মানুষ সৃষ্টি বিষয়ে ইসলাম ও বিজ্ঞান

মানুষ সৃষ্টি বিষয়ে ইসলাম ও বিজ্ঞান

পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি পানি থেকে । এই মৌলিক উপাদান পৃথিবীর সব জীবদেহের মধ্যে বিদ্যমান। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর প্রাণবান সমস্ত কিছু সৃষ্টি করলাম পানি থেকে’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত : ৩০)। জীববিজ্ঞানের মতে, সাগরের অভ্যন্তরের পানিতে যে প্রটোপ্লাজম বা জীবনের আদিম মূলীভূত উপাদান রয়েছে তা থেকেই সব জীবের সৃষ্টি। আবার সব জীবদেহ কোষ দ্বারা গঠিত। আর এই কোষ গঠনের মূল উপাদান হচ্ছে পানি।

পৃথিবীর জীবকোষের মূল উপাদান যেমন পানি, তেমনি এই পানিই মাটির উৎপাদন ক্ষমতা লাভের প্রধান উপাদান। মহান আল্লাহ এই ধরণিতে মাটি থেকে একজন প্রতিনিধি সৃষ্টি করেন এবং তারপর তা থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে এই মানবজাতি। মহান আল্লাহর ভাষায়, ‘হে মানবমণ্ডলী! আমি তোমাদের এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। আর তোমাদের বিভিন্ন বংশ ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যেন তোমরা পরস্পরে পরিচিতি লাভ করতে পারো।’ (সুরা হুজুরাত, আয়াত : ১৩)

আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান আবিষ্কার করেছে ‘মানব ক্লোন’। এই ক্লোন পদ্ধতিতে সন্তান জন্ম দিতে গেলে পুরুষের জীবকোষের প্রয়োজন। অর্থাৎ একজন পুরুষের জীবকোষ বা শুক্রাণু ব্যতীত একজন নারী সন্তান জন্মদানে অক্ষম। কেননা নারীর ডিম্বাণু ক্রমোজম (XX) ও পুরুষের শুক্রাণু ক্রমোজম (SY) পুত্র-কন্যা সন্তান গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। এখানে ঈসা (আ.)-এর জন্ম সম্পর্কে প্রশ্ন হতে পারে, কিন্তু মহান আল্লাহ এ প্রশ্নের সমাধান পবিত্র কোরআনে যথাযথভাবে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহর কাছে ঈসার দৃষ্টান্ত হচ্ছে আদমেরই মতো। তাকে মাটি দিয়ে সৃষ্টি করেছিলেন অতঃপর তাকে বলেছিলেন, হয়ে যাও, সঙ্গে সঙ্গে হয়ে গেল।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ৫৯)

মানব সৃষ্টির আদি কথা

আদি পিতা আদম (আ.)-এর সৃষ্টি নিয়ে বিভিন্ন বস্তুবাদী গবেষক, দার্শনিক নানা বক্তব্য-বিবৃতি দিয়েছেন। যেমন—আদি মানব সম্প্রদায় বানর ছিল! কালের আবর্তনে পর্যায়ক্রমে বানর থেকে মানবে রূপান্তরিত হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বর্তমান যুগে কি বিশ্বের কোথাও একটি বানর মানবে রূপান্তরিত হয়ে জীবন যাপন করছে? কিংবা কোনো বানরের গর্ভ থেকে মানব সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে ও বেঁচে আছে? এর জবাব হলো নেতিবাচক। এটা সকলের জানা। আদি মানব কী বস্তু থেকে সৃষ্টি তা মহাগ্রন্থ আল-কোরআনে মহান আল্লাহ স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেন যে ‘কাদামাটি থেকে মানব সৃষ্টির সূচনা।’ (সুরা সাজদাহ, আয়াত : ৭),

অন্য আয়াতে এসেছে, ‘আমি মানবের পচা কাদা থেকে তৈরি বিশুদ্ধ ঠনঠনে মাটি।’ (সুরা হিজর, আয়াত : ২৬)

অন্য আয়াতে এসেছে, ‘পোড়া মাটির মতো শুষ্ক মাটি থেকে (মানুষকে) সৃষ্টি করেছি।’ (সুরা আর-রহমান, আয়াত : ১৪)

আরো ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ তাকে নিজ হাতে সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা সোয়াদ, আয়াত : ৭৫)

আদম (আ.) মাটির সারাংশ থেকে সৃষ্টি। কিন্তু মা হাওয়া (আ.) কী দিয়ে সৃষ্টি—সে সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘অতঃপর তিনি তার (আদম) থেকে তার যুগল (হাওয়াকে) সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা জুমার, আয়াত : ৬)

আরো ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনি তার (আদম) থেকে তার সঙ্গিনীকে সৃষ্টি করেছেন আর বিস্তার করেছেন তাদের দুইজন থেকে অগণিত নারী-পুরুষ।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ১)।

অন্যত্র বলেন, ‘তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সঙ্গিনীকে, তোমাদের জন্যই সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা রুম, আয়াত : ২১)

মহান আল্লাহ আদম (আ.)-এর পাঁজরের বাঁকা হাড় থেকে মা হাওয়াকে সৃষ্টি করেছেন। এ বিষয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘নারী জাতিকে পাঁজরের বাঁকা হাড় দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে। আর পাঁজরের হাড়ের মধ্যে একেবারে ওপরের হাড়টি অধিক বাঁকা। যদি তা সোজা করতে যাও, ভেঙে ফেলবে। আর যদি তা ছেড়ে দাও, তবে সব সময় বাঁকাই থাকবে। সুতরাং তোমরা নারীর সঙ্গে উত্তম ও উপদেশমূলক কথাবার্তা বলবে।’ (বুখারি হাদিস : ৩০৮৫)

পৃথিবীতে প্রথম মানব আদম (আ.) মাটি থেকে এবং প্রথম মানবী হাওয়া (আ.) আদমের পাঁজরের বাঁকা হাড় থেকে সৃষ্টি। এতদ্ব্যতীত সকল মানব-মানবী এক ফোঁটা অপবিত্র তরল পদার্থ (বীর্য) থেকে অদ্যাবধি সৃষ্টি হয়ে চলেছে। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর আমি তোমাদের মাটি থেকে সৃষ্টি করেছি। এরপর বীর্য থেকে, জমাট বাঁধা রক্ত থেকে, এরপর পূর্ণ আকৃতি ও অপূর্ণ আকৃতি বিশিষ্ট গোশতপিণ্ড থেকে, তোমাদের কাছে ব্যক্ত করি।’ (সুরা হজ্জ, আয়াত : ৫)

এভাবে আজও মানব বংশবিস্তার অব্যাহত আছে বিবাহ-বন্ধন ও স্বামী-স্ত্রীর মিলন ব্যবস্থার মাধ্যমে, যাতে মহান আল্লাহর মহৎ উদ্দেশ্য সফল হয়।

 

মানবীয় মর্যাদার বিভিন্ন দিক

মানবীয় মর্যাদার বিভিন্ন দিক আছে। প্রথমত, যে আকার-আকৃতি ও সামঞ্জস্যপূর্ণ শারীরিক কাঠামো মহান আল্লাহ মানুষকে দান করেছেন, তা অন্য কোনো সৃষ্টবস্তুকে দেওয়া হয়নি। দ্বিতীয়ত, যে জ্ঞান মানুষকে দেওয়া হয়েছে, যার দ্বারা তারা নিজেদের জীবন গতিশীল করার জন্য নিত্যনতুন বস্তু আবিষ্কার করেছে, অন্য কোনো সৃষ্টবস্তুকে তা দেওয়া হয়নি। তৃতীয়ত, মানুষকে আসমানি ওহি দেওয়া হয়েছে। এই জ্ঞান দিয়ে তারা কল্যাণ-অকল্যাণ, উপকারী-অপকারী ও ভালো-মন্দের মধ্যে পার্থক্য করতে সক্ষম। চতুর্থত, মানুষকে একধরনের বিশেষ জ্ঞান দেওয়া হয়েছে, যার মাধ্যমে সে আল্লাহর অন্য সৃষ্টবস্তু থেকে উপকৃত হতে ও বশে রাখতে সক্ষম। আল্লাহর কিছু সৃষ্টবস্তু এমন আছে, যেগুলোর শক্তিমত্তার কথা ভেবেও মানুষ কিংকর্তব্যবিমূঢ়। অথচ মহান আল্লাহ সেগুলোও মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন। যেমন—চাঁদ, সূর্য, বাতাস, পানি মানুষের বশে নেই, কিন্তু দিব্যি এগুলো মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত।

মানুষের প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ হলো, তিনি তাকে বিশেষ দেহ-কাঠামো দান করেছেন। সুন্দর চেহারা, সুষম দেহ, উপযুক্ত প্রকৃতি ও অঙ্গসৌষ্ঠব আল্লাহর বিশেষ দান। ইরশাদ হয়েছে, ‘অবশ্যই আমি সৃষ্টি করেছি মানুষকে সুন্দরতম অবয়বে।’ (সুরা ত্বিন, আয়াত : ৪)

মানুষকে দুই পায়ে সম্পূর্ণ সোজা হয়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা দেওয়া হয়েছ। হাত দিয়ে খাওয়ার শক্তি দেওয়া হয়েছে। অন্য প্রাণীরা চার পায়ে হাঁটে। মুখ দিয়ে খায়। মানুষকে যে চোখ, কান ও অন্তর দেওয়া হয়েছে, মানুষ এসব সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারে।

 

গর্ভে সন্তান গঠনের রহস্য

গর্ভে সন্তান গঠনের চক্র সাধারণত দীর্ঘ ২৮০ দিন যাবত চলতে থাকে। যা ৪০ দিন অন্তর সুনির্দিষ্ট সাতটি চক্রে বিভক্ত। নারী-পুরুষের যৌন মিলনের সময় নারীর ডিম্বনালির ফানেলের মতো অংশে ডিম্বাণু নেমে আসে। ওই সময় পুরুষের নিক্ষিপ্ত বীর্যের শুক্রাণু জরায়ু বেয়ে ওপরে উঠে আসে এবং তা ডিম্বনালিতে প্রবেশ করে। প্রথমে একটি শক্তিশালী শুক্রাণু ডিম্বাণুটির দেহে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে তার মধ্যে অন্য কোনো শুক্রাণু প্রবেশ করতে পারে না। এভাবে নারীর ডিম্বাণু নিষিক্ত (Fertilization) হয় এবং নিষিক্ত ডিম্বাণুটি জরায়ুতে নেমে প্রোথিত (Embedded) হয়। (গাইনোকলজি শিক্ষা, পৃষ্ঠা : ২২)

তা ছাড়া নারীর ডিম্বাণুর বহিরাবরণে প্রচুর সিয়ালাইল-লুইস-এক্সসিকোয়েন্স নামের চিনির অণুর আঠালো শিকল শুক্রাণুকে যুক্ত করে পরস্পর মিলিত হয়। আর এই শুক্রাণু দেখতে ঠিক মাথা মোটা ঝুলে থাকা জোঁকের মতো। জোঁক যেমন মানুষের রক্ত চুষে খায়, শুক্রাণু ঠিক তেমনি ডিম্বাণুর মধ্যে প্রবেশ করে মায়ের রক্তে থাকা প্রোটিন চুষে বেড়ে ওঠে। নিষিক্ত ডিম্বাণুটি সন্তান জন্মের রূপ নিলে সাধারণত নিম্নে ২১০ দিন ও ঊর্ধ্বে ২৮০ দিন জরায়ুতে অবস্থান করে। ওই সময়ের মধ্যে ডিম্বাশয়ে নতুন করে কোনো ডিম্বাণু প্রস্তুত হয় না। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমরা মানুষকে মাটির সারাংশ থেকে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর আমরা তাকে শুক্রবিন্দুরূপে এক সংরক্ষিত আধারে (জরায়ুতে) স্থাপন করেছি। এরপর শুক্রবিন্দুকে জমাট রক্তরূপে সৃষ্টি করেছি, অতঃপর জমাট রক্তকে গোশতপিণ্ডে পরিণত করেছি, এরপর গোশতপিণ্ড থেকে অস্থি সৃষ্টি করেছি, অতঃপর অস্থিকে গোশত দ্বারা আবৃত করেছি, অবশেষে তাকে নতুনরূপে করেছি।’ (সুরা মুমিনুন, আয়াত : ১২-১৪)

তিনি আরো বলেন, ‘এক নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত, অতঃপর আমরা একে গঠন করেছি পরিমিতভাবে, আমরা কত সুনিপুণ স্রষ্টা।’ (সুরা মুরসালাত, আয়াত : ২২-২৩)।

আরো ইরশাদ হয়েছে, ‘অতঃপর তিনি তাকে সুষম করেন এবং তাতে রুহ সঞ্চার করেন।’ (সুরা সাজদাহ, আয়াত : ৯)

এখানে মানব সৃষ্টির সাতটি স্তর উল্লেখ করা হয়েছে। স্তরগুলো হলো মাটির সারাংশ, বীর্য, জমাট রক্ত, গোশতপিণ্ড, অস্থি পিঞ্জর, অস্থিতে গোশত দ্বারা আবৃত্তকরণ ও সৃষ্টির পূর্ণত্ব অর্থাৎ রুহ সংহারণ। (তাফসিরে মা’আরেফুল কুরআন, পৃষ্ঠা ৯১৪)

রাসুলুল্লাহ (সা.) মাতৃগর্ভে মানবশিশু জন্মের স্তর সম্পর্কে এভাবে বলেছেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকের সৃষ্টির উপাদান আপন মাতৃগর্ভে বীর্যের আকারে ৪০ দিন, জমাট বাঁধা রক্তে পরিণত হয়ে ৪০ দিন, গোশত আকারে ৪০ দিন। এরপর আল্লাহ একজন ফেরেশতাকে পাঠান এবং চারটি বিষয়ে আদেশ দেন যে, তার (শিশুর) আমল, রিজিক, আয়ুষ্কাল ও ভালো না মন্দ—সব লিপিবদ্ধ করো। অতঃপর তার মধ্যে রুহ ফুঁকে দেওয়া হয়।’ (বুখারি, হাদিস : ২৯৬৮)

অন্যত্র এসেছে, ‘আল্লাহ মাতৃগর্ভে একজন ফেরেশতা মোতায়েন করেন। ফেরেশতা বলেন, হে রব! এখনো তো ভ্রূণ মাত্র। হে রব! এখন জমাট বাঁধা রক্তপিণ্ডে পরিণত হয়েছে। হে রব! এবার গোশতের টুকরায় পরিণত হয়েছে। আল্লাহ যদি তাকে সৃষ্টি করতে চান, তখন ফেরেশতাটি বলেন, হে আমার রব! (সন্তানটি) ছেলে না মেয়ে হবে, পাপী না নেককার, রিজক কী পরিমাণ ও আয়ুষ্কাল কত হবে? অতএব এভাবে তার তাকদির মাতৃগর্ভে লিপিবদ্ধ করে দেওয়া হয়।’ (বুখারি, হাদিস : ৩০৮৭)

নারী ও পুরুষের বীর্যের সংমিশ্রণ ঘুরতে থাকে এবং কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এর চতুর্দিকে একটি আবরণের সৃষ্টি হয়। যাতে করে ভ্রূণটি ধ্বংস হতে না পারে। এরপর আস্তে আস্তে একবিন্দু রক্তকণায় পরিণত হয় এবং সেই রক্তকণা গোশতপিণ্ডে ও অস্থিমজ্জায় পরিণত হয়, এভাবেই সৃষ্টি হয় মানবশিশু। (মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম, বিজ্ঞান না কুরআন, পৃষ্ঠা ১০৯-১১০)

মাতৃগর্ভে শিশুকে সংরক্ষণের জন্য মাতৃজঠরের তিনটি পর্দা বা স্তরের কথা কোরআনে বলা হয়েছে। যথা—পেট বা গর্ভ, রেহেম বা জরায়ু এবং ভ্রূণের আবরণ বা ভ্রূণের ঝিল্লি গর্ভফুল (Placenta)

(বাইবেল, কুরআন ও বিজ্ঞান, পৃষ্ঠা ২৭৭)

এই তিন স্তর সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের সৃষ্টি করেছেন তোমাদের মাতৃগর্ভে—পর্যায়ক্রমে, একের পর এক ত্রিবিধ অন্ধকারে।’ (সুরা জুমার, আয়াত : ৩৯/৬)

আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের আলোকে পবিত্র কোরআনে যে ‘ত্রিবিধ অন্ধকারের’ কথা বলা হয়েছে। এই তিনটি অন্ধকার হলো, ১. রেহেম, ২. মাশীমা বা গর্ভফুল এবং ৩. মায়ের পেট।

রেহেমে রক্তপিণ্ড ছাড়া সন্তানের আকার-আকৃতি কিছুই তৈরি হয় না। আর গর্ভফুল (Placenta) ভ্রূণ বৃদ্ধি, সংরক্ষণ, প্রতিরোধ ইত্যাদি কাজে অন্যতম ভূমিকা রাখে। গর্ভফুল মায়ের শরীর থেকে রক্তের মাধ্যমে নানা পুষ্টি ভ্রূণের দেহে বহন করে, খুব ধীর গতিতে রেচন পদার্থ মায়ের দেহের মাধ্যমে বেরিয়ে যায়। গর্ভফুলের সাহায্যে ভ্রূণ অক্সিজেন (02) গ্রহণ ও কার্বন ডাই-অক্সাইড (CO2) ত্যাগ করে মায়ের ফুসফুসের মাধ্যমে, জীবাণু (Infection) থেকে ভ্রূণকে রক্ষা করে। এ ছাড়া ভ্রূণটি ঠিকমতো জরায়ুতে আটকে রাখা, পুষ্টি সঞ্চয়, সম্পর্ক রক্ষা, হরমোন সৃষ্টি ইত্যাদি কাজে বিশেষ ভূমিকা রাখে। এভাবে ভ্রূণটি জরায়ুতে বেড়ে উঠতে থাকে ও ১২০ দিন অতিবাহিত হলে শিশুর রুহ ফুঁকে দেওয়া হয়। আর শিশু নড়েচড়ে ওঠে ও আঙুল চুষতে থাকে এবং পূর্ণ-পরিণত হওয়ার পরে সেখান থেকে বাইরে ঠেলে দেওয়া হয়। (সুরা আবাসা, আয়াত : ১৮-২০)

পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘ঠেলে দেওয়া হয়।’ অর্থাৎ ২১০ দিন পর একটি শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার উপযুক্ত হয়। আর সন্তানটির যখন ভূমিষ্ঠ হওয়ার উপযুক্ত সময় হয়ে যায়, তখন Overy-Placenta থেকে একধরনের গ্রন্থিরস নিঃসৃত হয়, যা প্রসব পথ পিচ্ছিল ও জরায়ুর মুখ ঢিলা করে দেয়। আর মানব সন্তান ওই সময় বিভিন্নভাবে নড়াচড়া করতে থাকে এবং প্রসব পথ পিচ্ছিল থাকায় বাচ্চা অনায়াসে বেরিয়ে আসে। সবচেয়ে মজার কথা হলো মানবশিশুর যে অঙ্গ সর্বপ্রথম গঠিত হয় তা হলো কর্ণ। আর সন্তান গর্ভে ধারণের ২১০ দিন পর চক্ষু গঠিত হয় এবং একটি পূর্ণাঙ্গ মানবশিশুতে পরিণত হয়।

পুত্র-কন্যাসন্তান সৃষ্টির রহস্য

মহান আল্লাহ বলেন, ‘নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের রাজত্ব আল্লাহরই। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন, যাকে ইচ্ছা কন্যা এবং যাকে ইচ্ছা পুত্রসন্তান দান করেন। অথবা তাদের পুত্র-কন্যা উভয় দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করে দেন। নিশ্চয়ই তিনি সর্বজ্ঞ, ক্ষমতাশীল।’ (সুরা শুরা, আয়াত : ৪৯-৫০)

এ বিষয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘পুরুষের বীর্য স্ত্রীর বীর্যের ওপর প্রাধান্য লাভ করলে পুত্রসন্তান জন্ম নেয়। আবার স্ত্রীর বীর্য পুরুষের বীর্যের ওপর প্রাধান্য লাভ করলে কন্যাসন্তান জন্ম নেয়।’ (মুসলিম, মিশকাত, হাদিস : ৪৩৪)

আধুনিক স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের মতে, জরায়ুতে যদি কন্যা ভ্রূণ সৃষ্টি হয়, তাহলে করটিকস কম্পোন্যান্টগুলো (Cortics Componant) বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে থাকে এবং মেডুলার কম্পোন্যান্টগুলো (Medullar Componant) কমতে থাকে। পক্ষান্তরে জরায়ুতে যদি পুত্র ভ্রূণ সৃষ্টি হয়, তাহলে করটিকস কম্পোন্যান্টগুলো (Cortics Componant) কমতে থাকে এবং মেডুলার কম্পোন্যান্টগুলো (Medullar Componant) বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে থাকে। তা ছাড়া মানুষের প্রতিটি দেহকোষে মোট ২৩ জোড়া ক্রমোজম থাকে। তন্মধ্যে ২২ ঝোড়া অটোজম এবং এক জোড়া সেক্স (Sex) ক্রমোজম। নারীর ডিম্বাণুতে XX ক্রমোজোম এবং পুরুষের শুক্রাণুতে XY ক্রমোজম থাকে। সুতরাং নারীর ডিম্বাণুর X ক্রমোজমকে যদি পুরুষের শুক্রাণুর X ক্রমোজম নিষিক্ত করে, তবে জাইগোটের ক্রমোজম হবে XX এবং কন্যাসন্তানের জন্ম হবে। পক্ষান্তরে নারীর ডিম্বাণুর X ক্রমোজমকে যদি পুরুষের শুক্রাণুর Y ক্রমোজম নিষিক্ত করে, তবে জাইগোটের ক্রমোজম হবে XY এবং পুত্রসন্তান জন্ম হবে। [মাধ্যমিক সাধারণ বিজ্ঞান, জীবকোষের গঠন ও প্রকৃতি অধ্যায়, (ঢাকা : নব পুথিঘর প্রকাশনী), পৃষ্ঠা : ১৬১]

মোদ্দাকথা, যখন ডিম্বাণুর ও শুক্রাণুর জাইগোটের ক্রমোজম একই গোত্রীয় (XX) হয়, তখন কন্যাসন্তান এবং যখন ডিম্বাণুর ও শুক্রাণুর জাইগোটের ক্রমোজম একই গোত্রীয় (XY) না হয়, তখন পুত্রসন্তান জন্ম নেয়। [J.N. Ghoshal, Anatomy Physiology, (Calcata print) P. 479]

অতএব সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণ নির্ভর করে পুরুষের দেহে উৎপন্ন শুক্রাণুর ওপর। আর যমজ সন্তান জন্মদানের জন্য সবচেয়ে বেশি ভূমিকা স্ত্রীর।  আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের মতে, নারীর ডিম্বাশয় থেকে যখন একটি ডিম্বাণু জরায়ুতে নেমে আসে, তখন একটি শক্তিশালী শুক্রাণু তাতে প্রবেশ করে একটি সন্তানের জন্ম হয়। কিন্তু যদি দুটি ডিম্বাণু জরায়ুতে নেমে আসে, তখন দুটি শক্তিশালী শুক্রাণু তাতে আলাদা আলাদা প্রবেশ করে। ফলে যমজ সন্তানের জন্ম হয়। (গাইনোকলজি শিক্ষা, পৃষ্ঠা ১৫)

আবার সন্তানের আকৃতি সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘পুরুষ যখন স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করে তখন যদি পুরুষের বীর্য প্রথমে স্থলিত হয়, তাহলে সন্তান পিতার আকৃতি পায়। পক্ষান্তরে যদি স্ত্রীর বীর্য প্রথমে স্থলিত হয়, তাহলে সন্তান মায়ের আকৃতি লাভ করে।’ (বুখারি, হাদিস : ৩০৮৩)

পরিমার্জন ও পুনর্বিন্যাস : মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহ

(সোর্সঃ  কালেরকণ্ঠ)

InfotakeBD

View posts by InfotakeBD
InfotakeBD is a information sharing blog, We share information for you. Please visit us and if you want to contribute for this blog please email us infotakebd@gmail.com. Thank you

Leave a Reply

Scroll to top
error: Content is protected !!