মহানবী (সঃ) এর জন্ম ও বংশ পরিচয়
মহাপ্লাবনের পরবর্তী কালের কথা। হযরত নূহ আঃ এর পুত্র- সাম, হাম, ইয়াফাস ও রাফেজের বংশধরগণ কালক্রমে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং সেমিটিক, হ্যামিটিক ও আর্য সভ্যতার বিকাশ ঘটায়। আরব জাতি সেমিটিক তথা সামের বংশধর ছিল। পরবর্তীতে সামের বংশ থেকে হযরত ইব্রাহীম আঃ, ইসমাঈল আঃ সহ অসংখ্য নবী-রাসূলের আগমন ঘটেছিল। একদা হযরত ইবরাহিম আঃ বর্তমান সিরিয়ার বাবেল থেকে মক্কায় হিজরত করেন। পরবর্তীতে ইব্রাহীম আ ও ইসমাইল আঃ বংশধরেরা মক্কা তথা সমগ্র হিজাজে তাদের বসতি স্থাপন করে।
অতঃপর হযরত ইব্রাহিম আঃ এবং ইসমাইল আঃ মহান আল্লাহর নির্দেশে মক্কায় পবিত্র কাবাঘর নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে হযরত ইসমাইল আঃ এর উত্তরাধিকারীদের মধ্যে হতে প্রথমে বানু যুরহুম ও পরে বানু খোজা কাবা গৃহের রক্ষণাবেক্ষণের কর্তৃত্ব লাভ করে। এরপর ইসমাইল আঃ এর বংশের শাখা গোত্র কুরাইশ মক্কার তত্ত্বাবধায়তের দায়িত্ব গ্রহণ করে।
হযরত ইব্রাহীম আঃ এর পুত্র হযরত ইসমাইল আঃ হতে কুরাইশ বংশের উৎপত্তি।ইসলামের শেষ নবী মহানবী হযরত মুহাম্মদ সঃ এই কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। মহানবী সঃ এর পিতা ছিলেন আব্দুল্লাহ। আব্দুল্লাহর পিতা ছিলেন আবদুল মুত্তালিব, আব্দুলি মুত্তালিবের পিতার ছিল হাশিম, হাশিমের পিতা ছিল আবদে মানাফ, আবদে মানাফের পিতার নাম ছিল কুশায়।
কুশায় ছিলেন কিলাবরে পুত্র, কিলাব ছিলেন মোরার পুত্র, মোরার পিতা ছিলেন কাব, কাবের পিতা ছিলেন লোবাই, লোবাইয়ের পিতার নাম ছিল গালিব, গালিবের পিতার নাম ছিল ফিহর। এই ফিহরের অন্য নাম ছিল কোরাইশ। এই কোরাইশ নাম অনুসারেই কুরায়েশ বংশের নামকরণ করা হয়। কুরাইশ খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দীতে জীবিত ছিলেন। খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে ফিহরের বংশধর কুশাই মক্কা ও হিজাজে তার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করে। কুশাই ৪৮০ খ্রিস্টাব্দে কুশাই এর মৃত্যুর পর তার পুত্র আবদুদ্দার তার স্থালাভিষিক্ত হন।
কিন্তু আব্দু্দোরের মৃতু্যর পর মক্কার শাসনভার নিয়ে তার পৌত্রদের এবং তারা ভাই আব্দুল মানাফের পুত্রদের মধ্যে বিবেদ শুরু হয়। এই বিবেদ আপোষ-মিমাংসের পর ঠিক হয় যে, আব্দু মানাফের পুত্র শামসের হাতে মক্কার জল সরবারহ এবং কর আদায়ের ভার থাকবে। আর কাবা মন্ত্রণাগৃহ এবং সামাজিক বিভাগের দায়িত্ব থাকবে আব্দুদ্দারের পৌত্রগণের হাতে। আব্দু মানাফ তার ক্ষমতা স্বীয় ভাই হাশিমকে অর্পণ করেন।
হাশিমের মৃত্যুরপর তার অপর ভাই দয়ালু মুত্তালিব শাসনভার গ্রহণ করেন। ৫২০ খ্রিস্টাব্দে দয়ালু মুত্তালিব মৃত্যুবরণ করলে তার ভ্রাতুষ্পুত্র ও হাশিমের পুত্র আব্দুল মুত্তালিব তার স্থালাভিষিক্ত হন। ইসলামের ইতিহাসে ইনিই মহানবী সঃ এর দাদা আব্দুল মুত্তালিব নামে পরিচিত। এদিকে আব্দুস শামসের উচ্চভিলাষী পুত্র উমাইয়া হাশিম পরিবারের সমস্ত ক্ষমতা হস্তগত করার জন্য তাদের বিরোদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। কিন্তু হাশিম পরিবারের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করে নিজ দেশ হতে বিতাড়িত হন।
হাশিম ও উমাইয়া গোত্রের দ্বন্দ আব্দুল মুত্তালিবের সময় প্রকট আকার ধারণ করে।শত্রুতার রেশ ধরে উমাইয়ার পুত্র হারব মুত্তালিবের বিরোদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। কিন্তু তিনিও তার পিতার ন্যায় পরাজিত ও বিতাড়িত হন। পরবর্তীকালে হাশিম ও উমাইয়া গোত্রের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব ইতিহাসকে বিভিন্ন সময়ে কলঙ্কিত করেছে, সে দ্বন্দের সূত্রপাত হয়েছিল এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে। উল্লেখ্য, এই হারবের পুত্র ছিল বিখ্যাত কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান এবং তার পুত্র ছিলেন মুয়াবিয়া রঃ, যিনি উমাইয়া খেলাফতের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।
যাই হোক, চারিত্রিক গুণাবলি ও অপরিসীম কার্য ক্ষমতা বলে আব্দুল মুত্তালিব ৫৯ বছর বয়স পর্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে মক্কা শাসন করেন। তার সময় ইয়ামেনের বাদশাহ আবারাহা ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের শুরুতে মক্কা আক্রমণ করেন। আব্দুল মুত্তালিবের বার পুত্র এবং ছয় কন্যা ছিল। ইতিহাসে তার দুই পুত্রের নামে কোথাও উল্ল্যেখ নেই। বাকি দশ জন হলো- হারিস, আবু লাহাব, আবু তালেব, আব্বাস, হামজা, যুবায়ের, আবুল উথবা, মহাভিভম, যিযার এবং আব্দুল্লাহ।
উল্লেখ্য, আব্দুল মুত্তালিবের পুত্র আবু লাহাবকে পবিত্র কোরআনে ইসলামের উৎপীড়ক বলা হয়েছে। আর অপর পুত্র আব্বাসের বংশধরেরা পরবর্তীতে আব্বাসীয় বংশ প্রতিষ্ঠা করে। যাই হোক, হস্তী বছরের কিছুকাল পূর্বে আব্দুল মুত্তালিব তার সর্বকনিষ্ঠ পুত্র আব্দুল্লাহর সাথে ইয়াসরিব তথা বর্তমান মদীনার বনি জোহরা গোত্রের নেতা আব্দুল ওহাবের কন্যা আমিনার বিবাহ হয়। এর অল্পদিন পরে আব্দুল্লাহ বাণিজ্য উপলক্ষে সিরিয়ায় গমন করেন এবং ফিরবার সময় অসুস্থ হয়ে মাত্র ২৫ বছর বয়সে মদিনায় ইন্তেকাল করেন। বিবি আমিনা তখন সন্তানসম্ভবা ছিলেন। তখন কেউ কি জানতো!! বিবি আমিনার উদরে থাকা সেই সন্তান হবে বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত, সত্যের বাহক, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব ইসলামের শেষ নবী মহানবী হযরত মুহাম্মদ সঃ।