ভালোবাসা সম্পর্কে চিকিৎসাবিজ্ঞান কি বলে?

ভালোবাসা এমন এক জিনিস যা পাওয়ার জন্য সবাই ব্যাকুল হয়ে থাকে। কত কবি সাহিত্যিক হাজার হাজার পাতা লিখে ফেলেলেন শুধু এই ভালোবাসাকে উপজীব্য করে। কেউ কেউ ভালোবাসার খোঁজে হয়রান, কেউবা ভালোবাসা হারিয়ে হচ্ছে উন্মাদ। আবার কেউ হয়ত ভালোবাসা পেয়ে সব কিছু ভুলে গিয়ে ভাবতে বসেছে এটাই জীবন, এতেই নিহিত সকল সুখ!

ভালোবাসার উপর কত কোটি কবিতা, গল্প, উপন্যাস, সিনেমা বা নাটক তৈরী হয়েছে তার কোন ইয়াত্তা নাই। এসব জায়গায় ভালোবাসাকে সবাই যার যার নিজের মত করে বর্ণনা করেছেন। সায়েন্স বা বিজ্ঞানের মতে ভালোবাসা বা সব ধরনের মানবিক ইমোশন আমাদের মস্তিষ্কের কিছু রিয়াকশনের ফল। কিন্ত এই কথাটা সবাই মানতে নারাজ! তারা এই মধুর জিনিসকে ক্লাইমেক্সের বাইরে বের হতে দিবেননা বা দিতে চান না। দেখা যাক চিকিৎসাবিজ্ঞান ভালোবাসা নিয়ে কি বলে-

১) ভালোবাসা এক ধরনের নেশা বা এ্যাডিকশন

ভালোবাসার মানুষটি পাশে থাকলে বা তাকে নিয়ে ভাবলে মস্তিষ্কের ভেন্ট্রাল টেগমেন্টাল এরিয়া (ventral tegmental area)-তে একটা নিউরোট্রান্সমিটার রিলিজ হয় যার নাম ডোপামিন। এটা  মানুষকে ভালোলাগার অনুভূতি (pleasure) দেয়। ডোপামিন লেভেল বেড়ে গেলে তা নিউরোনাল চেইঞ্জ করে এ্যাডিকশন বা আসক্তিতে রুপ দেয়। অনেকটা মরফিন বা প্যাথেডিনের মত। ফলে সত্যিকারের ভালোবাসার কাছ থেকে দূরে থাকলে মানুষ বিরহ-বেদনায় ভুগে, মরফিন বা প্যাথেডিনের উইথড্র্যাল সিনড্রোম-এর মত।

২) ভালোবাসা হলো অবসেসিভ বা আচ্ছন্ন করে রাখে

মানুষ যখন ভালোবাসার মধ্য দিয়ে যেতে থাকে তখন এটা মস্তিষ্কের সেরোটোনিন-এর পরিমাণ কমিয়ে দেয়। সেরোটোনিন এর কাজ হলো এটা অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতাজনিত দুশ্চিন্তার বিরুদ্ধে কাজ করে। এটা কমে গেলে কোন কিছুর উপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কমে যায়। ফলে মানুষ একটা নিদিষ্ট গণ্ডিতে বন্দী হয়ে পড়ে। সে এটা থেকে বের হতে পারেনা এবং বারবার একই জিনিস তার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। তাই প্রেমে পড়লে মানুষের মনের গহীনে সব সময় ভালোবাসার মানুষটি এসে হাজির হয়, তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে।

৩) ভালোবাসা বেপরোয়া করে তোলে

আমাদের মস্তিষ্কের প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স অংশের কাজ হলো বিচার-বিবেচনা, বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করা। মানুষ যখন ভালোবাসায় মত্ত থাকে তখন এই প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্সের কাজ লোপ পায়। এ কারনে সে সঠিক বিচার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।  ভালোবাসার মানুষের জন্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে বা প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে মারামারি করতেও পিছপা হয়না। এর সাথে সাথে এসময় মস্তিষ্কের এ্যামিগডালা অংশের কাজও লোপ পায়। এটা থ্রেট রেসপন্স বা ভয়-ভীতি উপলব্ধি করাতে কাজ করে। ফলে মানুষ কোন থ্রেট বা ভীতি নিয়ে ভাবার সুযোগ পায়না। তার কাছে ভালোবাসাই যেন সব।

৪) ভালোবাসা থেকেই একান্ত করে পাওয়ার বাসনা

ভালোবাসা ও যৌনতা আলাদা হতে পারে। কিন্তু এরা মস্তিষ্কে একে-অপরের সাথে ওভার ল্যাপ করে থাকে। ভালোবাসা থেকে একান্ত চাওয়া হতে পারে, আবার একান্ত মুহুর্তের পরেও ভালোবাসা হতে পারে। এই দুই অনুভূতি একই সাথে মস্তিষ্কের একই অংশকে উদ্দীপ্ত করে। যেমন যৌনমিলনের সময় মস্তিষ্কের ভেন্ট্রাল পেলিডাম নামক অংশে অনেক বেশি অক্সিটোসিন হরমোন রিলিজ হয়। এটা মানুষের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী বন্ধন ও পারস্পরিক অনুরক্তি সৃস্টি করে। ফলে দেখা যায়, পরস্পর অপরিচিত দুজন মানুষের মধ্যে বিয়ের পরে একান্ত মুহুর্তের শেষে বিশেষ অনুরক্তি তৈরী হয়।  আবার মানুষ জীবনের প্রথম ভালোবাসাকে ভুলতে পারেনা। কারন প্রথম ভালোবাসার সময় অনেক বেশি অক্সিটোসিন নিঃসৃত হয় যা মস্তিষ্কে স্থায়ী পরিবর্তন ঘটায়। এ কারনে সে মানুষটি হারিয়ে গেলেও তার প্রতি একটা ভালোবাসা সব সময়ই থেকে যায়।

৫) মেয়েরা ভালোবাসা সম্পর্কিত সব কিছু মনে রাখতে পারে

মেয়েরা যখন ভালোবাসে তখন তাদের মস্তিষ্কের হিপ্পোক্যাম্পাস অংশ অনেক বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। হিপ্পোক্যাম্পাস মানুষের স্মৃতি তৈরীর কাজ করে। আবার মেয়েদের হিপ্পোক্যাম্পাস ছেলেদের থেকে বড়। ফলে মেয়েরা যখন কাউকে ভালোবাসে তখন ভালোবাসা সম্পর্কিত সব কিছু স্মৃতিতে পরিণত হতে থাকে। এ কারনে মেয়েরা অনেক কিছু মনে রাখতে পারে। যেটা ছেলেরা পারেনা। ছেলেরা অনেক কিছুই সহজে ভুলে যায়। যদিও তারা ইচ্ছা করে ভুলে না। ছেলেদের হিপ্পোক্যাম্পাস মেয়েদের মত কাজ করেনা বলেই তারা ভুলে যায়।

৬) চাহনি বা আই কন্ট্রাক্ট হলো প্রেমিকের জাদু 

নবজাতক ও প্রেমিকের ক্ষেত্রে চোখের চাহনি হচ্ছে ইমোশনাল কানেকশন বা আবেগী বন্ধনের সব থেকে বড় পথ। ছেলেদের চোখে খুব সহজেই অনেক কিছু ভালো লাগে যায়। একে আরো তরান্বিত করে সুন্দর ও মোহনীয় হাসি। এ কারনে ছেলেরা একবার দেখেই প্রেমে পড়ে যায়, যা মেয়েদের ক্ষেত্রে কিছুটা কম। ভয়েস ইন্টারঅ্যাকশন বা কথোপকথনও ইমোশনাল কানেকশন ওয়ে হিসাবে কাজ করে। তবে এর অবস্থান চাহনি বা আই কন্ট্রাকক্টের পরে।

৭) মনোগ্যামি ও পলিগ্যামি অর্থাৎ একগামিতা ও বহুগামিতা

মনোগ্যামি ও পলিগ্যামি সম্ভবত বায়োলজিক্যাল্লি ডিটারমাইন্ড। অর্থাৎ জৈবিকভাবেই নির্ধারিত। আমরা দুই ধরনের মানুষ দেখি। এক পক্ষ একজনকে বিয়ে করে তাকে নিয়ে সারা জীবন কাটিয়ে দিতে পারে। আরেক পক্ষ অনেকগুলো সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে বা একাধিক বিয়ে করে থাকে। এটা যেমন সাইকোলজিক্যাল বিষয়, তেমনি জেনেটিক্যালিও ডিটারমাইন্ড। অর্থাৎ জিনগতভাবেও পূর্বনির্ধারিত। মনোগ্যামি ও পলিগ্যামির জন্য যে দুটি রাসায়নিক পদার্থ দায়ী তা হচ্ছে, অক্সিটোসিন ও ভেসোপ্রেসিন। গবেষনায় দেখা গেছে, ছেলেদের নিঃশ্বাসের সাথে অক্সিটোসিন দেয়া হলে এরা একজন নারীর প্রতি খুব বেশি আকর্ষণ বোধ করে।

৮) ছেলে ও মেয়ে শুধুমাত্র বন্ধু হতে পারেনা

গবেষনায় দেখা গেছে, ছেলেরা কখনো মেয়েদের সাথে অর্থবহ বন্ধুত্বকে শুধুমাত্র বন্ধুত্ব হিসেবে দেখে না। ছেলেরা সব সময়ই বন্ধু হওয়া থেকেও বেশি কিছু চায়!  অন্যদিকে মেয়েদের মস্তিষ্ক ভালোবাসা এবং বন্ধুত্বকে আলাদা করতে পারে। ফলে মেয়েদের কাছে বন্ধুত্ব এবং ভালোবাসা ভিন্ন হতে পারে।

InfotakeBD

View posts by InfotakeBD
InfotakeBD is a information sharing blog, We share information for you. Please visit us and if you want to contribute for this blog please email us infotakebd@gmail.com. Thank you

Leave a Reply

Scroll to top