ডাক্তার ভাই নামে খ্যাত এড্রিক বেকার ১৯৪১ সালে নিউজিল্যান্ডের ওয়েলিংটনে জন্মগ্রহণ করেন। তার পুরো নাম এড্রিক সারগিসন বেকার।
এড্রিক বেকার ১৯৭৯ সালে সর্বপ্রথম বাংলাদেশে পা রাখেন। মেহেরপুরে অবস্থিত বল্লভপুর মিশন হসপিটালে মেডিকেল অফিসার হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু হয়। পরবর্তীতে মির্জাপুর কুমুদিনী হসপিটালে প্রায় বছরখানেক ডাক্তারি করার পর ১৯৮৩ সালে থানারবাইদ ক্লিনিকের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন।
২০০৪ সালে তিনি কাইলাকুড়ি হেলথ কেয়ার প্রজেক্ট শুরু করেন। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত তিনি নিজ সন্তানের মতো এই প্রজেক্টের দেখাশোনা করেছেন। গত ১ সেপ্টেম্বর তিনি পৃথিবীকে চিরতরে বিদায় জানান। কিন্তু রেখে যান আর্ত-মানবতার সেবার একটি অনন্য মডেল। মাটির ঘরে, শীতল পাটি বা চাটাইয়ের শয্যাব্যবস্থাসম্পন্ন হাসপাতালে এতো সুন্দর চিকিৎসা সেবা দেয়া যায় তা আমাদের জানা ছিলো না। এখানে রয়েছে আই.সি.ইউ, প্রসূতি ওয়ার্ড, শিশু ওয়ার্ড, মেডিসিন ওয়ার্ড, বয়স্কদের জন্য বিশেষ পরিচর্যা ওয়ার্ড এবং ডায়াবেটিক ওয়ার্ড ।এমনকি অপারেশন থিয়েটারও আছে। ৯৩ জন স্টাফ নিয়ে অজপাড়াগাঁয়ের এই হাসপাতাল কমপ্লেক্স স্বাস্থ্যসেবায় বিরাট ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। রোগী, ডাক্তার ও হাসপাতালের স্টাফ সবাই একসঙ্গে বসে একই চুলায় রান্না করা খাবার খান। এ যেনো সাম্যের এক অভূতপূর্ব মিলনমেলা।
প্রায় দুই মাস অসুস্থ থেকে ডাক্তার ভাই তথা এড্রিক বেকার মারা যান। উন্নত চিকিৎসা গ্রহণের সকল সুবিধা থাকা সত্ত্বেও তিনি স্বেচ্ছায় তা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। নিজের সময় ফুরিয়ে আসছে এটা নিজেই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন।তার রক্ত পরীক্ষায় অক্সিজেনের ঘনত্ব কমে যাওয়ার বিষয়টি ধরা পড়ায় বাইরের হাসপাতাল থেকে অক্সিজেনের ব্যাবস্থা করা হয়েছিলো। তিনি তা ফিরিয়ে দেন। বলেছিলেন “আমার রোগীরা এখানে অক্সিজেন পায় না, আমি কেনো অক্সিজেন নিবো?” তার অসুস্থতার খবর পেয়ে নিউজিল্যান্ড থেকে তার দুই বোন তাকে দেখতে এসেছিলেন। তারা তাকে নিজ দেশে নিয়ে যেতে চাইলেও তিনি রাজি হননি। জীবনের বাকী সময়টা এখানেই কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত তার ইচ্ছাই পূরণ হলো।
বিগত ৪ সেপ্টেম্বর আমরা একটি টিম নিয়ে তার প্রতিষ্ঠিত কাইলাকুড়ি হেলথ কেয়ার প্রজেক্ট পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। যাবার বেলা বেশ প্রফুল্লভাবে গেলেও, ফেরার সময়ে মলিনমুখে এসেছিলাম। ডাক্তার ভাই বেঁচে থাকতে আমরা তার দেখা পাইনি এই অনুশোচনা সবাইকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো।
তিনি তার জীবনের সেরাটুকু দিয়ে গেছেন আর্তমানবতার সেবায়, এই বাংলাদেশে। আমরা তার বিনিময়ে তাকে কি দিতে পেরেছি জানি না। সেই হিসাব করে লজ্জিত হবার সাহসটুকুও আজ আমাদের নেই। শুধু পারবো তার এই স্বপ্নকে এগিয়ে নিতে যেতে। আমাদের বিশ্বাস তার স্মৃতি আজও বেচে আছেন কাইলাকুড়ির প্রতিটি ধুলিকনার মাঝে, প্রতিটি মানুষের নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে। আমরা তার সাথে আছি এবং থাকতে চাই।