ব্রণ বা বয়:ব্রণ
সাধারণত বিভিন্ন বয়সে ও সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত তরুণীদের দু’গালে কপালে নাকে ও চিবুকে কখনো দু’চারটে কখনো বা খুব বেশি ফোলা ফোলা ঈষৎ লাল আভা-যুক্ত ফুসকুড়ি অনেকটা অংশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। সময়ে সময়ে এসব ফুসকুড়িতে অল্প পুঁজও জমে। মুখমন্ডলের ত্বকে এ জাতয়ি ব্রণ সবচেয়ে বেশি সমস্যার সৃষ্টি করে। তাই প্রথম থেকেই বিশেষ সতর্কতা নিয়ে এগুলো সারিয়ে ফেলা উচিত। বেশি অবহেলার ফলে এই জাতীয় ব্রণ ত্বকের কেন্দ্রীয় স্তবকের ওপর বরাবরের জন্য ক্ষতচিহ্নের সৃষ্টি করতে পারে। ফলে আপনার সজীব প্রাণবন্ত ত্বকের ওপর কতগুলো ক্ষতচিহ্ন বয়ে বেড়াতে হবে সারা জীবন ধরে।
যৌন গ্রন্থির নিঃসৃত হরমোনই ব্রণ হবার মূল কারণ হিসেবে ধরা হয়। যারা অল্প বয়স্কা তরুণী, তাদের উচিত ব্রণ দেখা দেবার সাথে সাথে চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়া ও তার কথামত ব্রণের উপযোগী ঔষুধপত্র, সাবান ও ক্রিম বা লোশন ব্যবহার করে সঠিক পরিচর্যা শুরু করা। নিচে পরিচর্যার কাজ বিশদভাবে দেয়া হলঃ
১. প্রতিদিন ৪ বার ঔষুধযুক্ত সাবান বা শিশু উপযোগী সাবান ব্যবহার করে মুখমন্ডলের ত্বক ঠান্ডা পানিতে ধুয়ে নেবেন। ব্রণ থাকাকালীন অন্য কোনো রকম গায়ে-মাখা সাবান ব্যবহার করবেন না।
২. প্রতিদিন সকালে সাবান দিয়ে মুখমন্ডল পরিষ্কার করার পর ফুটন্ত গরম পানিতে কিছু তুলসী পাতা ছেঁচে ফেলে দিয়ে মুখমন্ডলে ভাপ নেবেন। ভাপ নেয়া হয়ে গেলে বরফ পানির ঝাপটা দিয়ে বড় হয়ে যাওয়া লোমকূপ সংকুচিত করে নিন।
৩. প্রতিদিন রাতে ঘুমোতে যাবার আগে মুখমন্ডলের ত্বক ঠান্ডা পানিতে ধুয়ে নিন ও এর দশ মিনিট পরে চিকিৎসকের নির্দেশমত ব্রণের জন্য নির্দিষ্ট ওষুধযুক্ত ক্রিম বা লোশন পরিষ্কার স্টেরিলাইজড তুলোর সাহায্যে বুলিয়ে লাগান।
৪. কখনো হাত বা অন্য কিছুর সাহায্যে ব্রণ খুঁটতে বা ব্রণের ভেতরের শক্ত সাদা পদার্থ বের করতে যাবেন না। খোঁটাখুঁটির ফলে ব্রণ সংক্রমিত হয়ে বিষিয়ে গিয়ে ফল মারাত্মক হতে পারে।
৫. ব্রণ থাকাকালীন মুখমন্ডলের ত্বকে কোনো তৈলাক্ত পদার্থ ও ক্রিম লাগাবেন না। শুধু ব্রণের পক্ষে উপকারী এমন ক্রিম বা লোশন ব্যবহার করবেন। এক্ষেত্রে ভালো ব্র্যান্ডের ক্রিম বা লোশন ব্যবহার করা উচিত ও ব্যবহার করার পূর্বে প্রস্তুতকারকের তরফে দেয়া ব্যবহার নির্দেশাবলী ভাল করে পড়ে নেবেন।
৬. খাদ্য তালিকা থেকে শাক, ডাটা, বাদাম, কাঁচা লবন, সামুদ্রিক মাছ ইত্যাদি আয়োডিনযুক্ত খাবার বাদ দিবেন। এছাড়া চর্বিজাতীয় খাবার ও ভাজা-পোড়া বাদ দেবেন। এ সময় স্বাদু পানির মাছ, চর্বিহীন মাংস, সরতোলা দুধ, টাটকা ফলের রস, মধু ইত্যাদি খাবেন। প্রতিদিন ৬-৭ গ্লাস পানি খাবেন। যদি বুঝতে পারেন যে, কোনো বিশেষ খাবার খেলে ব্রণের উৎপাত বাড়ছে, সেটি অবশ্যই বাদ দিবেন।
৭. দুশ্চিন্তা ব্রণের পক্ষে ক্ষতিকারক। যথাসম্ভব প্রফুল্ল ও হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করবেন।
৮. অনেক সময় মাথায় খুস্কি থাকলে মুখমন্ডলের ত্বকে ব্রণ দেখা দেয়। সেক্ষেত্রে সপ্তাহে দুবার ভালো ব্র্যান্ডের খুস্কির জন্য বিশেষভাবে তৈরি শ্যাম্পু দিয়ে মাথা পরিষ্কার করবেন।
৯. জন্ম নিয়ন্ত্রণের বড়ি, শরীরের ওজন কমাবার জন্য ডায়েট বড়ি ও কাশির বিভিন্ন ধরনের ওষুধের অতি ব্যবহারের ফলেও অনেক সময় বয়স্কা মহিলাদের মুখমন্ডলের ত্বকে ব্রণ দেখা দেয়। এ ধরনের কোনো কিছু খাবার ফলে ব্রণ হচ্ছে মনে হলে অবশ্যই আপনার চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করে তার পরামর্শমত চলবেন।
১০. এ সময় যতটা সম্ভব আলো-বাতাস ত্বকে লাগাবেন।
ব্ল্যাকহেড
লোমকূপের গোড়ায় আলপিনের ডগার আকারে কাল কাল বিন্দুর মত ব্ল্যাকহেড দেখা যায়। তৈলগ্রন্থি হতে নিঃসৃত বাড়তি তেল বাতাসে অক্সিজেনের সংস্পর্শে এসেই জারিত হয় এবং লোমকূপের গোড়ায় কাল কাল বিন্দুর মত জমে থাকে। মুখমন্ডলের ত্বক ছাড়াও শরীরের অন্যান্য অংশের ত্বকেও এমন হতে পারে। ব্ল্যাকহেড সংক্রমিত হয়ে ব্রণে পরিণত হতে পারে। নিয়মিত পরিচর্যার ফলে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ব্ল্যাকহেড দূর করা যায়। নিচে ব্ল্যাকহেডের পরিচর্যা বিশদভাবে দেয়া হলঃ
১. গরম পানির ভাপ নিন পাঁচ মিনিট। এর ফলে লোমকূপের ছিদ্র বড় হয়ে যাবে। এক কাপ গরম পানিতে এক চামচ খাবার সোডা অর্থাৎ সোডিয়াম বাই-কার্বনেট মিশিয়ে গরম ছেঁক নিন দুই মিনিট। এখন দেখবেন ব্ল্যাকহেডগুলো অনেক স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
২. এবার কটন বাড বা অরেঞ্জ স্টিকের মাথায় স্টেরিলাইজড তুলো জড়িয়ে তার সাহায্যে ব্ল্যাকহেডের চারপাশে চাপ দিলেই দেখবেন লোমকূপের গোড়া থেকে ব্ল্যাকহেড উঠে আসছে। তখন তুলো জড়ানো কাঠি দিয়ে ঠেলে সেটাকে সরিয়ে দিবেন।
৩. ত্বকের একই জায়গায় অনেকগুলো ব্ল্যাকহেড থাকলে একবারে সবগুলো তুলতে যাবেন না। একদিন অন্তর তোলার কাজ করবেন।
৪. ব্রণের মুখে যদি ব্ল্যাকহেড দেখা দেয় তবে নিজে তোলার কাজ করবেন না। বরং কোনো বিউটি ক্লিনিকে গিয়ে পেশাদারী হাতে তুলিয়ে নিবেন।
৫. ব্ল্যাকহেড পরিষ্কার করার পরেই অ্যালকোহল (সার্জিক্যাল স্পিরিট)স্টেরিলাইজড তুলোতে ভিজিয়ে যেখানে ব্ল্যাকহেড তোলার কাজ করছেন, সেখানে বুলিয়ে নেবেন। একটু পরে তুলোর সাহায্যে অ্যাস্ট্রিনজেন্ট লোশন ত্বকে লাগিয়ে বড় হয়ে যাওয়া রোমরন্ধ্র সংকুচিত করে নেবেন।
হোয়াইটহেড
ত্বকের নিচে মোমের মত সাদা সাদা অংশ (শক্ত চর্বিকলার জন্য এমন দেখায়) তৈলগ্রন্থির ঠিক মুখে জমে থাকে। ত্বকের ঠিক নিচেই সাদা চর্বিপূর্ণ পদার্থটি থাকে। ফলে ফুটো করে বের করে দেবার পথ না করে দিলে এগুলো জমেই থাকে। নিজে হোয়াইটহেডের পরিচর্যার কাজ করতে যাবেন না। কোনো চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে যোগাযোগ করে এগুলো সারিয়ে নিবেন। কখনো নিজে থেকে খুঁটাখুঁটি করতে যাবেন না। এতে জায়গাটা বিষিয়ে যেতে পারে।
তিল
বর্ণকোষের গঠনের পরিবর্তনের ফলে দেহের নানা অংশে অনেক সময় কালো, লাল বা ঘন নীল রঙ্গের আলপিনের মাথার মাপে বিন্দু দেখা যায়। এগুলো হচ্ছে তিল। সাধারণত রোদের তাপ বা বংশগতির কারণে এসব হয়। তিল ত্বকের কোনো ক্ষতি করে না। কিন্তু আকারে বেড়ে গেলে বা খসখসে তিল থাকলে মেকআপের সাহায্যে ঢেকে ফেলা সম্ভব। অনেকের চিবুকে তিলের অবস্থান বিউটি স্পট হিসেবে সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। শরীরে খুব বেশি সংখ্যক তিল থাকলে অস্ত্রোপাচারের সাহায্যে সরিয়ে ফেলা সম্ভব। এছাড়া প্রাকৃতিক উপাদানের সাহায্যে নিচের পদ্ধতি অনুসরণ করে সুফল পেতে পারেনঃ
১. এক চামচ মুলো বাটা, অর্ধ চামচ মাখণ তোলা দুধ বা অর্ধ চামচ পাকা পাতিলেবুর রস ভালভাবে মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করে নিন। প্রতিদিন গোসলের এক ঘন্টা পূর্বে তিলের ওপর ফোঁটা ফোঁটা পেস্ট লাগান। গোসল করার সময় ধুয়ে ফেলুন।
২. রাতে অর্ধকাপ দুধে ৫ ফোঁটা পাতিলেবুর রস ফেলে ঢেকে রেখে দিন। সকালে গোসলের এক ঘন্টা পূর্বে টকে-যাওয়া দুধের সাথে এক চামুচ মুলো বাটা, এক চামুচ গুঁড়ো ওট-মিল ভালভাবে মিশিয়ে নিন। গোসলের আধঘন্টা পূর্বে ছোট তুলোর প্যাড মিশ্রণে ভিজিয়ে তিলের ওপর লাগিয়ে রাখুন। গোসল করার সময় তুলোর প্যাড সরিয়ে দেবেন।
মেচেতা বা ছুলি
শরীরের নানা অংশে, বিশেষ করে মুখমন্ডলে হালকা হলদে বা কালচে রঙ্গের ছোট মটরদানার মাপে দাগ পড়ে। হলদে রঙ্গের দাগকে ছুলি ও কালচে রঙ্গের দাগকে মেচেতা বলে। এ ধরণের দাগে কোনো জ্বালা যন্ত্রণা থাকে না। কিন্তু ফর্সা ত্বকের ক্ষেত্রে মেচেতা ও উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের ত্বকের ক্ষেত্রে ছুলি সৌন্দর্যহানির মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অনেক সময় প্রচন্ড তাপে ছুলি বা মেচেতা হতে পারে। যাদের ছুলি আছে, তারা গোসলের পর পাতিলেবুর রস লাগিয়ে সুফল পেতে পারেন।
এছাড়া ছুলির জন্য ১ চা-চামচ হাইপোফসফেট অফ সোডা (সোডিয়াম থায়োসালফেট, যে কোনো ফটোগ্রাফারের দোকানে পাওয়া যায়) ১০০ মি.লি. ডিস্টিল্ড ওয়াটারের সাতে মেশান। পর পর ৮-১০ দিন দুই বেলা ত্বক ভালভাবে ধুয়ে শুধু যেখানে ছুলি হয়েছে সেখানে এই মিশ্রণ লাগান। কুড়ি মিনিট পর ঠান্ডা পানিতে ত্বক ধুয়ে ফেলবেন। চোখের আশেপাশে কখনো লাগাতে যাবেন না। এ মিশ্রণ লাগিয়ে কোনো রকম অস্বস্তি হলে সাথে সাথে ঠান্ডা পানিতে ত্বক ধুয়ে ফেলবেন এবং আর কখনো ব্যবহার করবেন না।
মেচেতার জন্য ১ চামচ কাঁচা গরুর দুধ ও ১ চামচ কাঁচা হলুদ বাটা ভালভাবে মিশিয়ে তুলোর সাহায্যে পর পর ৮-১০ দিন লাগান দিনে ২ বার করে। হলুদ বাটা ও দুধের মিশ্রণ প্রতিবার নতুন করে তৈরি করে ব্যবহার করবেন। ২০ মিনিটি মিশ্রণ লাগিয়ে রাখবেন।
ঘামাচি
সাধারণত গরমকালে অনেকেই ঘাড়ে, কপালে ও পিঠে ঘামাচির আক্রমণে বিব্রত বোধ করেন। ঘামাচি শুধু অস্বস্তিকরই নয়, ঘামাচি ত্বকের মসৃণতা ও উজ্জ্বলতা নষ্ট করে দেয়। তাই উচিত উপযুক্ত পরিচর্যা করে সম্পূর্ণভাবে ঘামাচি নির্মূল করা। সামান্য গরম পড়লেই যাদের ঘামাচি শুরু হয়, তারা গরম পড়তে শুরু করলেই নিচের মত পরিচর্যার কাজ শুরু করবেন।
১. প্রতিদিন দুবার ওডিকোলন সাবান দিয়ে ঠান্ডা পানিতে গোসল করবেন।
২. প্রতিবার গোসলের পর অন্তর্বাস পাল্টে নিবেন।
৩. গোসলের পর ভালো ব্র্যান্ডের প্রিকলি-হিট পাউডার ব্যবহার করবেন।
৪. মাঝে মাঝে ঠান্ডা পানির ঝাপটা দিয়ে মুখমন্ডল ধুয়ে ফেলবেন।
৫. এ সময় রোজ প্রচুর পরিমানে পানি ও টাটকা ফলের রস খাবেন।