জলবায়ু বদলজনিত স্বাস্থ্য সমস্যা ও বাংলাদেশ

দুনিয়াব্যাপী বৃদ্ধি পাচ্ছে তাপমাত্রা, বদলে যাচ্ছে পরিবেশ। জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের মত দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলো সব চাইতে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত স্বাস্থ্য সমস্যা এই দেশগুলোর জন্য বড় চিন্তার বিষয়। বিশ্বখ্যাত স্বাস্থ্য সাময়িকী ‘ল্যান্সেট’ এর মতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারনে বিশ্বব্যাপী দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সব চাইতে বেশি ক্ষতির শিকার হতে হবে।

জলবায়ুজনিত স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো সম্পর্কে না জানা এবং এ সম্পর্কিত রোগ-বালাইসমূহ আপাত দৃশ্যমান না হওয়ায় বেশিরভাগ মানুষ এ বিষয়ে তেমন সচেতন নয়। ফলে প্রাথমিকভাবে দরিদ্র ও সাধারণ জনগোষ্ঠীই সব চাইতে বেশি হুমকির সম্মুখীন।

সদ্যসমাপ্ত আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলনের ঘোষণা অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছয় নম্বরে। গবেষকদের দাবী, বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ৩৬ মিলিয়ন জনগোষ্ঠী সব চাইতে অরক্ষিত ও বিপদজনক অবস্থায় রয়েছে।

সাধারণত ধারণা করা হয় উপকূলীয় অঞ্চল বা গ্রামীণ অধিবাসীরাই জলবায়ুজনিত স্বাস্থ্য সমস্যার জন্য সব চাইতে ঝুঁকিপূর্ণ। তবে গবেষকদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে শহুরে জনগণের সুস্থতাও সমানভাবে অরক্ষিত হচ্ছে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়াতে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। ডুবে যাচ্ছে উপকূলীয় অঞ্চল। ফলে আশ্রয়হীন মানুষ পাড়ি জমাচ্ছে শহরে। শহরের দারিদ্র্যপীড়িত এলাকাগুলোতে তাদের আধিক্য বাড়ায় স্বাস্থ্য সমস্যাও বাড়ছে। ঘনবসতি, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, বিশুদ্ধ পানির অভাব এবং দুর্বল পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা এই স্বাস্থ্যহানির প্রধান কারন। এতে করে শহর এলাকায় ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড, কলেরা ও ডায়রিয়ার মত রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে।

উপকূলীয় অঞ্চলে পানির লবনাক্ততা বৃদ্ধিও বিভিন্ন ধরনের প্রাণঘাতি স্বাস্থ্য সমস্যার প্রকোপ বাড়াচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, পানিতে লবনাক্ততা বাড়ায় খাবারের মাধ্যমে লবন গ্রহণের পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় বাড়ছে। ফলে ঐসব অঞ্চলে উচ্চরক্তচাপ ও এ সম্পর্কিত জটিলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। লবনাক্ত পানি গর্ভবতী মায়ের স্বাস্থ্যের জন্যও বড় হুমকি। সাম্প্রতিক সময়ে উপকূলীয় এলাকাগুলোতে নবজাতকের মৃত্যুহার বৃদ্ধি ও প্রসবজনিত জটিলতার জন্য খাবার ও পানিতে লবনের বৃদ্ধিকেই দায়ী করা হচ্ছে।

লবনাক্ততা বাড়ার কারনে কৃষিজমির উর্বরতাও হ্রাস পাচ্ছে। কমে যাচ্ছে ফলন। উৎপাদিত ফসলে কাঙ্খিত পুষ্টিগুণও ঠিকমত পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া জলবায়ু বদলের কারনে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরিমাণ বাড়ছে। এসব দুর্যোগের কারনেও ফলন কমছে। অনেক ক্ষেত্রে পরিবর্তিত পরিবেশের প্রভাবে ফসলে মড়ক লাগছে। ফলে পুষ্টিহীনতার ঝুঁকি বাড়ছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ভাত ও গমের তৈরী খাদ্য সামগ্রীর মাধ্যমে জনগোষ্ঠীর শতকরা ৭৫ ভাগ জিংক ও আয়রনের চাহিদা পূরণ হয়। কিন্তু জলবায়ু বদলজনিত কারনে উৎপাদিত খাদ্যশস্যে জিংকের পরিমাণ ৯ ভাগ ও আয়রনের পরিমাণ ৫ ভাগ পর্যন্ত হ্রাস পেতে পারে। জিংক ও আয়রনের ঘাটতি নারীদের বিশেষ করে গর্ভবতী মায়েদের জন্য বিপদজনক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। এমনিতেই বাংলাদেশে নারীদের আয়রনের অভাবজনিত রক্তশূন্যতার প্রকোপ অনেক বেশি। খাদ্যশস্য পুষ্টিগুণ হারালে এটা আরো মারাত্মক আকার ধারণ করবে এবং মাতৃমৃত্যুর হার বাড়বে। নবজাতক এবং শিশুদের উপরও এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। মনে রাখতে হবে, গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে অপুষ্টির হার কমলেও এখনো দেশের ৪১ শতাংশেরও বেশি শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে।

অপুষ্টি বলতে শুধু পুষ্টিহীনতাকেই বুঝায় না। ‘অতিরিক্ত পুষ্টি’ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত খাদ্যশস্যের সংকট মানুষকে সহজলভ্য, প্রক্রিয়াজাতকৃত ও সস্তা খাদ্য সামগ্রী গ্রহণে বাধ্য করছে। এসব খাদ্য সামগ্রীতে সাধারণত অত্যাবশ্যক খাদ্য উপাদানসমূহের ঘাটতি থেকে যায়। কিন্তু লবন ও চর্বি জাতীয় খাদ্য উপাদানের আধিক্য থাকে। যা ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদপিণ্ডের বিভিন্ন সমস্যার জন্য দায়ী। এই রোগগুলোই হাল আমলে সারা দুনিয়ায় মৃত্যু ও অক্ষমতার প্রধান কারন হিসাবে বিবেচিত। বাংলাদেশেও ৩৪ শতাংশ মৃত্যুর কারন এই রোগগুলো। জলবায়ু বদলের কারনে এই রোগগুলোর প্রকোপ আরো বাড়ছে এবং বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর ঝুঁকিও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারনেও নতুন নতুন রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। বিভিন্ন ভাইরাসজনিত সংক্রামক রোগ ছাড়াও আর্সেনিক সংক্রমণসহ নানা ধরনের চর্ম রোগের প্রকোপ বাড়ছে। বিশেষ করে শহর এলাকার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোতে বিভিন্ন ধরনের চর্ম রোগের আধিক্য দেখা যাচ্ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারনে পানিশূন্যতা, ডায়রিয়া ও কলেরার মাত্রাও বাড়ছে। শিশুদের ক্ষেত্রে মাত্রাটা বেশি। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, শৈশবে দীর্ঘস্থায়ী ডায়রিয়ায় ভুগলে পরবর্তী জীবনে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও অত্যাবশ্যকীয় খাদ্য উপাদান হজমের সক্ষমতা অনেকটাই কমে যায়। এটা স্বাস্থ্যকর জাতি গঠনে বড় অন্তরায়।

জলবায়ুজনিত রোগের প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী ও কিছু কিছু ক্ষেত্রে মরণঘাতী। জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের জিডিপির ৩.৪ শতাংশ জলবায়ু বদলজনিত স্বাস্থ্য সমস্যা মোকাবেলায় ব্যয় হবে। সন্দেহ নাই, বাংলাদেশের মত স্বল্প আয়ের দেশের জন্য এটা একটা বড় বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। তাই এখন থেকেই এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে ২০০৯ সালেই জলবায়ু পরিবর্তনজনিত স্বাস্থ্য সমস্যা মোকাবেলার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যেই স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের অধীনে ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ ও হেলথ প্রমোশন ইউনিট’ গঠন করা হয়েছে। তবে শুধু পদক্ষেপ নিলেই হবে না, জনগণের স্বার্থে এগুলোর কার্যকারিতাও নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি উদ্ভূত সমস্যা মোকাবেলায় গবেষণা কার্যক্রম বৃদ্ধি এবং জনসচেতনতা তৈরীর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তবেই হয়ত পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য পৃথিবী রেখে যাওয়া সম্ভব হবে।

InfotakeBD

View posts by InfotakeBD
InfotakeBD is a information sharing blog, We share information for you. Please visit us and if you want to contribute for this blog please email us infotakebd@gmail.com. Thank you

Leave a Reply

Scroll to top