টিনিয়াসিস রোগটি সারা বিশ্বেই কমবেশী দেখা যায়। আমাদের দেশে এই রোগ ফিতা কৃমি নামে পরিচিত। এই রোগের কারণ কিন্তু পরজীবী। সাধারণত ২ ধরনের পরজীবী দিয়ে টিনিয়াসিস হয়। এদের নাম হচ্ছে ‘টিনিয়া সোলিয়াম’ এবং টিনিয়া স্যাজিনেটা’। শুকর বহন করে’ টিনিয়া সোলিয়াম’ আর গরু বহন করে’ টিনিয়া স্যাজিনেটা’। এ দুটি পরজীবী দেখতে একই রকম এবং জীবনচক্রও প্রায় একই ধরনের। টিনিয়া সোলিয়াম বেশী দেখা যায় মধ্য ইউরোপ, দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা এবং এশিয়ার কিছু অংশে। আর টিনিয়া স্যাজিনেটা বেশী দেখা যায় দক্ষিণ এশিয়া, ভূমধ্যসাগরীয় দেশসমূহ এবং সাহারা মরুভূমির দক্ষিণের দেশসমূহে। মুসলিম দেশসমূহ টিনিয়া সোলিয়াম তেমন দেখা যায়না কারণ মুসলিমরা শুকরের মাংস খায়না।
কিভাবে ছড়ায়:
টিনিয়া পরজীবীর দেহ খন্ডায়িত। প্রতিটি খন্ড ডিম তৈরী করে। এসব ডিম পায়খানার সাথে বের হয়ে পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে। টিনিয়াসিস হবার প্রধান কারন অসিদ্ধ বা অর্ধসিদ্ধ গরু বা শুকরের মাংস ভক্ষণ। শিককাবাব বা বিভিন্ন ধরনের মাংসের চাপের মধ্যেও এসব পরজীবী থাকতে পারে। গরু বা শুকরের মাংসে কৃমির বাচ্চা বা লার্ভা থাকে। ভালভাবে সিদ্ধ না করলে লার্ভা মরেনা। কেউ যদি অসিদ্ধ বা অর্ধসিদ্ধ মাংস গ্রহণ করে তবে লার্ভা অন্ত্রে চলে যায়। সেখানে তা পূর্ণ কৃমিতে পরিণত হয়।
মানুষের পায়খানার সাথে কৃমির ডিম বাইরে আসে। তারপর পরিবেশে ছড়ায়। গরু বা শুকর যখন ডিমটি গ্রহণ করে তখন সেটি তাদের অন্ত্রে চলে যায়। ডিম থেকে এরপর লার্ভা বের হয় এবং অন্ত্রের দেয়াল ভেদ করে রক্ত অথবা লসিকানালী দিয়ে মাংসপেশীতে চলে যায়। কোন মানুষ এখন যদি সেই মাংস ভালভাবে সিদ্ধ না করে খায় তখন টিনিয়াসিসে আক্রান্ত হয়।
লক্ষণ:
টিনিয়াসিসে আক্রান্ত হলে তেমন কোন উপসর্গ থাকেনা। এরা নীরবে ক্ষতি করে। কেউ কেউ পেটে অস্বস্তি বা ব্যথার কথা বলেন। অনেকের দীর্ঘকালীন বদহজম দেখা যেতে পারে। অনেক সময় পায়খানার সাথে কৃমির অংশ যায় যা দেখে অনেকে টিনিয়ার অস্তিত্ব ধরতে পারেন। আমাদের শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টিতে এরা ভাগ বসায় এবং দীর্ঘদিন শরীরে থেকে আমাদের অনেক ক্ষতি করে। শিশুদের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কে মারাত্মক সংক্রমন হতে পারে।
রোগ নির্ণয়:
টিনিয়াসিস রোগ নির্ণয় করা সহজ। পায়খানা পরীক্ষা করলে টিনিয়া সোলিয়াম বা টিনিয়া স্যাজিনেটার ডিম পাওয়া যায়। অনেক সময় সেগমেন্ট বা খন্ডও দেখা যায়। রক্ত পরীক্ষা করলে রক্তের ইওসিনোফিল বেশি পাওয়া যায়। কিছু ক্ষেত্রে কৃমি থেকে সিস্ট হয়ে ক্যালসিফাইড হয়ে যায়। তখন এক্সরে বা সিটি স্ক্যানের প্রয়োজন হতে পারে। তবে সাধারণত এসব পরীক্ষার দরকার পড়েনা।
চিকিৎসা:
টিনিয়াসিসের ভালো চিকিৎসা আছে। প্রাজিকুয়ান্টাল নামের একটি ওষুধ অসুখে ভাল কাজ করে। এছাড়া এলবেনডাজল এবং নিক্লোসোমাইড ইত্যাদি ওষুধও ব্যবহার করা হয়। কার জন্য কোন ওষুধ উপযুক্ত তা একজন চিকিৎসকই ঠিক করবেন। ব্রেন বা মস্তিস্কে সংক্রমন হলে খিঁচুনি দূর করার জন্য ওষুধ দেয়া হয়। অনেক সময় টিনিয়াসিস থেকে হাইড্রোকেফালাস দেখা যায়। সেক্ষেত্রে সার্জারি বা শল্য চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। তবে খুব কম ক্ষেত্রেই এমনটি হয়।
টিনিয়াসিসের চিকিৎসা না করলে জটিলতা হতে পারে। মস্তিষ্ক, চোখ বা হৃদপিণ্ডে গিয়ে কৃমি ঝমেলা সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়া অন্ত্রে প্রতিবন্ধকতাও হতে পারে।
প্রতিরোধ:
১. টিনিয়াসিস সহজেই প্রতিরোধ করা যায়। টিনিয়াসিস বা ফিতা কৃমি প্রতিরোধে সবারই উচিত ছয় মাস পরপর কৃমির ওষুধ খাওয়া। না হলে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে।
২. আক্রান্ত ব্যক্তির দ্রুত রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা করতে হবে। তাহলে সে ব্যক্তি আর অসুখটি ছড়াতে পারবেনা।
৩. মাংস রান্নার সময় ভালভাবে সিদ্ধ করতে হবে।
৪. অসিদ্ধ বা অর্ধসিদ্ধ মাংস খাওয়া থেকে সাবধান থাকতে হবে। রাস্তাঘাটে মাংস খাবার ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে।
৫. খাবার আগে ভালভাবে হাত ধুয়ে নিতে হবে।
৬. স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটারি ল্যাট্রিন ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। স্যানিটারি ল্যাট্রিন ব্যবহার করলে পরিবেশে সহজে কৃমির ডিম ছড়াতে পারেনা।
৭. সর্বোপরি জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন করে অনেকটাই টিনিয়াসিস প্রতিরোধ করা যায়।