন বিপদের পূর্বানুভব কাটাতে পারে না। সে প্রস্তুত থাকুক বা না থাকুক একটা ঝড় আসছে। গৌরবান্বিত বিজয় আর অমর খ্যাতি এবং পরাজয় আর বিস্মৃতির অতলে অখ্যাত মৃত্যু। কেবল তারই না তার পুরো পরিবারের, নির্ভর করছে তার সিদ্ধান্তের উপরে যা নিতে সে শীঘ্রই বাধ্য হবে…

*

এক মাস পরে, বাবরের পরিবারে বয়ে আসা দৈবদূর্বিপাক নিজের উপস্থিতি এমন এক আঙ্গিক থেকে জানান দেয় যা তার অসম্ভব কল্পনাতেও ছিলো না। শবযানের কাঠের পাটাতনে শুয়ে থাকা এসান দৌলতের মৃতদেহটা একেবারে বাচ্চা একটা মেয়ের মতো দেখায়। কর্পূর পানির তীব্র গন্ধ তার পরিচারিকার দল যা দিয়ে তাকে শেষবারের মতো গোসল করিয়েছে। তার মামূলী সুতির কাফন ভেদ করে যেনো উঠে আসে। বাবর ঝুঁকে তার নানীজানের মৃতদেহের দিকে তাকাতে, সে নিজের অশ্রু সংবরণ করতে পারে না। কিভাবে যেনো তার মনে হয়েছিলো নানীজানের মানসিক শক্তি আর একাগ্রতার বরাভয় বুঝি আজীবন সে লাভ করবে। কোনো শেষ ইচ্ছার কথা না বলে- না কোনো শেষ আদেশ, কোনো বিচক্ষণ পরামর্শ ছাড়াই ঘুমের ভিতরে সহসা এমন প্রশান্তিময় মৃত্যুর ধারণাটাই তার অগ্রহণযোগ্য অবাস্তব মনে হতে থাকে। কিন্তু গত কয়েক মাসের কথা চিন্তা করতে, এখন সে বুঝতে পারে অনেক আগে থেকেই তিনি তাকে ইঙ্গিত দিতে শুরু করেছিলেন- অনিশ্চয়তা আর অস্পষ্টতা এবং এস্তব্যস্ততার একটা প্রবণতা যা আগে কখনও তার ভিতরে লক্ষ্য করা যায়নি। তার স্মৃতি কেমন যেনো বিক্ষিপ্ত আচরণ করছিলো- বাবরের শৈশবের কথা তিনি প্রাঞ্জল স্পষ্টভাবে বলতে পারতেন। কিন্তু কেউ যদি তাকে বেমক্কা প্রশ্ন করতে গতকাল তিনি কি করেছেন, তাহলেই অনিশ্চয়তার মেঘ এসে তাকে ঘিরে ফেলতো।

নানীজানকে ছাড়া জীবন সে কল্পনাই করতে পারে না। তাদের সবচেয়ে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ে তিনিই পুরো পরিবারটার হাল ধরে ছিলেন। যুক্তি আর প্রজ্ঞা সর্বোপরি সাহস দিয়ে তিনি তাদের আগলে ছিলেন। শীঘ্রই সে তার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রতিকূলতার মুখোমুখি হবে, আর এখনই তিনি চলে গেলেন। সে কিশোর বয়সে তার সাথে কথোপকথনের কথা ভাবে: “নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে কখনও ভয় পাবে না। সাহস নিয়ে তার মোকাবেলা করে, তাদের অর্জন করবে। মনে রাখবে, কোনো কিছুই অসম্ভব না…”।

বাবরের একটা ইশারায়, তার নানীজানের প্রিয় তিন পরিচারক- তিনজনের পরনেই তার মতো কালো শোকের আলখাল্লা- নিচু হয় এবং বাবরের সাথে, শবাধারের একটা পায়া কাঁধে নেয়। কাঁধের উপরে তুলে নিয়ে, তার মহলের অন্ধকার, বাঁকান সিঁড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে বয়ে নিয়ে খুতলাঘ নিগারের ফোঁপানির শব্দ, তাদের পেছন থেকে ভেসে আসে- উজ্জ্বল লাল কাপড়ে মোড়ানো ঘোড়ায় টানা গাড়ির সমতল পাটাতনে এনে রাখে। এসান দৌলত লাল রঙ পছন্দ করতেন, বলতেন এটা তার শ্রদ্ধেয় পূর্বপুরুষ: চেঙ্গিস খানের রঙ।

বাবর তার সেনাপতি, মোল্লার দল আর আমাত্যদের নিয়ে এসান দৌলতকে তার শেষ বিশ্রামের স্থলে বয়ে নিয়ে যাওয়া গাড়িটা অনুসরণ করে। সে তার আম্মিজানের সম্মতি নিয়ে তাকে পাহাড়ের ধারে তার ফুল, ফল আর ঝর্ণাধারায় সুশোভিত বাগানে সমাধিস্ত করবে বলে ঠিক করেছে। তাকে উর্বর অন্ধকার মাটির গর্ভে শেষবারের মতো শুইয়ে দিয়ে, তার আত্মার শান্তির জন্য মোনাজাত শেষ হতে বাবর অন্তেষ্টিক্রিয়ায় আগত লোকদের দিকে তাকায়। এখানে যিনি শায়িত আছেন, তিনি ছিলেন চেঙ্গিস খানের কন্যা। তার সাহসিকতা ছিলো প্রবাদপ্রতীম। যিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন হতাশা একটা পাপ। আমি তার কথা কোনোদিন ভুলব না। আর একদিন যখন আমি আমার শত্রুদের পরাস্ত করতে পারবো, সেদিন এখানে এসে তাকে শুনিয়ে যাবো আমি কি অর্জন করেছি, আর তার আশীর্বাদ চাইবো।”

***

এসান দৌলত, হিরাতে তাদের শাহী আত্মীয়ের উপরে আপতিত হওয়া ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের কথা জানবার আগেই ইহকালের মায়া ত্যাগ করেছেন। বাবর কয়েক সপ্তাহ পরে অবিশ্বাসের সাথে বাইসানগারের কথা শুনতে শুনতে ভাবে।

“সুলতান, এটাই বাস্তব। উজবেকরা হিরাত দখল করে নিয়েছে। ত্রিশ হাজার যোদ্ধার একটা বিশাল বহর নিয়ে সাইবানি খান মুখতার পাহাড়ের ঢালে তাণ্ডব সৃষ্টি করেছে। শাহী পরিবার আলা কোগরান দূর্গে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু সুলতানের ডেকে পাঠানো অতিরিক্ত সৈন্যবাহিনী তার সাহায্যে পৌঁছাবার আগেই তাদের পরাস্ত করা হয়েছে।”

“শাহী পরিবারের কি খবর?”

বাইসানগার উত্তর না দিয়ে ঠোঁট কামড়ে থাকে। “সাইবানি খান দূর্গ অবরোধ করেছিলো এবং দূর্গের কাছে অবস্থিত ঘোড়ার বাজার থেকে সিঁধ কাটার ফলে দেয়ালের অংশ বিশেষ ধ্বসে পড়ে। ফাটল দিয়ে উজবেক বর্বরের দল পিলপিল করে ভেতর প্রবেশ করেছিলো। তারা শাহী পরিবারের সব পুরুষ সদস্যদের, এমন কি তাদের জীঘাংসার হাত থেকে ছোট ছেলেটাও বাদ যায়নি, নির্বিচারে হত্যা করেছে। সাইবানি খান নিজে ছোট ছেলেটার গোড়ালী ধরে শস্য মাড়াইয়ের মতো শাহী কবরের পাথরের দেয়ালের উপরে তার মাথা আছাড় মেরেছে। মগজ ছিটকে পাথরের গায়ে লেগেছে। আর তারপরে তার প্রাণহীন দেহটা পরিবারের অন্য পুরুষ সদস্যদের লাশের স্তূপে ছুঁড়ে ফেলেছে। সে এরপরে লাশগুলো ভিতরে রেখে পুরো দূর্গ জ্বালিয়ে দেবার আদেশ দেয়…”

“আর মহিলাদের ভাগ্যে কি ঘটেছে?”

“সবাই বলাবলি করছে আলা কোগরান দূর্গে যাদের লুকিয়ে থাকা অবস্থায় তারা খুঁজে পেয়েছিলো- হোক সে কিশোরী বা বয়সের ভারে কুঁজো হয়ে আসা বৃদ্ধা দাদীমা-সবাইকে জোর জবরদস্তি নগ্ন করে বিজয় উদযাপনের ভোজ সভায় মাতাল দখলদারদের সামনে এমন ভঙ্গিতে নাচতে বাধ্য করা হয়েছে, যে উজবেক সর্দাররা সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটার সান্নিধ্য পাবার জন্য নিজেদের মধ্যে কুকুরের মত খেয়োখেয়ি শুরু করেছিলো এবং কেউ কেউ নাকি ভূড়িভোজ শেষ হবার আগেই প্রকাশ্যে নিজেদের লালসা চরিতার্থ করতে আরম্ভ করে দিয়েছিলো।”

বাবর তার হাতের মুঠো এমন শক্ত করে বন্ধ করে যে মনে হয় তার গাঁটগুলো বুঝি ত্বক ফেটে বের হয়ে আসবে। “আর হিরাতের কি খবর?”

বাইসানগারের সচরাচর শান্ত মুখমণ্ডলে একটা কষ্টের অনুভূতি খেলে যায়। “উজবেকরা শহরে নির্বিচারে লুটপাট করেছে। সাধারণ নাগরিকদের হত্যা করে তাদের স্ত্রীদের ধর্ষণ করেছে এবং তাদের ছেলেমেয়েদের ক্রীতদাস হিসাবে বিক্রি করেছে। আমার যে ভাইয়ের কাছে মাহাম মানুষ হয়েছিলো, তিনি মারা গেছেন। সাইবানি খানের নির্মমতার থাবা থেকে শহরের শিক্ষক আর লেখকরাও রেহাই পায়নি। হিরাতের মাদ্রাসার ভাগ্যবান কয়েকজন শিক্ষককে আজ যে কাফেলাটা এসে পৌঁছেছে, নিয়ে এসেছে। তাদের মধ্যে অন্যতম একজন কবি- বলেছেন গ্রন্থাগারে রক্ষিত সব পাণ্ডুলিপি নষ্ট করে ফেলা হয়েছে এবং সাইবানি খানের নির্দেশে তার হাতে ধরা পড়া এক পণ্ডিতকে ছেঁড়া কাগজের টুকরো গিলতে বাধ্য করা হয়েছে যতক্ষণ না বেচারা শ্বাসরুদ্ধ হয়। আর পুরোটা সময় তাকে ক্রমাগত জিজ্ঞেস করা হয়েছে, “কবিতা খেয়ে বেঁচে থাকতে কেমন লাগছে?”

বাইসানগারের কথা যদিও বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে না, কিন্তু বাবর অবাক হয় না। তার বার্তাবাহকদের বাধা দেয়া হয়েছে জানতে পারার পরে থেকেই সে জানতো এমন কিছু হওয়াটা এখন কেবল সময়ের ব্যাপার। হীরাতে তার আত্মীয়কে যদি সময়মতো সতর্ক করা যেতো তাহলে কি হতো? তাদের পশ্চিম দিকে বিস্তৃত সংস্কৃতিবান, খোলামেলা অপূর্ব সুন্দর প্রাসাদ, প্রাচীন মসজিদ আর মাদ্রাসাগুলো সহসা যেনো একটা ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। বাবরের মরহুম আব্বাজান কখনও কখনও এইসব দূরসম্পর্কীয় আত্মীয়দের ব্যাপারে আলাপ করতো, বহুদূরে বসবাস করার কারণে তিনি কখনও তাদের সাথে দেখা করতে যাননি। তাদের আরামপ্রীতি, সৌন্দর্যের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি, তাদের পুরুষসুলভ আগ্রাসী মনোভাব আর লড়াকু কুশলতার কমতি নিয়ে তিনি ব্যঙ্গ করতেন এবং তাদের সংস্কৃতিমনা দরবারের দৈন্যতা নিয়ে রসিকতা করতেন-যেখানে একজন দক্ষ যোদ্ধার চেয়ে লেখককে বেশি মর্যাদা দেয়া হয় এবং কবির দল যুদ্ধে জয়লাভ নিয়ে কাব্য রচনা না করে, রসাল সুপক্ক হাঁসের মাংস কিংবা “জীবন বারি” হিসাবে পরিচিত সুরা পানের আনন্দ নিয়ে সাহিত্য রচনায় ব্যস্ত।

কিন্তু তারা কি আসলেই এতোটাই মূর্খ ছিলো? বাবর ভাবে। এতদিন তারা তাদের কমনীয় জীবনযাপন বজায় রাখতে পেরেছিলো। সমরকন্দ, খোরাসান, ফারগানা, কুন্দজ উজবেকদের পদানত হবার পরে তৈমূর বংশীয় শাসকদের ভিতরে কেবল সেই এখন পর্যন্ত জীবিত রয়েছে ভেবে সে চমকে উঠে। একটা বিশাল দায়িত্ব একটা পবিত্র বিশ্বাস রক্ষার দায়িত্ব এখন তার উপরে অর্পিত হয়েছে। তার সেনাবাহিনীর অবস্থা যাই হোক, রসদের সরবরাহ থাকুক বা না থাকুক, তৈমূরের সাম্রাজ্যের টিকে থাকা অংশটুকু রক্ষা করতে বা সেটা করতে গিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে দেহরক্ষা করতে হলেও তাকে অবিলম্বে সাইবানি খানের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করতে হবে।

শাহী পরিবার, বিশেষ করে এর রমণীদের উপরে উজবেকদের- যা সম্ভবত সত্যি তাদের প্রকৃতির সাথে সেটা মিলে- অত্যাচারের বিষয়টা আবারও তাকে খানজাদার কথা ভাবতে বাধ্য করে। সে কি এখনও বেঁচে আছে? সে এতোদিন নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করেছে যে, মৃত খানজাদার চেয়ে জীবিত খানজাদা দরকষাকষির ক্ষেত্রে অনেক কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে। আম্মিজানকে সাহস দিতে সে এই কথাটা তাকে বারবার বলেছে। নিজের মা মারা যাবার পরে, খুতলাঘ নিগার এখন পূর্বের চেয়ে আরও বেশি করে বিশ্বাস করতে চান যে, তিনি আবার খানজাদাকে দেখতে পাবেন। সে তাকে কখনও তার ভয়ঙ্কর ভাবনার কথা বলতে পারবে না যে ছেলেবেলায় সমরকন্দে সে যে নির্যাতন সহ্য করেছিলো, তার প্রতিশোধ নেবার স্পৃহা কখনও প্রশমিত হবার নয়। আর সে নির্যাতন করাটাকে গৌরবের বিষয় বলে মনে করে এবং তৈমূরের বংশের একজন শাহজাদীকে কলঙ্কিত করাটা সে বস্তুত পক্ষে উপভোগই করবে।

“সুলতান…” বাইসানগারের উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বরে বাবরের বিক্ষিপ্ত ভাবনার জাল ছিন্ন হয়।

বাবর নিজেকে সংবরণ করে। “আমি সাইবানি খানের কাবুল আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করবো না। আগামী সপ্তাহে আমরা আমাদের সেনাবাহিনী যে অবস্থায় আছে তাই নিয়ে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করবো। আমাদের বর্তমান সৈন্য সংখ্যা এখন কতো?”

“প্রায় আট হাজার।”

উজবেক পঙ্গপালের সাথে কোনোমতেই তুলনীয় না সংখ্যাটা। কিন্তু এসান দৌলত সব সময়ে কি যেন বলতেন?: “যতক্ষণ শ্বাস নিতে পারছো ততক্ষণ হতাশ হয়ো না।”

“সাইবানি খানকে মোকাবেলা করার জন্য আমি এতোদিন ধরে মনে মনে যা ভেবে এসেছি সময় হয়েছে সেটাকে কার্যকরী করার। বার্তাবাহকদের এই মুহূর্তে রওয়ানা হতে বললা- আজ রাতেই সব গোত্রের কাছে, কাফিররাও বাদ যাবে না, তাদের পাঠাও। যারা আমার সাথে এই অভিযানে সামিল হবে তাদের আগামী পাঁচ বছর ফসল আর গবাদি পশুর জন্য কোনো খাজনা দিতে হবে না এবং আমিও তাদের ভালোই পারিশ্রমিক দেব। হিরাতে কি হয়েছে তাদের জানাবে এবং এটাও বলবে যে সাইবানি খান আমাদের সবার শত্রু। উজবেক না এমন সবার সে বিনাশ করবে…”

সেই রাতে, কেবল বাবুরীর সাহচর্যে সে দূর্গপ্রাকারের ছাদে আরোহন করে। স্থানটা তার খুব প্রিয় এবং সাধারণত তার মনকে প্রশান্ত করে তুলে। নিচের তৃণভূমি, যাযাবর পশুপালক আর বণিকের দল রাতের খাবার তৈরির প্রস্তুতি গ্রহণ করতে, রান্নার আগুনে অন্ধকারের মাঝে মাঝে লালচে আভা ফুটে রয়েছে। বাবর তাদের হাসি আর গল্পের আওয়াজ, ভেড়ার নাক ঝাড়া আর উটের কাশির শব্দ শুনতে পায়। দূরে, প্রতিরক্ষা দেয়ালের শক্তিশালী ব্যুহের পেছনে কাবুল শব্দহীন পড়ে আছে। শহরের নাগরিকদের মনে এই মুহূর্তে কি ভাব খেলা করছে? পশ্চিম থেকে আগত সওদাগরী কাফেলা নিশ্চয়ই বাণিজ্য দ্রব্যের সাথে সাথে গুজবও বয়ে আনছে। শহরের মানুষ এতোদিন খোরাসানের বিপর্যয়ের কথা জেনে গিয়েছে। আর এবার সাইবানি খান তাদের শহরের অভিমুখে এগিয়ে আসবে।

বাবুরীকেও বিষণ্ণ দেখায়।

“তোমার আবার কি হলো?” বাবর সহসা আগ্রহী হয়ে উঠে।

“আমি ভাবছিলাম আজ থেকে একমাস বা এক বছর পরে আমরা কি অবস্থায়। থাকবো…”।

“তার মানে তুমি বলতে চাইছো যে আমরা বেঁচেবর্তে থাকবে কিনা?”

“আংশিক, কিন্তু তারচেয়েও বড় কথা কি ঘটবে আমাদের ভাগ্যে।”

“তুমি কি ভীত?”

“আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। আর সেটাও আমাকে ভাবিয়ে তুলছে…আপনি কি ভীত?”

বাবর এবার ভাবুক হয়ে পড়ে। “না, আমি ভীত নই। আমি উদ্বিগ্ন, কিন্তু দুটো এক জিনিস না। আমি চিন্তিত আমার পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে। আমি যে পরিবেশে জন্ম নিয়েছি। আমার বাবা, তার বাবা যে পৃথিবীকে চিনতো- তা দ্রুত বদলে যাচ্ছে। ফারগানার কর্তৃত্ব খোয়াবার পরের বছরগুলো, আমি মূলত ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়িয়েছি। এমনকি, এখানে আমি যদিও আবার সালতানাৎ ফিরে পেয়েছি। কিন্তু আমার সবকিছু, আমার সর্বস্ব একটা সুতোর উপরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি যদি সাইবানি খানকে পরাজিত করতে না পারি, তবে আমি এখন পর্যন্ত যা অর্জন করেছি সব নিরর্থক হয়ে পড়বে এবং যা কিছু আমি আগলে রাখতে চাই সেসব কিছুই লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে…”

“আপনি ভীত যে কেউ আপনাকে মনে রাখবে না?”

“না, ব্যাপারটা তারচেয়েও ব্যাপক। আমি উদ্বিগ্ন যে আমি হয়তো মানুষের স্মৃতিতে থাকবার যোগ্য নই…”

অন্ধকার আর গাঢ় হতে বাবর বাবুরীর মুখ দেখতে পায় না। কিন্তু অনুভব করে সে আলতো করে তার কাধ স্পর্শ করেছে। একটা বিরল আচরণ যা তার মস্তিষ্কে সিন্দাবাদের দানোর মতো চেপে বসা বোঝাটা হাল্কা করে দেয়। বাবুরী তাকে যেন বলতে চায় আসন্ন লড়াইয়ে সে নিজেকে একলা পাবে না…

*

বাবর মুখ থেকে ঘাম মুছে এবং রেকাব থেকে পা দুটো বের করে টান টান করে। আজ নিয়ে ছয়দিন তারা টানা ঘোড়ার পিঠে রয়েছে। সাথে যুদ্ধ উপকরণ বহনকারী ভারবাহী পশুর বহরের কারণে তাদের অগ্রসর হবার গতি বেশ শ্লথ ছিলো। শীঘ্রই অবশ্য তারা শিবারতু গিরিপথে প্রবেশ করবে, যা তাদের পাহাড়ের মাঝ দিয়ে। পশ্চিমে খোরাসানের দিকে নিয়ে যাবে। গিরিপথ একবার অতিক্রম করলে তারা যে অঞ্চলে প্রবেশ করবে, সেখানে উজবেক হানাদার বাহিনীর সাথে তাদের সংঘর্ষ, হবার সম্ভাবনা রয়েছে…কিন্তু তাকে ধৈর্য ধারণ করতে হবে। সাইবানি খানের সাথে সম্মুখ সমরে তার জয়লাভের কোনো সম্ভাবনা নেই। নিজের বাহিনীকে প্রথমে আত্মবিশ্বাসে বলিয়ান করে তুলতে হবে এবং তার বয়ঃসন্ধিক্ষণে পাহাড় থেকে আকস্মিক নেমে এসে ঝটিকা আক্রমণের রণনীতি সাফল্যের সাথে ব্যবহার করে তাকে নতুন নতুন মিত্রের সাথে গাঁটছড়া বাঁধতে হবে। সে শত্রুবাহিনীর উপরে আচমকা আক্রমণ চালিয়ে তাদের বিপর্যস্ত করে। তারা সংঘটিত হয়ে প্রত্যাক্রমণ করার আগে নিজের বাহিনী নিয়ে পালিয়ে আসবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত দূর্গ দখল করে এবং সেখানে প্রাপ্ত মালামাল আর অস্ত্রশস্ত্র উপঢৌকন হিসাবে ব্যবহার করে অন্যদের বিশ্বস্ততা অর্জন করবে। যতক্ষণ না সে ধীরে ধীরে সাইবানি খানের বিশাল বাহিনীর মোকাবেলা করার মতো শক্তিশালী হয়ে উঠে।

নিজের ধূসর ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে বাবর থামবার আদেশ দেয়। ঢালু পাহাড়ের পাদদেশে তৃণভূমিতে আজ রাতের মতো তারা যাত্রা বিরতি করবে, পাহাড়ের কারণে সেদিক থেকে আচমকা আক্রমণের কোনো সম্ভাবনা নেই। সে ঘোড়া থেকে নেমে তার যুদ্ধ মন্ত্রকের সভা আহ্বান করে। সভায় আগমনকারী সবাই সমবেত হলে সেটা বিচিত্র একটা সমাবেশে পরিণত হয়-বাইসানগারের ন্যায় পোড়খাওয়া সেনাপতির পাশে এমন অনেক ভেড়ার চামড়ার আচকান পরিহিত উপজাতি সর্দার এসে আসন গ্রহণ করে। যারা কেবল একটা কি দুটো মাটির তৈরি বসতির উপরে কর্তৃত্ব করে থাকে। তার বাহিনীর লোকবল দশ হাজারের চেয়ে কম হওয়ায় সে চায়। তার প্রতিটা লোক যেনো স্বেচ্ছায় তার সাথে এই অভিযানে অংশ নেয়। উচ্ছল উপজাতির সদস্যরাও যেনো বাদ না যায়। আর সে চায় তারা সমস্ত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও যেনো তার উপরে আস্থা রাখতে পারে।

“আর কয়েকদিন, আমরা গিরিপথ অতিক্রম করবো। ভাগ্য ভাল হলে, উজবেক বদমাশগুলো আমাদের উপস্থিতি টের পাবে না। আমরা সেটার উপরেই ভরসা করে আছি। তারা ভাবতে থাকুক কসাইয়ের খোঁয়াড়ে বাঁধা ভেড়ার মত আমরা কাবুলে অসহায়ভাবে তাদের জন্য অপেক্ষা করছি। আমার গুপ্তদূতের দল আর গুপ্তচরেররা আরও তথ্য উপস্থাপন না করা পর্যন্ত হিরাতের দিকে এগিয়ে যাওয়াটা উচিত হবে না। কিন্তু ভুললে চলবে না আমরা পাহাড়ের লড়াকু যোদ্ধার দল, নেকড়ের মতো ধূর্ত যারা হরিণের পালের দিকে অন্ধের মতো ধেয়ে যায় না। আত্মগোপন করে অপেক্ষা করতে থাকে, জানে সে যদি ধৈর্য ধরে তাহলে পালের কমজোরী একটাকে থাবার ভিতরে পেয়ে রক্তের স্বাদ পাবে…আমাদেরও নেকড়ের মতো হতে হবে। তোমরাও তাই নিজেদের লোকদের অস্ত্রে শান দিয়ে প্রস্তুত থাকতে বলো।”

ঘন ঘন মাথা নাড়া আর উৎসুক দৃষ্টি বিনিময় দেখে সে বুঝতে পারে তার কথা জায়গা মতো পৌঁছেছে। “আর পবিত্র কোরানের বাণী মনে রাখবে: ‘আল্লাহতালা সদয় হলে, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বাহিনীর পক্ষেও বিশাল শক্তিকে পরাস্ত করা সম্ভব।”

*

“সুলতান, প্রায় চারশো উজবেকের একটা দল, এখান থেকে তিন কি চার মাইল দূরে একটা নদীর অপর পাড়ে রয়েছে। দূর থেকে দেখে মনে হয়েছে তারা নদী পার হবে। সেজন্য তাদের ঘোড়া আর মালবাহী গাধার পিঠে মালপত্র সমানভাবে বিন্যস্ত করেছে তাদের এপারে সাঁতরে নিয়ে আসবে বলে…আমরা যদি দ্রুত এগিয়ে যাই তবে নদী অতিক্রম করার মাঝে আমরা তাদের আক্রমণ করতে পারি…” খবর নিয়ে আসা গুপ্তদূত ভীষণভাবে হাঁপাতে থাকে এবং তার খোঁজা করা বাদামী রঙের ঘোড়াটার দেহ ঘামে ভিজে জবজব করছে।

বাবুরী আর বাইসানগারের দিকে তাকিয়ে বাবর ক্রুর একটা হাসি হাসে। অবশেষে, প্রায় দু’সপ্তাহ পাহাড়ের ঢালে অবস্থিত ঘন বনের আড়ালে পশ্চিম দিকে এগিয়ে যাবার পরে তারা নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ পেয়েছে। উজবেক দলটা নদী পার হবার কাজে ব্যস্ত থাকবে, ঢাল পিঠে বাঁধা থাকবে আর তীর ধনুক পানির হাত থেকে বাঁচাতে চামড়া দিয়ে মোড়ানো থাকবে। আর তাদের অন্য অস্ত্রগুলো তরবারি, খঞ্জর আর রণকুঠার পানিতে কোনো কাজে আসবে না।

“বাইসানগার অগ্রগামী একটা বাহিনী প্রস্তুত করো।” বাইসানগারের পরামর্শে বাবর নিজের পাঁচশ শ্ৰেষ্ঠ যোদ্ধা নির্বাচিত করে এবং তাদের পঞ্চাশজনের একেকটা দলে বিভক্ত করে প্রতিটা দলকে নেতৃত্ব দেবার জন্য আলাদা আলাদা দলনেতা রয়েছে। উজবেক হানাদারদের মোকাবেলা করার জন্য যথেষ্ট। বাকি সৈন্য আর রসদপত্র এখানেই মজুদ থাকবে অধিকতর সৈন্য মোতায়েন প্রয়োজন না হওয়া পর্যন্ত।

দশ মিনিট পরে, গুপ্তদূত আরেকটা নতুন ঘোড়ায় চড়ে, বাবরের পাশে অগ্রগামী দলটার সাথে ভেড়া চলাচলের একটা ঢালু পথ ধরে পাহাড়ের ভিতর দিয়ে নদীর দিকে এগিয়ে যায়। তাদের কপাল ভালো গত রাতে বৃষ্টি হয়েছে এবং মাটি ভেজা থাকায় আগুয়ান ঘোড়ার খুরের শব্দ শোনবার জন্য কেউ কান খাড়া করে থাকলেও তার পক্ষেও শব্দ আলাদা করে সনাক্ত করা মুশকিল হবে। আরো খুশির খবর, গুপ্তদূত তাদের উজবেক অবস্থান থেকে কয়েকশ গজ সামনে একটা অশ্বক্ষুরাকৃতি বাঁকের কাছে নিয়ে চলেছে যেখানে অবস্থিত ঘন উইলো গাছের জঙ্গল তাদের উপস্থিতি গোপন রাখবে।

বাবর কাবুলের কামারশালায় তার জন্য বিশেষভাবে তৈরি ইস্পাতের বর্মের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখে। তার ইস্পাতের জালির তৈরি আলখাল্লা মাপমতোই হয়েছে আর কোমরে রয়েছে আলমগীর। সে প্রস্তুত। তার ভিতরে টগবগ করতে থাকা আবেগ কণ্ঠ চিরে বের হয়ে আসতে চায়। যদিও সে জানে সেটা অসম্ভব…অন্তত এখনও সময় হয়নি…

আরো দু’মাইল এগিয়ে যাবার পরে মেঠো পথটা প্রশস্ত হতে শুরু করে- বাবরের ছয়জন অশ্বারোহী সৈন্য এখন পাশাপাশি এগিয়ে যেতে পারছে-কিন্তু আশেপাশে। গাছপালার আড়াল কমে এসেছে। বাবরের ভ্রু কুঁচকে উঠে সে গুপ্তদূতের সাথে। আলাপ করে এবং হাত তুলে নিজের লোকদের থামবার নির্দেশ দেয় এবং সম্প্রতি তার পথসঙ্গীর দায়িত্বে নিয়োগ পাওয়া, তার কিশোর কচিকে ডেকে পাঠায়।

“দ্রুত বহরের শেষপ্রান্তে ঘোড়া নিয়ে যাও। আমার সেনাপতিদের বলবে তীর ধনুক প্রস্তুত রেখে যে কোনো মুহূর্তে রওয়ানার অবস্থায় যেনো নিজেদের অধীনস্ত লোকদের তৈরি রাখে, আর কেউ যেনো কোনো কথা না বলে। আমরা নদীর বাঁকে পৌঁছে যাত্রাবিরতি করবো। আর সেই সময়ে গুপ্তদূতেরা সামনের পরিস্থিতি জরিপ করে আসবে। তারা যদি খবর নিয়ে আসে যে উজবেকরা এখনও নদী অতিক্রম করেনি, আমরা তাহলে হামলা করবো। বুঝতে পেরেছো?” ছেলেটা দ্রুত মাথা নাড়ে এবং ঘোড়া ছুটিয়ে এগিয়ে যায়।

তারা পুনরায় যাত্রা শুরু করতে বাবরের বুক উত্তেজনায় ধকধক করতে থাকে। সে টের পায় অনুভূতি অপার্থিব ধরণের সজাগ হয়ে উঠছে- ঘাসের ডগায় মোচড়াতে থাকা এক শুয়া পোকার খোঁচা খোঁচা কালো লোম সে খেয়াল করে এবং বেগুনী-গোলাপী রঙের নধর বুকের এক বন্য কবুতর গাছের ডালে বিশ্রামরত অবস্থায় তাকিয়ে রয়েছে। ঘামের গন্ধ- তার নিজের এবং তার ঘোড়ার আর তার আশেপাশের লোকদের আর তাদের ঘোড়ার জীবনের তীব্র নির্যাসের ইঙ্গিতময় একটা মেঘের মতো চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে। মৃত্যুর সান্নিধ্য ছাড়া বোধহয় একজন মানুষ কখনও নিজেকে এতো বেশি জীবন্ত অনুভব করতে পারে না।

“সুলতান আপনি এখানে বিশ্রাম করেন আমি সেই ফাঁকে রেকী করে আসি।” গুপ্তদৃত বলে। আরো দু’শ গজ এগিয়ে যাবার পরে বুড়ো উইলো গাছের সুঠাম পালকের মতো শোভিত ডালের ফাঁক দিয়ে বাবর প্রথমবারের মতো পানির ঝলক দেখতে পায়।

“বেশ, তবে দ্রুত ফিরে আসবে।”

“হ্যাঁ, সুল-” কালো পালকের তৈরি একটা উজবেক তীর গুপ্তদূতের গালে বিদ্ধ হয় এবং আরেকটা তার কণ্ঠনালী বিদীর্ণ করলে বেচারা আর কিছু বলতে পারে না। তৃতীয় আরেকটা তীর নির্দোষ ভঙ্গিতে এসে মাটিতে আছড়ে পড়ে। বুদবুদের ন্যায় রক্ত বের হয়ে আসলে, লোকটার চোখ থেকে সব ভাব মুছে যায় এবং সে ঘোড়া থেকে উল্টে পড়ে কিন্তু তখনও একটা পা রেকাবে আটকে থাকে।

বাবরের চারপাশে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য শোরগোল শুরু হতে, সে ঝুঁকে তার ঘোড়ার গলা আঁকড়ে ধরে। প্রতি মুহূর্তে শত্ৰু তীরের শীতল ফলা নিজের দেহে বিদ্ধ হবার শঙ্কা করে। বাম হাতে ঘোড়ার লাগাম ধরে, ডান হাতে পিঠের উপর থেকে ধাতব পাত দেয়া ঢালটা টেনে নিরাপত্তার জন্য মাথার উপরে ধরে। কিন্তু আর কোনো তীর বাতাস কেটে ভেসে আসে না। বাবর সতর্কতার সাথে মাথা তুলে তাকায়। তার বাম দিকে, দুলতে থাকা সোনালী উইলো গাছের মাঝেযেদিক থেকে তীর ছোঁড়া হয়েছে- সে তিনজন উজবেক অশ্বারোহীকে নদী যেখানে তীক্ষ্ণ একটা বাঁক নিয়েছে তীর বরাবর সেদিকে এগিয়ে যেতে দেখে।

অশ্বারোহী তিনজন সম্ভবত উজবেক গুপ্তদূত, আশেপাশে নজর রাখছে অন্যেরা যখন নদী অতিক্রম করতে ব্যস্ত। সে অশ্বারোহী তিনজনকে ছেড়ে দিতে পারে না। তাহলে তারা ফিরে গিয়ে সবাইকে সতর্ক করে দেবে। ঘোড়ার পাঁজরে খোঁচা দিয়ে বাবর মাথা পেছনে নিয়ে চিৎকার করে আক্রমণের আদেশ দেয়।

উইলোর বনের ভিতর দিয়ে তীব্র বেগে ঘোড়া নিয়ে এগিয়ে যাবার সময় চাবুকের মতো উইলোর ডাল তার মুখে আছড়ে পড়তে থাকে এবং ঠোঁট কেটে গেলে সে মুখে রক্তের স্বাদ পায়। নদীর প্রশস্ত তীরে পৌঁছে, সে উজবেক অশ্বারোহীদের বাকের ওপাশে হারিয়ে যেতে দেখে এবং অভিশাপ দেয়। সে লাগাম ছেড়ে দিয়ে কাঁধ থেকে ধনুক নামিয়ে তূণ থেকে একটা তীর তুলে নেয়। রেকাবে অর্ধেক দাঁড়ানো অবস্থায় এবং দুই হাঁটু দিয়ে ঘোড়াটাকে স্থির রেখে সে ধনুকের ছিলায় তীর পরায় এবং গুণটা কান পর্যন্ত টেনে আনে। তীরটা সোজা আর দ্রুত ছুটে গিয়ে এক উজবেক ঘোড়ার পশ্চাদদেশে আমূল বিদ্ধ হয়। বাবর ঘোড়াটাকে চিহি সুরে আর্তনাদ করতে শোনে এবং পিঠের আরোহীসমেত পিছলে নদীতে আছড়ে পড়তে দেখে। বাবুরীও তীর ছুঁড়ে কিন্তু বাকি দুই উজবেক হাওয়ার মতো বেমালুম গায়েব হয়ে যায়।

বাবর আর তাকে ঘিরে থাকা অশ্বারোহী যোদ্ধারা বল্পিত বেগে তীক্ষ্ণ বাঁকটা পার হয়, মাথার চুল বাতাসে উড়তে থাকে এবং তার হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে উঠে। বেঁচে যাওয়া দুই উজবেক অশ্বারোহী চিৎকার করে আশপাশ মাথায় তুলে এবং পাগলের মতো হাতপা নাড়তে থাকে কিন্তু উজবেক সহযোদ্ধারা তাদের মরিয়া ভাব খেয়াল করে না। একটা ছোট দল, তখনও দূরবর্তী পাড়ে অবস্থান করছিলো প্রথম কিছু একটা গড়বড় হয়েছে টের পায় এবং নিজেদের অস্ত্রের জন্য মরিয়া হয়ে উঠে কিন্তু সেসব তখন অধিকাংশই পানিতে। বাকীরা নিজেদের ঘোড়া নিয়ে দ্রুত বহমান স্রোতস্বিনী অতিক্রম করে অন্যপাশে পৌঁছাতে চায়।

পানিতে ভিজে চুপচুপে অবস্থায় কয়েকজন মাত্র এপারে এসে পৌঁছেছে। ঘোড়ায় উপবিষ্ট অবস্থায় বাবর আর তার লোকেরা এক পশলা তীর নিক্ষেপ করলে অনেকে মুথ থুবড়ে পড়ে। বাবর তারপরে তার লোকদের ঘোড়া থেকে নেমে গাছ আর পাথরের আড়াল ব্যবহার করে তীর নিক্ষেপ করা অব্যাহত রাখতে বলে। নদীর অন্য পাড়ে অবস্থানরত অনেক উজবেকও তীরের আঘাতে ভূমিশয্যা নেয় এবং রক্তে লাল হয়ে উঠা নদীর পানিতে মৃত আর মৃতপ্রায় লোক আর তাদের বাহন একটা অনড় স্তূপের জন্ম দেয়, যা নদীর স্রোতও ভাসিয়ে নিয়ে যেতে ব্যর্থ হয়।

“সুলতান।” আর্তনাদ আর গোঙানির আওয়াজ ছাপিয়ে বাবুরীর কণ্ঠস্বর পরিষ্কার শোনা যায়।

বাবর চারপাশে তাকালে একেবারে ঠিক সময়মতো দেখে যে সেই দুই অশ্বারোহী উজবেক গুপ্তদূতদের একজন, যাদের কথা সে ভুলে গিয়েছিলো তার দিকে ধেয়ে আসছে। লোকটার হাতে চকচকে কিছু একটা চমকায়-একটা রণকুঠার। লোকটা হাত পেছনে দিয়ে কুঠারটা এমন জোরে ছুঁড়ে মারে যে বাবর যেনো বাতাস কেটে সেটার ছুটে আসবার শব্দ শুনতে পায়। বাবর একপাশে কাত হলে তার ডান কান ছুঁয়ে কুঠারটা প্রচণ্ড বেগে পেছনের কাদামাটিতে গিয়ে আছড়ে পড়ে।

সে মেজাজ খারাপ করে ঘুরে দাঁড়িয়ে কুঠারটা মাটি থেকে টেনে তুলে এবং ওজন পরখ করে দেখে-বেশ ভালোই ভারসাম্য রয়েছে। উজবেক যোদ্ধাটা এখন আর মাত্র কয়েক গজ দূরে। ইস্পাতের চূড়াকৃতি শিরোস্ত্রাণের নিচে কঠোর অভিব্যক্তি, আর হাতে বাঁকানো তরবারি নিয়ে সে জিনের উপরে ঝুঁকে রয়েছে। বাবুরী এবার সামনের দিকে ধেয়ে আসে।

“না আমার জন্য ছেড়ে দাও।” সে চিৎকার করে উঠে। হাতের ধনুক ফেলে দিয়ে, সে ডান হাতে কুঠারটা নিয়ে দাঁড়িয়ে মোক্ষম সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। তার থেকে যখন মাত্র কয়েক পা দূরে লোকটা, বাবর কুঠারটা তখন ছুঁড়ে মারে। ফলাটা বিদ্ধ না হয়ে কুঠারের হাতলটা গিয়ে তার মুখে আঘাত করে নাকটা থেতলে দেয়। কিন্তু সে তারপরেও কোনোমতে ঘোড়ার পিঠে বসে থাকে। উজবেক যোদ্ধা তার দিকে ধেয়ে আসতে বাবর তার ঘোড়ার উষ্ণ নিঃশ্বাস টের পায়। সে এবার সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে উজবেকটার বাম পা হাঁটুর কাছে আঁকড়ে ধরে। তার বর্মের ধাতব শৃঙ্খলে বাবরের আঙ্গুল কেটে যায়। কিন্তু তাতে শাপেবর হয় সে আরও জোরে আঁকড়ে ধরে গায়ের সব শক্তি দিয়ে নিজের দিকে টানে। উজবেকটার নাক থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়ছে, উড়ে গিয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ে। কিন্তু কোনোমতে নিজের আগুয়ান ঘোড়ার ক্ষুরের নাগাল থেকে গড়িয়ে সরে যায়।

পায়ের গোড়ালির উপরে মল্লযোদ্ধার মতো দাঁড়িয়ে বাবর আর লোকটা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকে। আঁচ করতে চেষ্টা করে প্রতিপক্ষের মতিগতি। রক্ত রঞ্জিত উজবেক যোদ্ধা কোনো ব্যথা অনুভব করলেও তার অভিব্যক্তিতে সেটা প্রকাশ পায় না। প্রতিপক্ষকে সে বরং চোখ কুঁচকে মাপতে চেষ্টা করে। বাবরকে তার পরণের পোশাক দেখে সুলতান বলে চেনার কোনো উপায় নেই- উজবেকটা তাকে কেবল। আরেকজন যোদ্ধা বলে ভেবে নিয়েছে।

বাম হাতে খঞ্জর আর ডান হাতে আলমগীর নিয়ে প্যাঁচ খেলার ভঙ্গিতে সামনে এগোবার ভান করে। তারপরে উজবেকটা ফাঁদে পা দিলে লঘু পায়ে লাফিয়ে আবার পেছনে সরে আসে। প্রতিপক্ষের চারপাশে বৃত্তাকারে ঘুরতে ঘুরতে বাবর দ্বিতীয়, তারপরে তৃতীয়বার একই চালাকি করে। উজবেকটা প্রতিবারই প্ররোচিত হয়ে তরবারি চালায় কিন্তু বাবর প্রতিবারই তাকে উত্যক্ত করে সরে আসে। দেহের প্রতিটা পেশী সতর্ক উত্তেজিত অবস্থায়, বাবর চতুর্থবারের মতো সামনে এগিয়ে যাবার ভান করে। উজবেকটা এবার ইতস্তত করে ভাবে এবারও বাবর পিছিয়ে যাবে- যে সে আসলে আক্রমণ করবে না। কিন্তু এবার পিছিয়ে যাবার পরিবর্তে, বাবর লোকটার অরক্ষিত গলা লক্ষ্য করে তরবারি চালিয়ে ডান পায়ে তার দুই উরুর সংযোগস্থলে বেমক্কা একটা লাথি বসিয়ে দেয়। উজবেকটা দুহাতে উরুর মধ্যবর্তী অংশ আঁকড়ে ধরে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে। গলা দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়ছে।

কিন্তু বাবর তাকে শেষ করে দেবার অভিপ্রায়ে সামনে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করতে নদীর তীরের আঠাল কাদায় তার পা পিছলে যায় এবং মাটিতে আছাড় খেলে হাত থেকে খঞ্জরটা ছিটকে যায়। আর আলমগীর তার দেহের নিচে চাপা পড়ে। আহত উজবেক নিজের টিকে থাকার সুযোগ ঠিকই চিনতে পারে। নিজেকে টেনে তুলে সে তার তরবারি খুঁজে নিয়ে সামনে এগিয়ে আসে আক্রমণ করতে। বাবর নিজেকে রক্ষা করতে বাম হাত উঁচু করে এবং সাথে সাথে তীব্র একটা যন্ত্রণা তাকে আচ্ছন্ন করে। নিচের দিকে তাকালে সে তার কলাচীর নিচের অংশে একটা গভীর ক্ষত দেখতে পায় এবং রক্ত গড়িয়ে পড়তে থাকার কারণে বাম হাত বেগুনী দেখায় আর দপদপ করতে থাকে।

সহজাত প্রবৃত্তির বশে সে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করে এবং সেটা করতে গিয়ে সে উজবেক যোদ্ধার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে চেষ্টা করলে। নিজের ক্ষতস্থান থেকে রক্তপাতের ফলে দুর্বল হয়ে পড়ার কারণে উজবেকটা মন্থর ভঙ্গিতে প্রতিক্রিয়া দেখায়। দেখে মনে হয় হাঁটু পর্যন্ত পানিতে সে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আলমগীর মুক্ত করে, বাবর এবার তরবারিটা গায়ের সব শক্তি দিয়ে উজবেকটার কণ্ঠনালী লক্ষ্য। করে চালায় এবং সেটা তার গলার পিছন দিয়ে বের হয়ে আসে। লোকটার ছিন্ন। হওয়া ধমনী থেকে ফিনকি দিয়ে বের হয়ে আসা রক্ত বাবরের গায়ে ছিটকে এসে তার নিজের রক্তের সাথে মিশে যায়।

বাবর এবার সুযোগ পেয়ে চারপাশে তাকিয়ে দেখে, লড়াই শেষ হয়ে গেছে। উজবেক হানাদার দলটার লোকেরা হয় মৃত বা পালিয়ে গেছে। রক্তপাত হ্রাস করার জন্য বাবর আহত বামহাত মাথার উপরে তুলে ধরে এবং ডান হাতে গলায় জড়ানো একটা সুতির কাপড় খুলে নিয়ে সেটা বাবুরীর হাতে দেয়। তারপরে সে বামহাতটা নিচে নামায় যা ইতিমধ্যে আড়ষ্ট হয়ে উঠতে আরম্ভ করেছে। সে হাতটা তার দিকে এগিয়ে দেয়। “শক্ত করে বাঁধো…আজ আবার আমাদের যুদ্ধ করতে হতে পারে…” তার উল্লাস ইতিমধ্যে কমতে শুরু করেছে কিন্তু কেনো। খুব সম্ভবত এজন্য যে সাইবানি খানের কাছে তিনশ লোকের মৃত্যু রাতের বেলা মশার কামড়ের মতো নগণ্য একটা ব্যাপার…পুরো ব্যাপারটা নিষ্পত্তি হবার আগে বাবরকে এখনও অনেক বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হবে…

InfotakeBD

View posts by InfotakeBD
InfotakeBD is a information sharing blog, We share information for you. Please visit us and if you want to contribute for this blog please email us infotakebd@gmail.com. Thank you
Scroll to top
error: Content is protected !!