অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা দিনে দিনে কমছে কেন ?

পেনিসিলিন আবিষ্কারের পর একে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। যক্ষা, কলেরা ও ম্যালেরিয়ার মত প্রাণঘাতি রোগ মোকাবেলায় অ্যান্টিবায়োটিক নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছিল। গত শতক জুড়ে অ্যান্টিবায়োটিকের কল্যাণে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে হাজারো প্রাণ। ফলে চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অ্যান্টিবায়োটিকের জয়গান প্রচারিত হয়েছে।

কিন্তু জন্মের শতবর্ষ পূরণের আগেই অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বলা হচ্ছে বেশ কিছু রোগের ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটকের কার্যকারিতা কমে গেছে। কিছু ক্ষেত্রে অবশ্য এর পক্ষে প্রমাণও মিলেছে। গবেষকরা দাবী করছেন মূত্রনালীর সংক্রমণ, নিউমোনিয়া ইত্যাদি রোগের জন্য সাধারণভাবে ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিকগুলো এখন আর কাজ করছে না। সংরক্ষিত অ্যান্টিবায়োটিক যা দ্বিতীয় বা পরবর্তী ধাপের চিকিৎসার জন্য রাখা হয় তা এখন শুরুতেই ব্যবহার করতে হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের দাবী অ্যান্টিবায়োটিকের অতি ব্যবহারই এর মূল কারন। কারণে-অকারণে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই মানুষ অ্যান্টিবায়োটিক কিনছে ও গিলছে। বাংলাদেশের ওষুধের দোকানগুলোতে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই ওষুধ কেনা যায়। অনেক সময় ওষুধের দোকানের বিক্রেতা রোগীর লক্ষণ শুনে নিজেই ব্যবস্থাপত্র দেন ও ওষুধ বিক্রি করেন। চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্পর্কে নূন্যতম ধারণাবিহীন এইসব বিক্রেতা সাধারণত রোগীদের অ্যান্টিবায়োটিক কিনতেই উৎসাহিত করেন। এতে দুইটি লাভ পাওয়া যায়। প্রথমত অ্যান্টিবায়োটিকে দ্রুত ফল পাওয়া যায়। বিক্রেতার ওপর রোগীর আস্থা বাড়ে। তার ব্যবসার পসার হয়। আর দ্বিতীয়ত ওষুধ কোম্পানিরও ভালো ব্যবসা হয়। জ্বর-সর্দি-কাশির মত সাধারণ রোগে যদি অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি হয় তাহলে কোম্পানির হিসেবের খাতায় লাভের অংকটা বড়সড়ই হয়। সারা দুনিয়ায় ওষুধ হিসেবে অ্যান্টিবায়োটিকই সব চাইতে বেশি বেচা-বিক্রি হয়।

তাই বাজার অর্থনীতিতে পণ্য হিসেবে এর উপযোগিতাও বেশ। আসলে ওষুধ ব্যবসাও তো ব্যবসা। ওষুধ ব্যবসায়ীর দৃষ্টিভঙ্গিও তাই সমাজের আর সব ব্যবসায়ীদের থেকে আলাদা কিছু নয়। ওষুধ রোগীর কাজে আসবে কিনা বা রোগীর দেহে কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে কিনা তা নিয়ে সে ভাবে না। মুনাফা বৃদ্ধির চিন্তাই তার একমাত্র বিবেচ্য বিষয়।

অ্যান্টিবায়োটিকের অকারন অতি ব্যবহারের দায় চিকিৎসকদের ওপরও বর্তায়। চিকিৎসকদের বড় একটা অংশের সাথে ওষুধ কোম্পানির আপস-রফা আছে। রোগীর ব্যবস্থাপত্রে অতিরিক্ত ওষুধ লেখার বিনিময়ে তারা মোটা অংকের উৎকোচ পান। অনেক চিকিৎসকের বসার ঘরের সোফা থেকে শুরু করে গোসলের সাবান পর্যন্ত ওষুধ কোম্পানির দেয়া। বিশেষ কিছু চিকিৎসকের জন্য ফ্ল্যাট, বিমানের টিকেট বা হীরার গহনা উপহার দেয়ার ঘটনাও আছে। এছাড়া প্রত্যেকটি কোম্পানি চিকিৎসকদের বিনা পয়সায় নমুনা ওষুধ দেয়। নতুন ওষুধ বাজারজাত করার সময় তারা গবেষণার কথা বলে চিকিৎসকদের প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করে। সবমিলিয়ে ওষুধ নির্বাচনের ক্ষেত্রে ডাক্তাররা ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের দ্বারা প্রভাবিত হন বলে অনেকেই মনে করেন।

এভাবে অ্যান্টিবায়োটিকের অপ্রয়োজনীয় অকারণ ব্যবহারের পরিণতিতে মানুষের দেহে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধী শক্তি তৈরী হচ্ছে। ফলে তা রোগ দমনে আগের মত কার্যকর ভূমিকা রাখছে না। বাধ্য হয়েই অনেক ডাক্তার অপেক্ষাকৃত বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন পরবর্তী প্রজন্মের অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করছেন। সাময়িকভাবে এতে ফল পাওয়া গেলেও সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। কারণ অপ্রয়োজনীয় ও অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণ সময়ের ব্যবধানে এক সময় এইসব ওষুধেরও কার্যকারিতা কমে যাবে। অর্থাৎ ‘অ্যান্টিবায়োটিক উত্তর জমানা’র আবির্ভাব খুব বেশি দূরে নয়। কিন্তু তার মোকাবেলায় আমরা কতটুকু প্রস্তুত? অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়া যক্ষা বা ম্যালেরিয়ার মত প্রাণঘাতি অসুখের মোকাবেলা কিভাবেই বা করা হবে?

এখানে আরো একটা বিষয়ে খেয়াল রাখা দরকার। অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা কমে যাওয়া সম্পর্কিত বেশিরভাগ গবেষণা মূলত ওষুধ কোম্পানিগুলোই করে। অবশ্য বেশ কিছু গবেষণা প্রতিষ্ঠানও এ নিয়ে কাজ করে। তবে এসব প্রতিষ্ঠানেরও কয়েকটি ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে সুবিধাপ্রাপ্ত বলে অভিযোগ আছে। ওষুধের কার্যকারিতা নির্ণয়ে ওষুধ কোম্পানির বাইরে কোন আন্তর্জাতিকমানের দেশীয় গবেষণাকেন্দ্র আমরা এখনও গড়ে তুলতে পারি নাই। এ বিষয়েও নজর দেয়া উচিত।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আরেকটি বিষয় নিয়ে ভাবা খুব জরুরি। রোগের কারণ বা উদ্ভবের সাথে মানুষের জিনের সম্পর্ক থাকাটা স্বাভাবিক। পশ্চিমা চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা অনেকদিন থেকে এমন দাবি করে আসছেন। তারা বলছেন গত শতকের শেষ দিকেই বাজারে প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিকের বিপরীতে প্রায় সব ব্যাকটেরিয়া প্রজাতিরই প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়ে গেছে। অ্যান্টিবায়োটিকের অতি ব্যবহার হয়তো এর মূল কারণ। তবে এর পাশাপাশি তারা অরেকটা কারণ নজরে আনতে চাচ্ছেন। আর তা হচ্ছে জৈব প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রাণী ও উদ্ভিদের মধ্যে পরস্পর সম্পর্কহীন জিনের স্থানান্তর।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সবুজ বিপ্লবের নামে প্রকৃতিতে দেখা-অদেখা হাজারো প্রাণ ও জৈব পদার্থ নির্মূল করা হয়েছে। রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারে নষ্ট হয়েছে মাটির গুণাগুন। ফলন না বাড়লেও নতুন জাতের খাদ্য-শস্যের প্রবর্তন করা হয়েছে। এই নতুন জাতের ফসলে পরস্পর সম্পর্কহীন জিনের স্থানান্তর হওয়াটা অস্বভাবিক নয়। তাছাড়া জৈব প্রযুক্তির মারফত উৎপন্ন হাইব্রিড ফসলেও পরস্পর সম্পর্কহীন জিনের স্থানান্তর ঘটতে পারে।

এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতিতে স্থানান্তরিত হলে জিনের কার্যকারিতা দশ থেকে দশ হাজার গুণ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। তাহলে ভাবুন অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী কোন জিন যদি খাবার বা অন্য কোন মাধ্যমে মানুষের দেহে প্রবেশ করে তবে অবস্থাটা কেমন হওয়ার কথা।

বৃটেনের নিউক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, জিনগতভাবে পরিবর্তিত বীজ থেকে উৎপন্ন সয়াবিন সাতজন লোককে কয়েকদিন খাওয়ানোর পর তাদের শরীরে অবস্থিত কিছু ব্যাকটেরিয়ার জিনে পরিবর্তন এসেছে; অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের ক্ষমতা প্রতিরোধের সক্ষমতা অর্জন করছে ঐসব ব্যাকটেরিয়া। অবশ্য গবেষকদলের নেতা অধ্যাপক হ্যারি গিলবার্ট বলেছেন, এই পরিবর্তনের মাত্রা ‘খুব সামান্য’।

কিন্তু জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিষয়ক কর্মীরা একে খাটো করে দেখতে পারছেন না। জিনগতভাবে পরিবর্তিত বীজের ব্যবসার আকার ও কোম্পানিগুলোর প্রভাব সম্পর্কে তারা যেহেতু জানেন, ফলে তারা বলছেন এই গবেষণার ফলাফল মানব জাতির জন্য ভয়াবহ ভবিষ্যতেরই ইঙ্গিত দিচ্ছে।

InfotakeBD

View posts by InfotakeBD
InfotakeBD is a information sharing blog, We share information for you. Please visit us and if you want to contribute for this blog please email us infotakebd@gmail.com. Thank you

Leave a Reply

Scroll to top