লিভার বা যকৃতের বিভিন্ন অসুখের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যে রোগটি হয় তা জন্ডিস নামে পরিচিত। জন্ডিস আসলে কোনো রোগ নয়। এটি রোগের লক্ষণ। অনেকেই জন্ডিসকে রোগ ভাবেন। এটি একেবারেই ভুল। লিভার বা যকৃতের সমস্যা হলে জন্ডিস হয়। তবে লিভারের সমস্যা ছাড়াও জন্ডিস হতে পারে। নানা কারণে লিভার বা যকৃতে সমস্যা হতে পারে। এর মধ্যে হেপাটাইটিস ‘ই’ ভাইরাস অন্যতম। বাংলাদেশে জন্ডিসের অন্যতম প্রধান কারণ হেপাটাইটিস ‘ই’ ভাইরাস। এই ভাইরাসের কারনে লিভারে স্বল্পমেয়াদি প্রদাহ হতে পারে। তবে দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহ হয়না।
হেপাটাইটিস ‘ই’ দ্বারা যেকোনো বয়সের মানুষই আক্রান্ত হতে পারে। তবে ১৫ থেকে ৪০ বছর বয়সী ব্যক্তিরা এই রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। শিশুদের ক্ষেত্রে কোনো লক্ষণ ছাড়াই এ রোগ দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে গর্ভাবস্থায় এই ভাইরাস বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। হেপাটাইটিস ‘ই’ মূলত পানিবাহিত একটি ভাইরাস। দূষিত পানি বা খাবারের মাধ্যমে এটি ছড়িয়ে পড়ে। কিছু ক্ষেত্রে মহামারি আকার ধারণ করে। ফুটপাতের খাবার, শরবত বা ফলের রস খেলে এই ভাইরাস শরীরে ঢোকে। তারপর লিভারে গিয়ে প্রদাহ সৃষ্টি করে এবং জন্ডিস হয়। হেপাটাইটিস ‘ই’ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে রোগী ওষুধ ছাড়াই ভালো হয়ে যেতে পারে। কিন্তু এটি যকৃতকে নষ্টও করে দিতে পারে। তবে আশার কথা হচ্ছে, সাধারণত এ ধরণের জটিলতা খুব বেশি হয়না। তারপরেও যেহেতু জটিলতা হতে পারে তাই সাবধান হতে হবে।
হেপাটাইটিস ‘ই’ ভাইরাস জনিত জন্ডিস লক্ষণ ও উপসর্গ:
হেপাটাইটিস ‘ই’ ভাইরাস শরীরে ঢোকার সাথে সাথেই রোগ সৃষ্টি করে না। মোটামুটি এক মাস পর রোগের লক্ষণ দেখা দেয়। রোগটিতে বিভিন্ন উপসর্গ দেখা যায়। যেমন-
১। জন্ডিস
২। খাবারে অরুচি
৩। পেটে ব্যথা
৪। বমি বমি ভাব কিংবা বমি হওয়া
৫। অল্প অল্প জ্বর
৬। চোখ হলুদ হয়ে যাওয়া
৭। জিহ্বার নিচের দিকে হলুদ হয়ে যাওয়া
৮। গাঢ় প্রস্রাব হওয়া
৯। শারীরিক দুর্বলতা
রোগ নির্ণয়:
হেপাটাইটিস ‘ই’ নিশ্চিত হওয়ার জন্য রোগীর রক্তের সিরামে এই ভাইরাসের নির্দিষ্ট অ্যান্টিবডির উপস্থিতি দেখা হয়। এছাড়া লিভারের অবস্থা দেখার জন্য সিরাম বিলিরুবিন ও লিভার ফাংশন টেস্ট করা হয়। এসব পরীক্ষা করে সহজেই এই রোগ ধরা যায় ।
চিকিৎসা:
হেপাটাইটিস ‘ই’-এর বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ওষুধ এখনো আবিষ্কার হয়নি। কোনো কার্যকর ভ্যাকসিনও নেই। তবে হেপাটাইটিস ‘বি’ এবং হেপাটাইটিস ‘সি’ ভাইরাসের মতো হেপাটাইটিস ‘ই’ লিভার সিরোসিস বা ক্যান্সার সৃষ্টি করে না। এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি ভালভাবে বিশ্রাম নিলে এমনিতেই রোগ সেরে যায়। আক্রান্ত ব্যক্তিকে স্বাভাবিক খাবার খেতে হবে। লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, রোগীর বমি বা বমি ভাব হলে অ্যান্টি-ইমেটিক ওষুধ দেওয়া হয়। ক্ষুধামন্দার জন্য ভিটামিন এবং পায়খানার সমস্যা হলে ল্যাক্সেটিভ জাতীয় ওষুধ দেওয়া হয়। হেপাটাইটিস রোগীর ক্ষেত্রে পায়খানা পরিষ্কার হলে রোগী ভালো থাকে। হেপাটাইটিসে আক্রান্ত রোগীকে ব্যথার, ঘুমের এবং কবিরাজি ওষুধ খাওয়া থেকে বিরত রাখতে হবে। কারন এগুলো লিভারের চিরস্থায়ী ক্ষতি করতে পারে।
জটিলতা:
এই ভাইরাসকে অবহেলা করার কোনো উপায় নেই। কারণ লিভার ফেইলিওরের অন্যতম কারণ হেপাটাইটিস ‘ই’ ভাইরাস। বিশেষ করে গর্ভবতী মা এবং আগে থেকে লিভার রোগে আক্রান্ত কেউ যদি হেপাটাইটিস ‘ই’ ভাইরাসে আক্রান্ত হয় তবে তাদের ক্ষেত্রে লিভার ফেইলিওরের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি থাকে। এমনকি আগে থেকে লিভারে রোগ নেই এমন ব্যক্তির বেলায়ও লিভার ফেইলিওরের অন্যতম কারণ হেপাটাইটিস ‘ই’ ভাইরাস। যার ফলে মৃত্যুও ঘটতে পারে।
প্রতিরোধে করণীয়:
১. হেপাটাইটিস ‘ই’ থেকে বাঁচতে হলে এ রোগ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে।
২. এটি একটি পানিবাহিত রোগ, তাই এ রোগ প্রতিরোধের জন্য সব সময় পানি ফুটিয়ে পান ও ব্যবহার করতে হবে। এতে শুধু হেপাটাইটিস ‘ই’ নয়, বরং টাইফয়েড আর ডায়রিয়ার মতো আরো অনেক পানিবাহিত রোগ থেকেও বাঁচা যাবে। খাওয়ার পানি ৩০ থেকে ৪০ মিনিট ফোটালেই হেপাটাইটিস ‘ই’-এর জীবাণু মারা যায়।
৩. খাবার আগে ও পায়খানা থেকে ফেরার পর হাত সাবান দিয়ে ভালো করে ধুয়ে ফেলতে হবে।
৫. ব্যক্তিজীবনে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে হবে।
৬. সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ব্যবস্থা করতে হবে।
৭. ফুটপাতের খাবার ও রাস্তার পাশের পানি বর্জন করতে হবে।